প্রকৃতিগত ব্যাপার ছাড়াও আমাদের মন-মানসে বর্ষার ব্যাপক প্রভাব। বাংলা সাহিত্য এবং সংস্কৃতি বর্ষার ‘রোমান্টিসিজমে’ ভরপুর। কবি সাহিত্যিকদের কথা বাদ, আমাদের মত আমজনতার মনেও বর্ষার ব্যাপক প্রভাব।
বাড়ির পাশে খাল ছিল, আর বেশ কয়কটা পুকুর। বৃষ্টি উপভোগের আমাদের আরেক উপায় ছিল এই খাল কিংবা পুকুরে ডুব দিয়ে পানিতে বৃষ্টির ফোঁটার শব্দ শোনা। মনে হত খই ফুটছে যেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বৃষ্টিতে ভিজে, কাদা মেখে যখন ফিরতাম, আম্মা’র বকুনি আর মাঝে মাঝে কিছু ধোলাই কপালে জুটতই। কলের পাড়ে নিয়ে বেশ একখানা ঘষামাজা চলত।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যখন বাড়িতে যেতাম, ছোট বোন অপেক্ষায় থাকত ভাইয়ার সাথে বৃষ্টিতে ভিজবে। কারণ অন্য সময়ে আব্বা-আম্মার বকুনি হজম করতে হত। ভাইয়ার সাথে মাফ।
এখন যখন আমার ছেলে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে, তারও বৃষ্টিতে ভেজার শখ বাড়ছে। ঝুম বৃষ্টি নামার সাথে সাথেই বলে- বাবা চলো, বৃষ্টিতে গোসল করি।
ক’বছর আগে যখন চীনে চলে আসলাম, জীবন থেকে যেন বৃষ্টি উপভোগ হারিয়ে গেল। চাংশা শহরের গ্রীষ্মকাল বড়ই শুষ্ক আর কাঠখোট্টা। দিনের পর দিন মাসের পর মাস বৃষ্টির দেখা নেই। এখানে বৃষ্টি হয় শীতের দিনে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা আর বাতাসের মাঝে সে বৃষ্টি উপভোগের কথা ভাবাও দুষ্কর।
কালেভদ্রে গরমের দুই-এক দিনে বৃষ্টি হলেও চীনারা এই বৃষ্টিতে ভিজতে অনিচ্ছুক। আমাদের গ্রামের বাড়ির টিনের চালার উপরে বৃষ্টি শব্দ খুব ভালো লাগত। কিন্তু এই ইট-পাথরের শহরে সেই টিনের চালা আর কোথায় পাবো! তবে হ্যা, জানালার বাইরের শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের উপর ছোট একখানা টিনের টুকরা রেখে দিলে বেশ সুন্দর ঝনঝন শব্দ শোনা যেত।
তাহোক, দেশ ছেড়ে বিদেশে এসেছি। এখানে বৃষ্টি নয়, বরফ বা তুষার উপভোগ করব। শুনেছি চাংশাতে তুষারপাত হয়, তবে খুবই কম। সাধারণত চীনের উত্তর এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শহরগুলোতে ভারী তুষারপাত হয়।
অবশেষে একদিন ঊষালগ্নে ঘর থেকে বেড়িয়ে ব্যালকনিতে এসে দেখি শুভ্র পরিবেশ। বৃষ্টি নেই। ঝিরিঝিরি লবণের মত কিছু একটা পড়ছে। কাচের জানালা দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখি জমিন সাদা হয়ে গেছে! জীবনের প্রথম তুষারপাত (স্নো-ফল)!
নতুন আসা বাংলাদেশি যারা ছিল, তাদের ফোন দিয়ে উঠালাম। কিছুক্ষণ পরে বেরিয়ে এলাম বরফ দেখতে। তবে সেবার তুষারপাত তেমন জমেনি। পরের বছর মন ভরিয়ে দিয়েছিল। প্রায় পুরো জানুয়ারি মাস চাংশা ছিল বরফাচ্ছাদিত। আমরা বড় বড় জুতা পরে প্রায় এক ফুট পুরু হয়ে যাওয়া বরফের মধ্যে পা ডুবিয়ে হাঁটতাম। শিশুদের মত বরফের দলা নিয়ে ছোড়াছুড়ি করতাম।
নদীর পাড়, কমলা দ্বীপ, ইউয়েলু পাহাড়- সব শুভ্র সৌন্দর্যে ঢাকা পড়ে যেত। রোদ ঝলমলে কোন এক তুষার ঢাকা দিনের সৌন্দর্য ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। সূর্যের সোনালী কিংবা রুপালী আলো শুভ্র জমিনে প্রতিফলিত হয়ে এক চোখ ধাঁধানো রূপের সৃষ্টি করে।
আমাদের ছেলের বয়স যখন ছয় মাস, সে প্রথম তুষারপাত দেখে। আমরা ওকে খুব করে ঢেকেঢুকে বাইরে বেরোতাম একপ্রকার লুকিয়ে। কারণ আমাদের ‘ডরমিটরি’র সেবিকারা (আমরা চীনা ভাষায় ‘আয়ি’ ডাকতাম) ছেলের মাকে বকা দিত এত ছোট বাচ্চা এই ঠাণ্ডায় বাইরে বের করছি বলে (এই আয়িদের আমার ছেলের প্রতি পরম মমতার কথা কোনদিনই ভোলা যাবে না)।
যখন লুঝৌ শহরে আসলাম, তুষারপাতের সাথেও আড়ি হয়ে গেল। এখানে শীতে তুষারপাত হয় না। তাপমত্রা ২-৮ ডিগ্রির মাঝামাঝি ঘোরাফেরা করে। কখনও অবশ্য শুন্যেও নেমে আসে। কয়েক দশক পরে গত বছর কিছু সময়ের জন্য এখানে তুষারপাত হয়েছিল। তবে এখানে বৃষ্টি হয় বেশ। শীত কিংবা গ্রীষ্ম, সব সময়েই।
আমার বাসার জানালার সামনে পাহাড়ের ঢালে একটু নিচে বেশ ক’খানা ঘর আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু কর্মচারী এখানে থাকে। সে ঘরগুলোর ছাদে টালি কিংবা টিন। বর্ষা মুখরিত সন্ধ্যায় সেখানে পরিবারের সবার কোলাহল মুখরিত আনন্দিত ক্ষণের আভাস পাওয়া যায়। টিনের চালায় টুপটাপ কিংবা ঝনঝন শব্দ মনকে কোন সুদূর অতীতে নিয়ে যায়!
আবার কবে সেই গ্রামের কাদামাখা মেঠো পথে ছেলেটার হাত ধরে বৃষ্টি দেখতে বের হবো, অথবা ছোট নৌকা নিয়ে কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়াবো ভরা জয়ন্তীর বুকে। কিংবা কোন এক বর্ষণমুখর রাতে টিনের চালায় ঝনঝন শব্দ শুনতে শুনতে প্রিয়জনদের সাথে নিয়ে আগামীর স্বপ্ন বুনব ভারী হয়ে যাওয়া চোখের পাতায়।
লেখক পরিচিত: প্রবাসী বাংলাদেশি
এই লেখকের আরও লেখা