চীনে বর্ষাবিলাস ও বরফবিলাস

বর্ষার সাথে আমাদের জীবন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পৃথিবীর অনেক দেশেই বর্ষাকাল বলে আলাদা কোন ঋতু নেই। যদিও টানা বর্ষা অনেক সময় জনজীবন বিপর্যস্ত করে, তবুও এই বর্ষাঋতুর জন্যই বাংলাদেশ এত সবুজ আর সুফলা।

মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান খান, চীনের লুঝৌ থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Feb 2017, 06:06 AM
Updated : 26 Feb 2017, 06:06 AM

প্রকৃতিগত ব্যাপার ছাড়াও আমাদের মন-মানসে বর্ষার ব্যাপক প্রভাব। বাংলা সাহিত্য এবং সংস্কৃতি বর্ষার ‘রোমান্টিসিজমে’ ভরপুর। কবি সাহিত্যিকদের কথা বাদ, আমাদের মত আমজনতার মনেও বর্ষার ব্যাপক প্রভাব। 

সেই ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে। যেই না বৃষ্টির ফোটা পড়া শুরু, অমনি বাইরে ভোঁ-দৌড়। কখনও বাড়ির উঠানে, কখনও মাঠে, কখনও একা, কখনও বন্ধুদের সাথে। বৃষ্টি কাদার মধ্যে যারা ফুটবল না খেলেছে, তাদের কখনোই বোঝানো যাবে না সেই আনন্দ। কিংবা জ্যৈষ্ঠের শেষের কোন এক বর্ষায় ভিজে ভিজে ভাইবোনদের সাথে বাড়ির আঙ্গিনার কোণের গাছের আম কুড়ানোর প্রতিযোগিতা (আমার নিজের এক ছোট বোন ছিল আর দুই চাচাত ভাই বোন, আরও জুটত প্রতিবেশীয় ভাই-বোন)।

বাড়ির পাশে খাল ছিল, আর বেশ কয়কটা পুকুর। বৃষ্টি উপভোগের আমাদের আরেক উপায় ছিল এই খাল কিংবা পুকুরে ডুব দিয়ে পানিতে বৃষ্টির ফোঁটার শব্দ শোনা। মনে হত খই ফুটছে যেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বৃষ্টিতে ভিজে, কাদা মেখে যখন ফিরতাম, আম্মা’র বকুনি আর মাঝে মাঝে কিছু ধোলাই কপালে জুটতই। কলের পাড়ে নিয়ে বেশ একখানা ঘষামাজা চলত।

তবে হ্যা, মাঝে মধ্যে আম্মাকেও নামিয়ে আনতাম বাড়ির উঠানে বৃষ্টিতে ভিজতে। আর ঘরের মধ্যে বর্ষা উপভোগ ছিল মুড়ি-চানাচুর কিংবা খিচুড়ি-ইলিশ মাছ দিয়ে (আমাদের সে যুগে গ্রামে-গঞ্জে ইলিশ খুব সস্তা আর প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত), কিংবা বাড়ির সবাই মিলে লুডুর ছক্কা নিয়ে। 

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যখন বাড়িতে যেতাম, ছোট বোন অপেক্ষায় থাকত ভাইয়ার সাথে বৃষ্টিতে ভিজবে। কারণ অন্য সময়ে আব্বা-আম্মার বকুনি হজম করতে হত। ভাইয়ার সাথে মাফ।

এখন যখন আমার ছেলে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে, তারও বৃষ্টিতে ভেজার শখ বাড়ছে। ঝুম বৃষ্টি নামার সাথে সাথেই বলে- বাবা চলো, বৃষ্টিতে গোসল করি।

আমি আর কী করি! বাড়ির উঠানে ফুটবল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ছেলেকে সাথে নিয়ে শৈশব ফিরিয়ে আনি। কখনও আবার তার দাদা-দাদু বা মা খুব বেশি বারণ করলে বলে- ‘বাবা চলো, রেইনকোট গায়ে দিয়ে বৃষ্টি দেখে আসি।’ হা হা হা! 

ক’বছর আগে যখন চীনে চলে আসলাম, জীবন থেকে যেন বৃষ্টি উপভোগ হারিয়ে গেল। চাংশা শহরের গ্রীষ্মকাল বড়ই শুষ্ক আর কাঠখোট্টা। দিনের পর দিন মাসের পর মাস বৃষ্টির দেখা নেই। এখানে বৃষ্টি হয় শীতের দিনে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা আর বাতাসের মাঝে সে বৃষ্টি উপভোগের কথা ভাবাও দুষ্কর।

কালেভদ্রে গরমের দুই-এক দিনে বৃষ্টি হলেও চীনারা এই বৃষ্টিতে ভিজতে অনিচ্ছুক। আমাদের গ্রামের বাড়ির টিনের চালার উপরে বৃষ্টি শব্দ খুব ভালো লাগত। কিন্তু এই ইট-পাথরের শহরে সেই টিনের চালা আর কোথায় পাবো! তবে হ্যা, জানালার বাইরের শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের উপর ছোট একখানা টিনের টুকরা রেখে দিলে বেশ সুন্দর ঝনঝন শব্দ শোনা যেত। 

তাহোক, দেশ ছেড়ে বিদেশে এসেছি। এখানে বৃষ্টি নয়, বরফ বা তুষার উপভোগ করব। শুনেছি চাংশাতে তুষারপাত হয়, তবে খুবই কম। সাধারণত চীনের উত্তর এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শহরগুলোতে ভারী তুষারপাত হয়।

প্রথম বছরে শীতের শুরু থেকেই অপেক্ষা করছি তুষারপাতের জন্য। আসি আসি করেও আসে না। ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে কোন কোন দিন তাপমাত্রা শুন্যের চেয়ে দুই-তিন ডিগ্রি নেমেও যায়। গাছের পাতায় জমে থাকা বৃষ্টির পানি বরফকুচি হয়ে ঝুলে থাকে, কিন্তু তুষারপাত আর হয় না।  

অবশেষে একদিন ঊষালগ্নে ঘর থেকে বেড়িয়ে ব্যালকনিতে এসে দেখি শুভ্র পরিবেশ। বৃষ্টি নেই। ঝিরিঝিরি লবণের মত কিছু একটা পড়ছে। কাচের জানালা দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখি জমিন সাদা হয়ে গেছে! জীবনের প্রথম তুষারপাত (স্নো-ফল)!

নতুন আসা বাংলাদেশি যারা ছিল, তাদের ফোন দিয়ে উঠালাম। কিছুক্ষণ পরে বেরিয়ে এলাম বরফ দেখতে। তবে সেবার তুষারপাত তেমন জমেনি। পরের বছর মন ভরিয়ে দিয়েছিল। প্রায় পুরো জানুয়ারি মাস চাংশা ছিল বরফাচ্ছাদিত। আমরা বড় বড় জুতা পরে প্রায় এক ফুট পুরু হয়ে যাওয়া বরফের মধ্যে পা ডুবিয়ে হাঁটতাম। শিশুদের মত বরফের দলা নিয়ে ছোড়াছুড়ি করতাম।

নদীর পাড়, কমলা দ্বীপ, ইউয়েলু পাহাড়- সব শুভ্র সৌন্দর্যে ঢাকা পড়ে যেত। রোদ ঝলমলে কোন এক তুষার ঢাকা দিনের সৌন্দর্য ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। সূর্যের সোনালী কিংবা রুপালী আলো শুভ্র জমিনে প্রতিফলিত হয়ে এক চোখ ধাঁধানো রূপের সৃষ্টি করে।

আমাদের ছেলের বয়স যখন ছয় মাস, সে প্রথম তুষারপাত দেখে। আমরা ওকে খুব করে ঢেকেঢুকে বাইরে বেরোতাম একপ্রকার লুকিয়ে। কারণ আমাদের ‘ডরমিটরি’র সেবিকারা (আমরা চীনা ভাষায় ‘আয়ি’ ডাকতাম) ছেলের মাকে বকা দিত এত ছোট বাচ্চা এই ঠাণ্ডায় বাইরে বের করছি বলে (এই আয়িদের আমার ছেলের প্রতি পরম মমতার কথা কোনদিনই ভোলা যাবে না)।

আমরা কি তাদের কথা শুনতাম? ঠিক বের হয়ে যেতাম। পরের বছর সে যখন একটু বড় হল, তুষারপাতের সময়ে তার আনন্দ কে দেখে! দৌড়ালে পায়ের ছাপ পড়ে, কাদার মত হাতে নিয়ে খেলা যায় কিন্তু ময়লা লাগে না, হাতে নিয়ে দলা পাকিয়ে অন্যের দিকে ছুড়ে মারা যায়- ইত্যাদি সবই তার কাছে অতি আনন্দের ব্যাপার। 

যখন লুঝৌ শহরে আসলাম, তুষারপাতের সাথেও আড়ি হয়ে গেল। এখানে শীতে তুষারপাত হয় না। তাপমত্রা ২-৮ ডিগ্রির মাঝামাঝি ঘোরাফেরা করে। কখনও অবশ্য শুন্যেও নেমে আসে। কয়েক দশক পরে গত বছর কিছু সময়ের জন্য এখানে তুষারপাত হয়েছিল। তবে এখানে বৃষ্টি হয় বেশ। শীত কিংবা গ্রীষ্ম, সব সময়েই।

আমার বাসার জানালার সামনে পাহাড়ের ঢালে একটু নিচে বেশ ক’খানা ঘর আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু কর্মচারী এখানে থাকে। সে ঘরগুলোর ছাদে টালি কিংবা টিন। বর্ষা মুখরিত সন্ধ্যায় সেখানে পরিবারের সবার কোলাহল মুখরিত আনন্দিত ক্ষণের আভাস পাওয়া যায়। টিনের চালায় টুপটাপ কিংবা ঝনঝন শব্দ মনকে কোন সুদূর অতীতে নিয়ে যায়!

বর্ষা মুখরিত শীতের রাতে একখানা ছাতা নিয়ে কিংবা কখনও গায়ে একটা বর্ষাতি চাপিয়ে রাস্তায় হাঁটতে বের হই। একা, নিস্তব্ধ রাতে শুনশান ক্যাম্পাসে বর্ষার ফোঁটা মন কেমন যেন করিয়ে দেয়। আহা!

আবার কবে সেই গ্রামের কাদামাখা মেঠো পথে ছেলেটার হাত ধরে বৃষ্টি দেখতে বের হবো, অথবা ছোট নৌকা নিয়ে কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়াবো ভরা জয়ন্তীর বুকে। কিংবা কোন এক বর্ষণমুখর রাতে টিনের চালায় ঝনঝন শব্দ শুনতে শুনতে প্রিয়জনদের সাথে নিয়ে আগামীর স্বপ্ন বুনব ভারী হয়ে যাওয়া চোখের পাতায়।  

লেখক পরিচিত:  প্রবাসী বাংলাদেশি

এই লেখকের আরও লেখা