কুকুর স্থানান্তর ‘আপাতত’ বন্ধ হলেও আশ্বস্ত নন প্রাণিপ্রেমীরা

উচ্চ আদালতে মামলা করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকা থেকে বেওয়ারিশ কুকুর স্থানান্তর সাময়িকভাবে থামানো গেলেও প্রক্রিয়াটি পুরোপুরি বন্ধ হবে কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারছেন না প্রাণিপ্রেমীরা।

ওবায়দুর মাসুম জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Nov 2020, 06:30 PM
Updated : 13 Dec 2020, 07:04 PM

তারা বলছেন, স্থানান্তর বা অপসারণ না করে সুষ্ঠু এবং সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কুকুর নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। শহর থেকে কুকুর বিতাড়নের বিপক্ষে মত দিয়েছেন একজন নগর পরিকল্পনাবিদও।

সম্প্রতি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন বেওয়ারিশ কুকুর অপসারণের উদ্যোগ নিলে প্রাণী অধিকার রক্ষা নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো বিরোধিতা শুরু করে; নানা কর্মসূচিও পালন করে তারা।

আপত্তির মুখে গত ২৯ সেপ্টেম্বর বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। বৈঠকে মেয়র জানান, বেওয়ারিশ কুকুরের ‘পরিপূর্ণ দায়িত্ব’ নিলে স্থানান্তর করা হবে না। বেওয়ারিশ কুকুর ব্যবস্থাপনায় পশুপ্রেমীদের কাছে লিখিত প্রস্তাব চান তিনি।

পরে ৮ অক্টোবর কুকুর ও প্রাণিরক্ষায় কাজ করা সংগঠনগুলো নয়টি সুপারিশসহ একটি চিঠি পাঠায় মেয়রের কাছে।

চিঠিতে বেওয়ারিশ কুকুর ব্যবস্থাপনা নিয়ে স্বাস্থ্য, প্রাণিসম্পদ এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সমন্বিতভাবে কাজ করার প্রস্তাব রয়েছে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরামর্শ অনুযায়ী বেওয়ারিশ কুকুর ব্যবস্থাপনায় বিজ্ঞানভিত্তিক এবং আইনগতভাবে বৈধ সমাধানের পথ বের করা, কুকুরকে জলাতঙ্কের টিকা দেওয়া, মানুষকে কুকুর পালনে উৎসাহী করতে কার্যক্রম হাতে নেওয়া, কুকুর নিয়ে মানুষের ভীতি দূর করতে বিভিন্ন সংগঠনের কার্যক্রমে ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের সম্পৃক্ত করা, গৃহপালিত প্রাণির নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করার পরামর্শ দিয়েছেন প্রাণিপ্রেমিরা।

লকডাউনে খাদ্য সঙ্কটে পড়া রাজধানীর অফিসপাড়ার কুকুরগুলোকে নিজ উদ্যাগে খাবার দিচ্ছিলেন কেউ কেউ। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

প্রাণিরক্ষা সংগঠন অভয়ারণ্যের চেয়ারম্যান রুবাইয়া আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এসব সুপারিশ দেওয়ার পর ডিএসসিসি থেকে সংগঠনগুলোর সঙ্গে আর যোগাযোগ করা হয়নি।

“আমরা আমাদের মতো করে কাজ করে গেছি, কিন্তু তাদের পক্ষ থেকে তাদের কাজ করছে বলে আমাদের মনে হচ্ছে না। উনার (ডিএসসিসি মেয়র) বক্তব্য শুনে এখন পর্যন্ত আমরা কোনো ধরনের আশ্বাস পাইনি যে তিনি একটা বৈজ্ঞানিক এবং মানবিক সিদ্ধান্ত নেবেন।”

প্রাণী অধিকারকর্মী নাদিয়া চৌধুরী জানান, বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কুকুর নিয়ন্ত্রণে রাখার পদ্ধতিটি কার্যকর করা যায় কিনা, তা তারা মেয়রকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন।

“বিভিন্ন গণমাধ্যমে আমরা যা দেখেছি, তিনি (শেখ ফজলে নূর তাপস) বলেছেন, তিনি চান না ঢাকা শহরের রাস্তাঘাটে কোনো কুকুর থাকুক। ডিএনসিসির সঙ্গে সিডিসি (স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল বিভাগ) কাজ করছে জলাতঙ্ক নির্মূল ও কুকুর নিয়ন্ত্রণে। আমরা চাচ্ছি ডিএসসিসির সঙ্গেও এ ধরনের কাজ হোক। এজন্য ডিএসসিসির সহায়তা লাগবে। সে জায়গাটায় আমরা এখনও আসিনি, ডিএসসিসির সঙ্গে আরও কথা বলতে হবে।”

রাজধানী থেকে কুকুর সরিয়ে নেওয়া কোনো সমাধান নয় বলে মনে করেন বুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ডা. সারোয়ার জাহান। বিষয়টি নিয়ে একটি নীতিমালা করার পক্ষে মত দিয়েছেন তিনি।

“এসব কুকুর অনেকের কাছে আতঙ্ক-বিরক্তির কারণ হচ্ছে সত্যি। তবে মেরে ফেলা, অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া সঠিক পদ্ধতি হতে পারে না। এই শহরে প্রাণিদেরও থাকার অধিকার আছে। তবে কুকুর রাখলে কতটুকু রাখা যায়, বাকিগুলোকে কি করা যায়- তা নিয়ে এই বিষয়ে অভিজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে একটা পলিসি করা যেতে পারে।”

রাজধানীতে এখন বেওয়ারিশ কুকুরের সংখ্যা দেড় লাখ বলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ভাষ্য।

ডিএসসিসির অবস্থান

সম্প্রতি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বেওয়ারিশ কুকুর স্থানান্তর প্রসঙ্গে বলেন, কোনো সভ্য দেশে বেওয়ারিশ জন্তু রাস্তাঘাটে থাকে না। এটা যেমনি ঝুকিপূর্ণ, তেমনি সাধারণ মানুষের জন্য কষ্টকর বিষয়। ইতোমধ্যে আমরা উদ্যোগ গ্রহণ করেছি ঢাকা শহর থেকে বেওয়ারিশ কুকুর উচ্ছেদ করব।

“তবে যেহেতু হাই কোর্টে একটা মামলা হয়েছে এবং যারা মামলা করেছে, তাদের সাথে আলোচনা হয়েছে, বৈঠক হয়েছে, আমরা সমন্বিতভাবে একটা ব্যবস্থাপনায় আনব। যেহেতু হাই কোর্টে মামলা আছে, এই ব্যাপারে আমি এখন কিছু বলতে চাই না।”

বেওয়ারিশ কুকুর অপসারণে ডিএসসিসি কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশনা চেয়ে গত ১৭ সেপ্টেম্বর একটি রিট মামলা হয়। জনস্বার্থে অভিনেত্রী জয়া আহসানের সঙ্গে প্রাণীকল্যাণ সংগঠন অভয়ারণ্য ও পিপলস ফর অ্যানিম্যাল ওয়েলফেয়ার মামলাটি করেন।

গত ১২ অক্টোবর রিটের ওপর শুনানি হয়। সেদিন বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি মোহাম্মদ আলীর হাই কোর্ট বেঞ্চ রিটের চূড়ান্ত শুনানি না হওয়া পর্যন্ত কুকুর অপসারণ বন্ধ রাখার আদেশ দেয়।

সেই সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে মেয়রের সঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেলকে কথা বলতে বলে হাই কোর্ট। এরপর মামলার শুনানি এক মাসের জন্য মুলতবি রাখা হয়।

রিটকারীপক্ষের অন্যতেম আইনজীবী সাকিব মাহবুব জানিয়েছেন, গত ১৫ নভেম্বর শুনানির দিন ছিল। কিন্তু তাদের প্রধান আইনজীবী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ায় শুনানি পেছানোর আবেদন করেন তারা।

“আমাদের প্রধান আইনজীবী মোস্তাফিজুর রহমান খান করোনা আক্রান্ত থাকায় আমরা এক সপ্তাহ সময় বাড়ানোর আবেদন করেছি। আগামী রোববার শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে।”

উত্তর সিটির ভিন্ন পথ

বেওয়ারিশ কুকুর অপসারণ না করে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় আনতে চায় উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)।

মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, বেওয়ারিশ কুকুর ব্যবস্থাপনায় ডিএনসিসি বিশেষ বরাদ্দ দেবে। কুকুরকে জলাতঙ্কের টিকা দেওয়া এবং বন্ধ্যাত্বকরণ চালু করতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে আলোচনা চলছে।

“শহরটা শুধু মানুষের একার নয়। মেয়র হিসেবে আমি বলতে চাই, আমাদের এখান থেকে সরিয়ে দিলে তারা আরও বেশি হিংস্র হয়ে যায়। এতে মানুষকে কামড়ানোর আশঙ্কা আরও বেড়ে যায়। এ কারণে এগুলোকে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় আনতে চাই।”

আছে সমন্বয়ের অভাব

দুই সিটি করপোরেশনের প্রায় ৫০ হাজার কুকুরকে টিকা দেওয়া হচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় জলাতঙ্ক নির্মূল কর্মসূচির আওতায়।

অভয়ারণ্যের চেয়ারম্যান রুবাইয়া আহমেদের মতে, প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে।

“আগে যেসব কুকুরকে টিকা দেওয়া হয়েছিল সেগুলোকে রেখে আসা হয়েছে মাতুয়াইলে। এক সংস্থা কুকুরকে ভ্যাকসিন দিচ্ছে, আরেক সংস্থা ফেলে দিয়ে আসছে।”

প্রাণি অধিকারকর্মী নাদিয়া চৌধুরী বলেন, একই শহরে হলেও দক্ষিণ ও উত্তরের কার্যক্রমের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।

“দুটি পক্ষের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব আছে। ডিএসসিসির মেয়র স্যার এসেই বললেন কুকুর রিলোকেট করবেন। সিডিসি অলরেডি কুকুরের ভ্যাকসিনেশন শুরু করে দিয়েছে। আবার ডিএনসিসি একটি বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে যৌথভাবে কুকুরের টিকাদান এবং বন্ধ্যাকরণ করছে। দুইটা কিন্তু ভিন্ন জিনিস।”

ডিএসসিসি কুকুর স্থানান্তর করলে কর্মসূচি কতটা সফল হবে- এ প্রশ্নে জাতীয় জলাতঙ্ক নির্মূল কর্মসূচির ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার এস এম গোলাম কায়সার বলেন, সিটি করপোরেশনের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজটি শুরু করেছেন তারা। যখন এ কর্মসূচি শুরু করেন, তখন কুকুর স্থানান্তরের আলোচনা ছিল না।

“সিটি করপোরেশনের লোকজনও আমাদের এই কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত। আমরা ওয়ার্ড পর্যায়ে এই টিকা দিচ্ছি। আমরা মেয়র মহোদয়ের সঙ্গে কথা বলে, উনার অনুমতি নিয়েই কাজটি করেছি। আর যতদূর জানি, অপসারণ কার্যক্রম এখন বন্ধ আছে।”