তাতে বলা হয়েছে, গ্রাহকরা গ্যাস বিতরণ লাইনের রাইজার মাটি চাপা দিয়ে রাখায়, মসজিদে বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগ নেওয়ায়, মসজিদ নির্মাণের সময় গ্যাস বিতরণ পাইপলাইন নষ্ট করে ফেললেও কর্তৃপক্ষকে তা না জানানোয় এবং ভবন নির্মানে ক্রুটির কারণে ওই দুর্ঘটনা ঘটে থাকতে পারে বলে তদন্তকারীরা মনে করছেন।
গত ৪ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ৮টার দিকে এশার নামাজ চলাকালে মসজিদে বিকট শব্দে বিস্ফোরণে অর্ধশতাধিক মানুষ অগ্নিদগ্ধ হন। তাদের ৩১ জন ইতোমধ্যে মারা গেছেন। আরও পাঁচজন এখনও চিকিৎসাধীন।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাটির নিচে চাপা দিয়ে রাখা গ্যাস রাইজার এবং মসজিদ নির্মাণের সময় ক্ষতিগ্রস্ত পুরনো বিতরণ লাইন থেকে গ্যাস বের হচ্ছিল। সেই গ্যাস মসজিদের বেইজমেন্ট ভেদ করে ভেতরে গিয়ে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে জমা হয়।
বৃহস্পতিবার বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে গিয়ে প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর হাতে তদন্ত প্রতিবেদন তুলে দেন তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ও তিতাসের মহাব্যবস্থাপক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) আবদুল ওহাব।
পরে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বলেছেন, গাফিলতি যদি থাকে, তাহলে সংস্থা বা গ্রাহক যেই হোক, কেউ দায় এড়াতে পারবে না।
পশ্চিম তল্লার বায়তুস সালাত জামে মসজিদে সেই রাতের ঘটনার পর প্রাথমিকভাবে ছয়টি এসি একসঙ্গে বিস্ফোরিত হওয়ার কথা বলা হলে পরে গ্যাস থেকে দুর্ঘটনা ঘটার কথা বলেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা।
ওই ঘটনায় গঠিত পাঁচটি দপ্তরের তদন্তের মধ্যে দিয়ে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসতে থাকে অনিয়ম ও গাফিলতির নানা তথ্য।
বায়তুস সালাত মসজিদের পূর্ব পাশে উত্তর-দক্ষিণমুখী একটি সড়ক পশ্চিম তল্লা থেকে রেললাইন পার হয়ে খানপুর পর্যন্ত চলে গেছে। ওই সড়ক থেকে মসজিদের উত্তরপাশ ঘেঁষে ছয় ফুট প্রশস্ত আরেকটি রাস্তা পশ্চিম দিকে সবুজবাগের দিকে গেছে। দুটি রাস্তাই কংক্রিট ঢালাই করা।
তল্লা পশ্চিমপাড়া থেকে খানপুরমুখী সড়কের মাঝামাঝি তিতাসের একটি সরবরাহ লাইন রয়েছে। সেই লাইন থেকে ৩ ইঞ্চি ব্যাসের আরেকটি লাইন মসজিদের উত্তরপাশ ঘেঁষে চলে গেছে সবুজবাগের দিকে। এই সংযোগ লাইনটি ১৯৯৮ সালে স্থাপন করা হয়।
দুর্ঘটনার পর মাটি খুঁড়ে ৩ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপে কোনো ছিদ্র পাননি তিতাস কর্মীরা। তবে উত্তর পাশে ওই লাইনের পাশে এক ইঞ্চির যে পরিত্যক্ত লাইন, তাতে ছয়টি ছিদ্র পাওয়া যায়।
এই লাইনটি মসজিদের ৪ নম্বর পিলার ঘেঁষা। পরিত্যক্ত ওই লাইনের ছিদ্র থেকেই মসজিদে গ্যাস জমে বিস্ফোরণ ঘটেছে তদন্ত সংশ্লিষ্টদের ধারণা।
তিতাসের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “তিন ইঞ্চি লাইন নির্মাণের পর গ্রাহকরা নিজ দায়িত্বে অবৈধভাবে স্থানীয় পন্থায় রাইজারগুলো শিফট করেছেন এবং নিয়ম বহির্ভূতভাবে বন্ড প্ল্যাগ স্থাপন করে গ্যাস প্রবাহ বন্ধ করেছেন।”
গ্রাহকরা ‘নিজস্ব উদ্যোগে’ তিতাস গ্যাসের নিয়মকানুন না মেনে লাইন স্থানান্তর করেছেন মন্তব্য করে তদন্ত কমিটির প্রধান বলেন, ওই ঘটনা তারা ঘটিয়েছেন ১৯৯৮ সালে।
“ওই রাইজার তারা মাটির নিচে দিয়ে দিয়েছে, এটা দৃশ্যমান ছিল না। এটা তারা নিচে রেখে দিয়েছে। মসজিদের পূর্বদিকে এক ইঞ্চির লাইন পেয়েছি, সেখানে কোনো লিকেজ পাই নাই। রাস্তার দিকের দুটি পরিত্যক্ত রাইজার থেকে একটাতে গ্যাসের লিকেজ পেয়েছি।”
“গ্যাসলাইন ছাড়িয়ে আরও ৪ ইঞ্চি গেছে ওই বেইজমেন্ট। আমাদের লাইন উপরে, তার নিচে বেইজমেন্ট।”
তিতাসের মহাব্যবস্থাপক ওহাব বলেন, “এই বেইজমেন্ট করার সময় তারা যে শাবল, কোদালসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেছে, তাতে গ্যাসের লাইনের মধ্যে ছয় জায়গায় তারা ক্ষতি করেছে। এতে পাইপ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং লিকেজ হয়ে গ্যাস বের হয়েছে।
“আমাদের লাইন বসেছে ১৯৯৬ সালে এবং মসজিদ করেছে ২০০০ সনের পরে। আমাদের লাইন আগে বসেছে এবং তারা এই কাজগুলো করার সময় আমাদের লাইন নষ্ট করেছে। এরপর লাইনে মরিচা হয়েছে এবং সে কারণে ছিদ্র হয়ে গ্যাসটা বের হয়েছে।”
ওহাব বলেন, ওই ঘটনার পর মসজিদ কমিটি যদি তিতাস কর্তৃপক্ষকে লিখিত বা মৌখিকভাবে জানাত যে, লাইনে ছিদ্র হয়েছে, তাহলে উৎস থেকে ওই লাইন বন্ধ করে দেওয়া সম্ভব হত।
“তাহলে ওই পরিত্যক্ত লাইনে আর গ্যাস থাকত না এবং এই ধরনের দুর্ঘটনাও ঘটত না। ছিদ্র হয়ে গ্যাস বের হওয়ার প্রধান যে উৎস, সেটা কিন্তু সৃষ্টি হয়েছে এই অবৈধভাবে রাইজার শিফট করার ফলে। সেটা ২০০০ সালের আগে।”
গ্যাস কীভাবে মসজিদের ভেতরে গেল?
আবদুল ওহাব সাংবাদিকদের বলেন, “গ্যাস পাইপ লাইন থেকে বের হয়ে গেলে জিরো প্রেসারের কোনো জায়গায় চলে যাবে। ওই গ্যাস কিন্তু রাস্তার ওপরে চলে আসতে পারে নাই। রাস্তার ওপরে চলে এলে মানুষ ও তিতাসের লোকজন জানতে পারত যে এখানে গ্যাস লিক হচ্ছে। কিন্তু গ্যাসটা রাস্তার ওপরে না এসে মসজিদের নিচে চলে গেছে।”
তিনি বলেন, যে নিয়মে পাকা ঘরবাড়ি বানাতে হয়, মসজিদও সেভাবেই করার কথা। ফ্লোরে যখন টাইলস লাগানো হয়, সেটা শক্ত ঢালাইয়ের ওপরই হওয়ার কথা। কিন্তু ওই মসজিদে তা হয়নি।
“মসজিদের ফ্লোরের তিন থেকে সাড়ে তিনফুট নিচে আমাদের পাইপ। কিন্তু টাইলস যেখানে লাগানো হয়েছে, সেখানে সিসি বা আরসিসি ঢালাই না থাকায় গ্যাসটা উপরের দিকে চলে আসতে পেরেছে এবং সেটা জড়ো হয়েছে মসজিদের এসি চেম্বারের ভেতরে।”
কীভাবে বিস্ফোরণ
মসজিদে বিদ্যুতের একটি অবৈধ সংযোগ পাওয়ার কথা জানিয়ে তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক বলেন, “গ্যাস একা একা জ্বলতে পারে না। তাকে জ্বালাতে হবে। আমরা মসজিদের ভেতরে মিটারবিহীন একটি অবৈধ সংযোগ পেয়েছি। বৈধ এবং অবৈধ সংযোগের ভেতরে একটি চেইঞ্জওভার দেওয়া আছে।
গ্যাস লিকেজের কথা জানানো হলেও তিতাসের পক্ষ থেকে লাইন সরানোর সাড়া মেলেনি- এমন অভিযোগ করেছেন মসজিদ কমিটি এবং স্থানীয় বাসিন্দারা।
এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে আবদুল ওহাব বলেন, গ্যাস লিকেজের বিষয়ে তিতাসকে মৌখিক বা লিখিতভাবে কিছু জানানোর তথ্য মসজিদ কমিটি দিতে পারেননি।
ওই কাজের জন্য তিতাসের কেউ অর্থ চেয়েছে- এমন অভিযোগের প্রমাণও তদন্ত কমিটি পায়নি বলে দাবি করেন ওহাব।
তিনি বলেন, ওই মসজিদ বানানোর ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশন, রাজউক বা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে কোনো অনুমোদন নেওয়ার কোনো প্রমাণ মসজিদ কমিটি দেখাতে পারেনি।
এক প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, “আমরা তিতাসের মাধ্যমে জানতে চেয়েছি যে, তাদের গ্যাস লিকেজের কারণে সেখানে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে কী না? তাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ এসেছে, সেটার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে উনাদের কমিটি যাচাই বছাই করে রিপোর্ট দিয়েছেন।”
এখন মন্ত্রণালয় যাচাই-বাছাই করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেবে জানিয়ে তিনি বলেন, “দায়-দায়িত্ব কেউ এড়াতে পারবে না। সেটা সংস্থা হোক, আর যেই হোক। আমি মনে করি যারা গ্রাহক, তারাও দায়-দায়িত্ব এড়াতে পারবেন না এবং আমাদের সংস্থার মধ্যে যদি গাফিলতি থাকে তারাও এড়াতে পারবে না। মন্ত্রণালয় সেটা ব্যবস্থা নেবে।”