মেঘের স্তর পেরিয়ে বিমান মর্ত্যের একেবারে কাছাকাছি নেমে এলো। ইয়াংজে নদীর উপর শেষ পাক ঘুরে ভূমি স্পর্শ করল বিমান। মাটিতে নেমে আসতেই অদ্ভুত এক শিহরণ কাজ করল।
আহা লুঝৌ! প্রিয় সবুজ শহর। আমার দ্বিতীয় বাড়ির মত। কতদিন পর, দেড় বছর তো হবেই!
এখানকার বিমানবন্দর খুব ছোট। বিমান থেকে নেমে হেঁটে হেঁটে একটা মাত্র গেইট দিয়ে সোজা বের হয়ে আসা যায়। আমি এসেছি 'সাউথওয়েস্ট মেডিকেল ইউনিভার্সিটি'তে কিছু গবেষণার কাজে।
একসময় এখানেই কাজ করতাম। তখন অবশ্য এর নাম ছিল 'লুঝৌ মেডিকেল কলেজ'। বেরিয়েই দেখি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একজনকে পাঠানো হয়েছে আমাকে নিয়ে যেতে। সেই সাথে আরও দুই বাংলাদেশি মুখ দেখা গেল- জুলফিকার আর দিদার। ওরা একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।
'লুঝৌ' সিচুয়ান প্রদেশের দক্ষিণ দিকের শহর। তেমন বিখ্যাত নয়। এমনকি চীনেরও কেউ কেউ এই শহরের নাম জানে না। চার-পাঁচ বছর আগে যখন এখানে আসা স্থির করি, অনেকেই অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করত, এ আবার কোন জায়গা!
মনে আছে, একবার আমেরিকায় এক কনফারেন্সে এক চীনা অধ্যাপকের সাথে দেখা হয়েছিল। আমি তার দেশে কাজ করি শুনে বেশ আগ্রহী হয়েছিলেন। হাসতে হাসতে বলেছিলেন, "লুঝৌ লাওজিয়াও-এর কথা জানতাম, কিন্তু 'লুঝৌ' নামে যে আমাদের দেশে কোন শহর আছে, জানতাম না।"
বিখ্যাত ইয়াংজে নদী আর থুও নদীর সঙ্গমস্থলে গড়ে উঠেছে এই শহর। এককালে নদীপথে বাণিজ্যের সময়কালে এই শহর খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তবে সে অনেক দিন আগের কথা।
'সাউথওয়েস্ট মেডিকেল ইউনিভার্সিটি'র দু’টো ক্যাম্পাস। আমি যেখানে কাজ করছি, সেটা পুরাতন লুঝৌতে। ছোট পাহাড়ের ওপর। সবুজ বনানীতে ঢাকা। গবেষণা কেন্দ্র, গ্রন্থাগার, শ্রেণিকক্ষ, হাসপাতাল ইত্যাদি সব এখানে-ওখানে পাহাড়ের উপরে। বেশিরভাগ আবাসিক ভবনগুলোও পাহাড়ের গায়ে।
শহরের ঠিক কেন্দ্রে আছে 'জোংশান পার্ক’। সমতলভূমি থেকে পাহাড়ে উঠে যাওয়া পার্কে আছে বেশ কয়েকটা ছোট হ্রদ। নানা রঙের মাছেরা সেখানে খেলা করে। সেই সাথে আছে নানা জাতের গাছ, শ্রাব, গুল্ম।
সেই বহুকাল আগে যখন ‘লুঝৌ মেডিকেল কলেজ’ গড়ে উঠেছিল, এই পার্ক (তখন অবশ্য পার্ক হিসেবে ছিল না) ছিল বিভিন্ন ঔষধি গাছের বড় যোগানদাতা। 'জোংশান পার্ক' ছাড়া শহরে আরও বেশ ক'টি পার্ক আছে। সবগুলোই আলাদা বৈশিষ্ট্যে সুন্দর।
মূল লুঝৌ শহর থেকে খানিক দূরে ইয়াংজে নদীর ওপারে আছে 'লঙ্গান ফরেস্ট'। বিশাল এলাকা জুড়ে এই বন। ছুটির দিনগুলোতে লুঝৌ এবং এর আশপাশ থেকে অনেকেই গিয়ে এখানে কাটিয়ে আসেন। পরিবার নিয়ে গেলে একদিনে সবটা ঘুরে বেড়ানোর সময় পাওয়াই দায়।
এখানে আছে কয়েকশ’ বছরের পুরোনো লঙ্গান গাছ এবং সেইসাথে আরও বিভিন্ন ধরনের গাছ-গাছড়া। (লঙ্গান লিচুর মত এক ধরনের ফল, চীনসহ অনেক দেশেই এর দেখা মেলে। তবে ইয়াংজে নদীর অববাহিকার লঙ্গান সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত)। বনের মধ্যে বেশ কয়েকটি ছোট ছোট হ্রদ আর পাহাড় আছে। পাহাড়ী বনের মধ্য দিয়ে হাঁটাচলার জন্য আছে বেশ কয়েক কিলোমিটার লম্বা কাঠের হাঁটাপথ। আছে দু-তিনটা 'ওয়াচ টাওয়ার', যেখান থেকে দূরের লুঝৌ শহর আর বহুদূর পর্যন্ত ইয়াংজে নদীর বাঁক দেখা যায়।
লুঝৌ শহরের থেকে একটু দূরে (পাহাড়ি পথে ঘণ্টাখানেকের বাস রাস্তা) আছে 'ফাংশান'। বৌদ্ধদের একটা পবিত্র পাহাড়। তবে প্রকৃতি প্রেমিকদের জন্য চমৎকার এক জায়গা। শান্ত-নিস্তব্ধ পাহাড়ের চূড়ার দিকে মেঘেরা খেলা করে। প্রকৃতি সেখানে বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন সৌন্দর্যের ডালি সাজিয়ে বসে।
লুঝৌ শহরে খুব সুন্দর এবং বেশ বড়সড় একটা মসজিদ আছে। সেই সাথে আছে বেশ কিছু হালাল খাবারের দোকান। 'সাউথওয়েস্ট মেডিকেল ইউনিভার্সিটি'তে ২৫-৩০ জন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। এদের অধিকাংশই বেশ বন্ধুসুলভ। আমার লুঝৌ জীবনের অনেক সুন্দর মুহুর্তের সাথে এদের অনেকেই জড়িত।
'সাউথওয়েস্ট মেডিকেল ইউনিভার্সিটি'র পুরাতন ক্যাম্পাসের মূল গবেষণাকেন্দ্রটি পাহাড়ের একেবারে উপরে এবং নয় তলা ভবন। বহুদূর থেকে দেখা যায় এর মাথা। নয় তলায় উঠলে এখান থেকেও বহুদূর পর্যন্ত দেখা যায়।
আমি মাঝে মাঝেই উপরে উঠি। বিশেষ করে গোধূলী লগনে। সবুজ বনানির ওপর দিয়ে থুও নদীর ওপারে অস্ত যাওয়া সূর্যের লালিমা আমাকে প্রিয় জন্মভূমির কথা মনে করিয়ে দেয়। আর বড্ড আবেগি করে তোলে।
লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি
মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান খানের আরও লেখা
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ, আড্ডা, আনন্দ বেদনার গল্প, ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |