জলাতঙ্ক নির্মূলে কুকুর নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হলেও উদ্যোগ নেই

২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে জলাতঙ্ক নির্মূলের লক্ষ্যে নয় বছর আগে কর্মসূচি নেওয়া হলেও তার একটি প্রধান অঙ্গ কুকুর নিয়ন্ত্রণের কাজটি এগোচ্ছে না।

ওবায়দুর মাসুম জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 Oct 2020, 02:58 PM
Updated : 25 Oct 2020, 02:58 PM

২০১১ সালে নেওয়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এই কর্মসূচি বাস্তবায়নে সহায়তা করছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।

নয় বছর পর এসে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, কুকুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ তাদের কাজ নয়। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বলছে, তাদের জনবল নেই। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্মসূচির খোঁজও মেলেনি।

জলাতঙ্ক রোগটি মূলত র‌্যাবিস ভাইরাস আক্রান্ত কুকুরের কামড় কিংবা আঁচড় থেকে মানবদেহে ছড়ায় বলে বেওয়ারিশ কুকুর নিয়ন্ত্রণের উপর জোর দেওয়া হয়েছিল ২০১১ সালে নেওয়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মসূচিতে।

সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে প্রতি বছর কুকুরের কামড়ে আহত হয় সাড়ে তিন লাখের মতো মানুষ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার অধীনে জাতীয় জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল কর্মসূচির আওতায় দেশের ৬৭টি কেন্দ্রে কুকুরে কামড়ালে টিকা দেওয়া হয়।

রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার হিসাবে, ২০১৯ সালে সারাদেশে ২ লাখ ৫১ হাজার ৮৭৭ জনকে টিকা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৭১ হাজার ১৫৭ জন ঢাকা বিভাগের।

২০২০ সালে শুরু থেকে অক্টোবর পর্যন্ত যে ১ লাখ ২৬ হাজার ৫৮৩ জনকে টিকা দেওয়া হয়েছে, তার ৩৪ হাজার ৫২৫ জন ঢাকা বিভাগের। বাকিরা অন্য বিভাগের।

সাল

কুকুরের কামড়ে আহত

 

২০১২

১,২৯,৪৪৪ জন

 

২০১৩

২,৫২,২৭৫ জন

 

২০১৪

২,৫৪,৬২১ জন

 

২০১৫

২,৫১,৩০১ জন

 

২০১৬

২,৯৮,৭৭২ জন

 

২০১৭

২,৫৮,৪৪৫ জন

 

২০১৮

২,৫৩,৪০৯ জন

২০১৯

২,৫১,৮৭৭ জন

২০২০

১,৫১,২৭৯ জন (সেপ্টেম্বর পর্যন্ত)

কর্মসূচির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল কেন্দ্রগুলোর প্রতিটিতে দৈনিক গড়ে ১৫ জন চিকিৎসা নিচ্ছেন।

সে হিসেবে বছরে প্রায় সাড়ে তিন লাখের বেশি মানুষকে কুকুর কামড়ায়; যদিও সবগুলো কেন্দ্র ও হাসপাতাল থেকে কুকুরে কামড়ের সঠিক হিসাব যেমন আসে না, তেমনি কুকুরে কামড়ালেও অনেকে হাসপাতালেও যান না।

বিভাগ

২০১৯ সাল

২০২০ সাল

ঢাকা

৭১ হাজার ১৫৭

৩৪ হাজার ৫২৫

চট্টগ্রাম

৪২ হাজার ১৯৫

১৯ হাজার ৩৪৯

রাজশাহী

৪৯ হাজার ১৪৪

২৫ হাজার ৩২

খুলনা

৩৩ হাজার ৭৯৪

১৯ হাজার ৫৫১

রংপুর

২৬ হাজার ৫৩৭

১২ হাজার ৮১১

বরিশাল

১১ হাজার ৫১৯

৫ হাজার ৭৭১

সিলেট

৪ হাজার ৫৪৩

২ হাজার ৩৩৭

ময়মনসিংহ

১৩ হাজার ৭৮

৭ হাজার ২০৭

র‌্যাবিস ছড়ানোর জন্য বেওয়ারিশ কুকুরকেই দায়ী করেন কর্মসূচি সংশ্লিষ্টরা; তবে এই ধরনের কুকুরের সঠিক হিসাব কোনো সরকারি সংস্থার কাছে নেই।

জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল কর্মসূচির কর্মকর্তাদের ধারণা, বাংলাদেশে বেওয়ারিশ কুকুর আছে ১৬ থেকে ১৮ লাখের মতো।

রোববার ঢাকার মহাখালীর সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায় জলাতঙ্কের টিকা নিতে আসা মানুষের দীর্ঘ লাইন।

এই মানুষগুলোর বেশিরভাগই ঢাকার। তবে ঢাকার আশপাশের জেলাগুলোরও কেউ কেউ রয়েছেন।

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার কেন্দুয়াব গ্রামের বাসিন্দা মো. রিপন জানান, গ্রামের পথে হাঁটার সময় কুকুর কামড়ে দিয়েছে তাকে।

তিনি কুকুরের উপদ্রব বেড়ে যাওয়ার কথা জানান। তা নিয়ন্ত্রণে কোনো পদক্ষেপ রয়েছে কি না- প্রশ্ন করলে রিপন বলেন, “আগে মানুষ পিটাইয়া কুকুর মাইরা ফেলত। কিন্তু এখন কেউ মারে না। শুনছি শহরে নাকি কুকুর নিধন করে, কুকুরের জন্ম নিয়ন্ত্রণের কাজও করে। কিন্তু গ্রামে তো এসব কার্যক্রম দেখি না।”

সম্প্রতি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকা থেকে কুকুর সরানোর উদ্যোগ নেওয়ার পর বেওয়ারিশ কুকুরের বিষয়টি আলোচনায় আসে।

কুকুর সরানোর এই পদক্ষেপের সমালোচনা করেন প্রাণি অধিকারকর্মীরা; এটা যে আইনসম্মত নয়, তাও তুলে ধরে তারা।

শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অ্যান্ড পাবলিক হেলথ বিভাগের চেয়ারম্যান ড. কেবিএম সাইফুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, প্রাণী থেকে মানুষের শরীরে আসে এমন রোগের মধ্যে ‘সবচেয়ে ভয়ানক’ জলাতঙ্ক। এ কারণে কুকুর নিয়ন্ত্রণে রাখা দরকার।

তবে কুকুর নিধন এর সমাধান নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, “কারণ এটা মানবিক না, বিজ্ঞানসম্মতও না। কুকুরকে স্থানান্তর করাও সঠিক পদ্ধতি নয়।

“বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থাপনা হচ্ছে সিএনভিআর-ক্যাপচার, নিউচার, ভ্যাকসিনেশন অ্যান্ড রিটার্ন। এটা পপুলেশন নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি।”

সাইফুল বলেন, জলাতঙ্কের টিকা দেওয়ার পাশাপাশি কুকুর নিয়ন্ত্রণ সমান জরুরি।

“জলাতঙ্কের টিকা দিলেন কিন্তু কুকুর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করলেন না, তাহলে জলাতঙ্কের টিকা দিয়ে পোষানো যাবে না।”

রাজধানীতে এখন বেওয়ারিশ কুকুরের সংখ্যা দেড় লাখ বলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ভাষ্য।

জলাতঙ্ক নির্মূলের কর্মসূচিতে চারটি কর্মকৌশলের একটি হচ্ছে কুকুর নিয়ন্ত্রণ। অন্যগুলো হল- জলাতঙ্ক রোগ ও এর চিকিৎসা সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করতে সামাজিক কার্যক্রম জোরদার করা, কুকুরের কামড়ের আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা।

কুকুর নিয়ন্ত্রণের জন্য কুকুরের শরীরে জলাতঙ্ক প্রতিরোধী টিকাদান এবং লাইগেশন ও খোঁজাকরণের কথা রয়েছে কর্মকৌশলে।

অন্য কর্মকৌশল বাস্তবায়ন চললেও কুকুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে কোনো কাজ এখনও শুরু হয়নি।

বিষয়টি জানতে চাইলে কর্মসূচি বাস্তবায়নকারী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়্ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. শাহনীলা ফেরদৌসী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এটা তাদের কাজ নয়, এটা করার জনবলও তাদের নেই।

“জনস্বাস্থ্য বিবেচনায় আমরা টিকাদান কর্মসূচিটা করে দিচ্ছি। কুকুরে কামড়ালে তাকে টিকা দেওয়ার কাজ আমাদের। কিন্তু ডগ পপুলেশন নিয়ন্ত্রণের কাজটা উনাদের। দেশের প্রতিটি উপজেলায় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের প্রশিক্ষিত লোকবল আছে। ওই দায়িত্বটা উনাদের নিতে হবে।”

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবদুল জব্বারের কাছে জানতে চাইলে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন, “ভবঘুরে কুকুরের জন্য এ ধরনের ব্যবস্থা আমাদের এখানে নেই। বেওয়ারিশ কুকুর নিয়ন্ত্রণ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব না। এত পরিমাণ লোকবল আমাদের নেই।”

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, কুকুরের জন্মনিয়ন্ত্রণ নিয়ে তারা কাজ করবেন।

“স্থানীয় সরকার এ ধরনের কাজে সবার সঙ্গে সহযোগিতা করে। বর্তমানে কুকুরের ভ্যাকসিন দেওয়ায় সহযোগিতা করা হচ্ছে। কুকুরের জন্মনিয়ন্ত্রণের বিষয়টি যেহেতু উত্থাপিত হয়েছে, এর আইনগত দিকগুলো আমি দেখব। এটা নিয়েও কাজ করা যায়।”