ভীতু রাজা কবরে নিলেন মাটির সেনাবাহিনী

প্রাচীন চীনের অন্যতম সমৃদ্ধ শহর সি আন। কয়েক হাজার বছরের ইতিহাস এর। ঝৌ, সিন, হ্যান, সুই, থাং ইত্যাদি সব প্রধান রাজবংশের সময়েই সি আন গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান খান, চীনের লুঝৌ থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Oct 2017, 08:50 AM
Updated : 21 Oct 2017, 09:03 AM

জগদ্বিখ্যাত সিল্ক রোডের উৎপত্তি কিন্তু সি আন থেকেই, যেখান দিয়ে প্রাচীন পৃথিবীর পূর্ব ও পশ্চিমের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছিল। সি আন আধুনিক চীনের শানসি প্রদেশের রাজধানী।

বহুদিন ধরে ইচ্ছে ছিলো সি আন দেখার। সময়, সাধ্য কোনোটাই ঠিকমতো হচ্ছিলো না। ক্যান্সারের ওপর এক আন্তর্জাতিক সভায় যোগ দিতে সম্প্রতি সেখানে যেতে হয়েছিলো। সাথে সুযোগ এসে গেল এ ইতিহাস সমৃদ্ধ নগরীর পথে হাঁটার। গত লেখায়
নিয়ে কথা বলেছিলাম। আজ একটু ভিন্ন গল্প। ইতিহাসের আরো পেছনের দিকের কথা। 

প্রায় দু’হাজার তিনশ’ বছর আগে চীনের প্রথম সম্রাট সিন শি হুয়াং এর ছিল বিশাল সাম্রাজ্য। তিনি ছিলেন সিন রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। যুদ্ধবাজ ও সাম্রাজ্যবাদী। শত্রুপক্ষ তাকে কয়েকবার হত্যাচেষ্টাও চালায়। কিন্তু এ পরাক্রমশালী সম্রাটের মৃত্যুর পরের জীবন নিয়ে ভীতি ছিল।

মৃত্যুর পর কে তাকে ও তার সম্রাজ্য রক্ষা করবে, সেই চিন্তা থেকে তার সমাধি ঘিরে বিশাল এক টেরাকোটা বা পোড়ামাটির সেনাবাহিনীও সমাধিস্থ করা হয়। বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশকে একদল কৃষক সি আনের মাটির নিচে এ টেরাকোটা ওয়ারিওর বা মাটির যোদ্ধার খোঁজ পান, যা কিনা এক অনন্য প্রত্নতাত্বিক আবিষ্কার হিসেবে সমাদৃত।
সি আন এসে এ পোড়ামাটির সেনাবাহিনীর সঙ্গে দেখা করবো না, তাই কি হয়? গেলাম। ভ্রমাণার্থিদের জন্য বিশাল এলাকাজুড়ে জাদুঘর বানিয়ে রাখা হয়ছে। এ পর্যন্ত মোট তিনটি বড় পিট অর্থ্যাৎ গভীর কবর বা গহ্বরের সন্ধান পাওয়া গেছে। সেখানে রয়েছে আট হাজার সেনা,  পাঁচশ’ বিশটি ঘোড়া, একশ’ ত্রিশটি ঘোড়ার গাড়ি ও আরো দেড়শ’ যুদ্ধঘোড়ার পোড়ামাটি।
সেনাবাহিনীর বিভিন্ন পদমর্যাদা অনুসারে তাদের সারিবদ্ধ করা হয়েছে। পদমর্যাদা অনুসারে তাদের পোশাক-আশাক, কেশবিন্যাস ও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিভিন্ন ধরনের আসল অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। পোড়ামাটিগুলো আকার-আকৃতিতে জীবন্ত মানুষের সমান। কেউ যদি বিশ্বাস না করেন, তাদের জন্য সেনাবাহিনীর দুই অফিসারের কাঁধে হাত দিয়ে ছবি তুলে নিয়ে এসেছি কিছু ইউয়ান খরচ করে। অনতিদূরে সিন শি হুয়াং এর সমাধিও দেখা হলো।
সি আনের আরেক আশ্চর্য ঐতিহাসিক নিদর্শন হল সি আন দেয়াল। মিং রাজবংশের প্রথম সম্রাট ঝু ইউয়ানঝাং চতুর্দশ শতাব্দীতে সি আন শহর প্রতিরক্ষা দেয়াল নির্মান করেছিলেন। পরবর্তীতে পঞ্চদশ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে এবং ১৯৮৩ সালে এর সংস্কার করা হয়। এটি-ই বর্তমান ‘সি আন ওয়াল’ হিসেবে দেখা যায়।
প্রাচীনকালের সেই সিল্ক রোড যেখান থেকে শুরু হয়েছিল, সেখানেই সি আন দেয়ালের ফটক। সি আন দেয়ালের দৈর্ঘ্য ১৪ কিলোমিটার, দেয়ালঘেরা এলাকার আয়তন ৩৬ বর্গকিলোমিটার এবং এটাই মূলত শহরের প্রাণকেন্দ্র।

শহরের রাস্তা থেকে দেয়ালের উচ্চতা ১২ মিটার ও দেয়াল ১২-১৪ মিটার প্রশস্ত। মোট কথা সি আন দেয়াল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও চীনা স্থাপত্যশৈলীর অনন্য এক নিদর্শন।

এছাড়া অনন্য স্থাপত্যশৈলীর বেল টাওয়ার, ড্রাম টাওয়ার কিংবা জায়ান্ট ওয়াইল্ড গুজ প্যাগোডা বা তা ইয়ান থা ভ্রমণার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেই।
তবে সি আনের ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে হলে যেতে হবে শানসি ইতিহাস জাদুঘরে। অতি প্রাচীনকাল, লৌহযুগ, ব্রোঞ্জযুগ, এরপরের মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগ- সময় অনুসারে জাদুঘর সাজিয়ে রাখা হয়েছে। ৩-৪ ঘণ্টা সময় নিয়ে জাদুঘর ঘুরলে শুধু সি আন নয়, যেন পুরো চীনের ইতিহাস থেকেই ঘুরে আসা যায়।
মাত্র তিনদিনের সফর ছিল সি আনে। আমাদের সভার ফাঁকে যতটুকু ঘুরে দেখা যায়, সি আনকে  দেখেছি। ইতিহাস ঐতিহ্যের এ শহর মুগ্ধ করেছে প্রতি পদক্ষেপে।

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি

ইমেইলঃ  asadkhanbmj@yahoo.com

এই লেখকের আরও লেখা