'ওরা তো আমেরিকার সাথে যুদ্ধ করে জিতেছে'

ভিয়েতনামে আসা যেদিন নিশ্চিত হল, আত্মীয়-স্বজন-বন্ধুবান্ধব অনেকেরই প্রথম কথা ছিল, 'ওরা তো যুদ্ধ করে জিতেছে, আমেরিকার সাথে, তাই না !'

মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান খান, ভিয়েতনামের হো চি মিন সিটি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Nov 2016, 12:59 PM
Updated : 8 Nov 2016, 01:56 PM

হ্যা, অনেকেরই 'ভিয়েতনাম' শব্দের সাথে সবার আগে 'আমেরিকা' আর 'যুদ্ধ' এই দুটি শব্দই মনে আসে। কী জানি, আমেরিকা আমার কাছে খুবই দুর্বোধ্য।

গত এক-দেড়শ বছরে শিল্প-বিজ্ঞানের উন্নতিতে আমেরিকা সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখে মানবকল্যাণে অভূতপূর্ব নজির স্থাপন করেছে। তারাই আবার ইতিহাসের ভয়াবহ সব যুদ্ধের কারিগর!

গত শতাব্দীর প্রথমভাগে দুটো বিশ্বযুদ্ধ, তারপরে ভিয়েতনাম যুদ্ধ, শেষ বেলায় উপসাগরীয় যুদ্ধ। আর সাম্প্রতিক কালের ইরাক যুদ্ধ, আফগানিস্থান যুদ্ধ এবং সিরিয়া যুদ্ধ - কোথায় তারা নেই?

গত শতাব্দীর মধ্যভাগের পর থেকে শুরু হওয়া দুই দশক ধরে চলমান এই যুদ্ধ ছিল মূলত উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনামের মধ্যে, যেখানে আমেরিকা দক্ষিণ ভিয়েতনামের পক্ষে যুদ্ধে নামে। আর চীন, রাশিয়া উত্তর ভিয়েতনামের পক্ষে।

সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে দক্ষিণ ভিয়েতনামের রাজধানী সাইগন (বর্তমান হো চি মিন শহর) -এর পতনের মাধ্যমে উত্তর আর দক্ষিণ ভিয়েতনাম একীভূত হয় যুদ্ধের পরিসমাপ্তির মাধ্যমে।

যাহোক, যুদ্ধের ইতিহাস বলা আমার কাজ নয়, বরং তা করতে গেলে অনেক ভুলভাল বলে ফেলব (কারণ এ বিষয়ে আমার জ্ঞান নগন্য)। আমি বরং কতটুকু স্মৃতির সন্ধান পেলাম, তাই বলি।

বিগত দিনের ইতিহাস দেখতে (জানতে) হলে জাদুঘরের বিকল্প নেই। গেলাম 'ওয়্যার রেমন্যান্টস মিউজিয়াম'-এ। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম আলোচিত যুদ্ধের স্মৃতি ধরে রাখতে তৈরি করা হয়েছে এই মিউজিয়াম।

তিন তলা ভবনের নীচতলায় যুদ্ধে ভিয়েতনামের পক্ষে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সমর্থনের দলিল। খুব যত্নে সাজিয়ে রাখা হয়েছে বিপদের দিনে হাত বাড়িয়ে দেয়া প্রকৃত বন্ধুদের ছবি। দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় যুদ্ধের ভয়াবহতার ছবি। বড় নির্মমতা আর বীভৎসতার সাক্ষ্য বহনকারী সেই সব ছবি!

ভয়াবহ এই যুদ্ধে শুধু কয়েক লাখ মানুষই মারা যায়নি, রাসায়নিক অস্ত্রের বিষাক্ততায় পঙ্গু ও বিকলাঙ্গ হয়ে জন্ম নিয়েছে আরও কয়েক লাখ মানুষ! ধ্বংসের সাক্ষ্য বহন করে বিস্ফোরণে পুড়ে যাওয়া বিস্তীর্ণ শস্যভূমি আর ধ্বংস হয়ে যাওয়া বিশাল 'ম্যানগ্রোভ' বন।

দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় আরও সাজিয়ে রাখা হয়েছে আমেরিকান বাহিনীর ফেলে যাওয়া অস্ত্র-গোলাবারুদ। কি নেই সেখানে? পিস্তল, বন্দুক, বুলেট, ভারী মেশিনগান, মাইন, মর্টার, রকেট লঞ্চার, কামান, আরও কত কত 'তৎকালীন যুগের আধুনিক' অস্ত্রশস্ত্র! ভবনের সামনের প্রাঙ্গণেও রাখা আছে সারি সারি আমেরিকান বাহিনীর পরিত্যাক্ত যুদ্ধবিমান আর ট্যাঙ্ক।

দেখতে দেখতে মন বেশ বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। পরবর্তীতে এক ধরনের ভালো লাগা আর শ্রদ্ধা অনুভব করলাম। ভিয়েতনামিজরা এই যুদ্ধের স্মৃতি ধরে রেখেছে। শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করে সততা আর পরিশ্রম দিয়ে গড়া আজকের আধুনিক ভিয়েতনাম অনেক সমৃদ্ধ।

যুদ্ধে কিংবা যুদ্ধের প্রভাবে যারা বিকলাঙ্গ হয়েছে, তাদের জন্য ভিয়েতনাম সরকার করেছে 'হ্যান্ডিক্যাপড হ্যান্ডিক্র্যাপ্টস ফ্যাক্টরি'। গেলাম সেখানে। কত মানুষের বেঁচে থাকার উপায় তৈরি হয়েছে এই ফ্যাক্টরির মাধ্যমে ! আর কি তাদের কারুকাজ !  এত চমৎকার সব তৈজসপত্র, গৃহ-অলঙ্কার, ছবি- দেখলেই সংগ্রহের ইচ্ছা জাগে। কিন্তু আমি তৃতীয় বিশ্ব থেকে আসা দরিদ্র শ্রমিক মাত্র; সাধ থাকলেও সাধ্যে কুলালো না। 

'ওয়্যার রেমন্যান্টস মিউজিয়াম' এর পাশেই 'ইন্ডিপেন্ডেন্ট প্যালেস'। আমেরিকানরা এটাকে তাদের 'পার্লামেন্ট হাউস' এর মত ব্যবহার করত। প্রেসিডেন্ট সাহেব এলে তার থাকার ব্যবস্থাও এখানেই ছিল। বিশাল আকারের সব হলরুম, মিলনায়তন, ব্যবহার্য হেলিকপ্টার, জিপ, গাড়ি ইত্যাদির দেখা মিলল প্রাসাদে।

সামনে উদ্যানের পাশে দুটো ট্যাঙ্ক রাখা; একটা চীনের, আরেকটা সোভিয়েতের। শেষবারে এই ট্যাঙ্ক দুটোর হামলার মাধ্যমেই নাকি প্যালেস তথা আমেরিকান বাহিনীর পতন ঘটে দক্ষিণ ভিয়েতনামে। তৎকালীন ইন্দোচীনের অন্যতম বড়, সুদৃশ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ এই ভবন দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে যথাযথ গৌরব নিয়ে।

পণ্ডিতেরা বলে থাকেন, "যুদ্ধ এমন এক খেলা, যেখানে বিজয়ী আর বিজিত- দুই পক্ষই হেরে যায়।"

ভিয়েতনাম যুদ্ধের কিছু নিদর্শন দেখতে দেখতে বারবার মন থেকে প্রার্থনা আসছিল, "হে বিশ্বজগতের প্রভু, এই মরণ খেলা থেকে পৃথিবীর যুদ্ধবাজ নেতাদের তুমি নিরস্ত করো।"

লেখকের কথা

আমি লেখক নই। সাহিত্যজ্ঞানও শূন্যের কোটায়। বিজ্ঞানের ছাত্র। বৈচিত্র্যময় জীবনের নানা বাঁকের ছোট ছোট টুকরো কিছু ঘটনা মাঝে মাঝে দিনপঞ্জিতে লিখি, এই আর কি। পড়াশোনা এবং জীবিকার তাগিদে বেশ কিছুদিন ধরেই প্রবাসে। এই মুহূর্তে আছি ভিয়েতনামের হো চি মিনে। আমার অতি সাধারণ প্রবাস জীবনের সাধারণ কিছু টুকরো অভিজ্ঞতা, সাধারণ কিছু কথা বলার জন্যই এখানে লেখা।