ভিয়েতনামের দিনলিপি: শুরুর দিনগুলো

প্রতিবার বিদেশ যাওয়া-আসার সময় নয়া কাকাই বিমানবন্দরে আসেন। এবার তিনি নেই। ওপার থেকে কি এপারে দেখার সুযোগ আছে! তিনি কী আমাকে হাত নেড়ে হাসিমুখে বিদায় দিলেন?

মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান খান, ভিয়েতনামের হো চি মিন সিটি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Oct 2016, 11:17 AM
Updated : 28 Oct 2016, 11:37 AM

তিনি আমার জন্য কী ছিলেন, তা কাউকেই বোঝাতে পারবো না। বিমানবন্দরে দুই চাচাতো ভাই এলো সাথে; বেশ রাতে ফ্লাইট। ওদের যাতে ফিরতে রাত না হয় সে কথা ভেবেই একটু আগে-ভাগেই চলে এলাম। 

এই প্রথম 'মালিন্দো' এয়ারলাইন্সে যাত্রা। গন্তব্য ভিয়েতনামের 'হো চি মিন' শহর, ওখানেই কর্মস্থল। মালয়েশিয়াতে (কুয়ালালামপুর) সংযোগ-বিমান; দেড়ঘণ্টার যাত্রাবিরতি। মনে একটু খচ খচ করছিল। দেড় ঘণ্টা যথেষ্ট তো, নাকি 'কানেক্টিং ফ্লাইট' ধরতে পারব না! 'মরার উপর খাড়ার ঘা' র মত বিমান দুই ঘণ্টার জন্য বিলম্বিত!

ঢাকা থেকে কুয়ালালামপুর যাত্রাটা মোটেও ভাল হল না। তিন সিটের ঠিক মাঝখানে বসা, নির্ঘুম রাতের শেষ অংশের ক্লান্তি, তার চেয়েও বেশি খারাপ লাগছিলো বিমানের বিলম্ব হওয়ার ব্যাপারটি।  

স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ৯টায় আমার হো চি মিন পৌঁছানোর কথা। সেখানে আমাকে নিতে আসবে কেউ। হয়ত না পেয়ে ফিরে যাবে! নতুন শহর, কাউকে চিনিনা, ভাষা জানিনা, সেখানকার নিয়ম-কানুন জানিনা। যাক, আল্লাহ ভরসা।

কুয়ালালামপুরে নামার পরে দেখলাম ৩০ মিনিটের জন্য এখানকার 'ফ্লাইট মিস'। সেই দুপুরে, আমার পরবর্তী ফ্লাইট।

এয়ারপোর্টের বিনামূল্যে ইন্টারনেট দিয়ে তড়িঘড়ি করে ইমেইল করলাম নতুন কর্মস্থলে আমার বিলম্বে পৌঁছানোর সংবাদ দিয়ে। তারাও নিশ্চিত করল, সমস্যা নেই। হাপ ছেড়ে বাঁচা।

এই সুযোগে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর বিমানবন্দর ঘোরা হয়ে গেল। চমৎকার এই দেশ আর এখানকার মানুষের প্রতি সবসময়ই একটা শ্রদ্ধাবোধ কাজ করে আমার। কুয়ালালামপুর থেকে হো চি মিন যাওয়ার সময়টা বেশ লাগল। জানালার পাশে বসার সুযোগ হল, মাত্র এক ঘণ্টা ৫০ মিনিটের ভ্রমণ।

কখনো মালয়েশিয়ার পাহাড়, তারপর সুনীল সাগরের জলরাশি, কখনো সাদা মেঘেদের খেলা দেখতে দেখতে হো চি মিন পৌঁছে গেলাম। হো চি মিন এর আগের নাম 'সাইগন', এখনো অনেকেই সে নামে ডাকে আর শহরের অনেক জায়গার নাম সেভাবেই করা।

                                                                        ******

আমার নতুন কর্মস্থল 'টন ডুক থাং' বিশ্ববিদ্যালয়। সহকারী ডিন এসেছেন আমাকে নিয়ে যেতে! সাথে তিনজন ছাত্র। শহরের মধ্য দিয়ে গাড়ি ছুটে চলল। অবাক বিস্ময়ে দেখছি, হাজার হাজার মোটরসাইকেল (স্কুটার) রাস্তায়! এটাই এখানকার সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত যান।

ভিয়েতনাম সম্পর্কে জানাশোনা সামান্যই। অর্ধ শতাব্দী আগে আমেরিকার সাথে যুদ্ধ করেছিল এরা। প্রায় বিধ্বস্ত অবস্থা থেকে অনেক পরিশ্রমের পরে আজকের এই অবস্থান। মোটামুটি সমৃদ্ধ।

পাশ্চাত্যের অনেকের কাছেই ঘোরাফেরার জন্য চমৎকার জায়গা। বিমান থেকেই দেখছিলাম, অনেকটা বাংলাদেশের মতই প্রকৃতি (বিশেষ করে আমাদের বরিশালের মত)। সবুজ জমিন, আর অনেকগুলো নদী।

আসার পরপরই গুছিয়ে নিতে শুরু করলাম। ২-৩ ঘণ্টার মধ্যেই আবাস এবং কর্মক্ষেত্র বুঝে পেলাম। ব্যবস্থা বেশ সুন্দর। ছোট কিন্তু বেশ সুন্দর ক্যাম্পাস। বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়সও খুব বেশি নয়, মাত্র ১৮-১৯ বছর। আস্তে আস্তে গড়ে উঠছে। এর অবস্থান হো চি মিন শহরের ৭ নম্বর জেলায়।

পেছন দিকে 'রাচ অং লন' স্ট্রিম (ছোট খরস্রোতা নদী)। দূর থেকে বেশ সুন্দর লাগে। কিন্তু কাছে গিয়ে দেখা যায় বেশ নোংরা, অনেকটা আমাদের ঢাকার পাশের তুরাগ নদীর মত।

খাওয়ার ব্যাপারটা শুরুতে একটু ঝামেলারই মনে হয়েছিল। আবাসিক 'হোটেল' ধরনের ব্যবস্থা ; রান্নার সুযোগ নেই।

তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিনে এবং সামনে রাস্তার ওপারে খাবার দোকানগুলোতে খাওয়া যায়। খাওয়া-দাওয়া সম্পর্কে পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে গেল। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ছাত্রাবাসে প্রতিবেশী জয় ভাইয়ের সাথে বেশ সুসম্পর্ক ছিল।

বেশ মজা করে কথা বলতেন। তখনকার কোন একসময়ে ভিয়েতনামের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে গেলেন। তার নাম 'ফ্যান ভ্যান খাই'। জয় ভাই সিরিয়াস মুডে বললেন "ভাই, ব্যাপারটা বুঝলাম না, আজকে আসলেন 'ফ্যান ভ্যান খাই', কয়েকদিন আগে আসছিলেন 'ভ্যান খাওয়ান', এই ভিয়েতনামের মানুষজন কি সবসময় খাওয়া-দাওয়ার মধ্যে থাকে নাকি!"

আসলেই এরা খাওয়া-দাওয়ার মধ্যে থাকে। রাস্তার দুই পাশে অগণিত খাবারের দোকান। ভিয়েতনামের খাবারের অবশ্য বিশ্বব্যাপী সুনামও আছে। তবে আমাদের বাঙালি জিহ্বার জন্য তেমন সুবিধার নয়। 

ভাত এদের প্রধান খাদ্য। এর সাথে একটা মাছ ভাজা কিংবা মাছের স্যুপ আর স্বল্পসিদ্ধ কোনো এক সবজি; কখনো প্লেটে সাজানো কাঁচা এবং অর্ধসিদ্ধ নানারকমের সবজি; আমাদের দেশিয় অনেকের মুখেই রুচবে না, কিন্তু আমার বেশ চলে যায়।

শুকর বা অন্য মাংস খেতে হয় না, এই খুশিতেই এই কাঁচা সবজি গলা দিয়ে দিব্বি সুন্দর করে নেমে যায়। খাবার টেবিলে এখানে পানি পাওয়া যায় না। তবে বরফ ঠাণ্ডা চা 'আইস টি' ফ্রি। তা আমাদের দুধ-চিনি দেয়া চায়ের মত না, চীনাদের গ্রিন টি-এর মত এখানকার চায়ের রং হলুদ।                                                                       

হালকা সুঘ্রাণ আর পাতার সামান্য একটু তিতকুটে স্বাদ। চেহারা দেখে প্রথমবার মনে করেছিলাম বিয়ার; পাশের সহকর্মী নিশ্চিত করল- এটা চা। মন্দ নয়, ক'দিনেই পানির পরিবর্তে ভেষজ চা বেশ অভ্যেস হয়ে গেছে।

                                                                 ******

ভিয়েতনামের মুদ্রার (দং) মূল্য খুবই কম। ১ ডলারে ২২ হাজার দং (ভিয়েতনামি মুদ্রার নাম) পাওয়া যায়। নতুন বাসার জন্য অনেকগুলো টুকিটাকি জিনিসপত্র কিনতে হল। পাশেই সুপার মার্কেট। কেনাকাটা শেষে দাম দিতে গিয়ে দেখি মোট পাঁচ লাখ ৯৬ হাজার ৬৫০ দং!

বলে কী! মাথা খারাপ নাকি! তাড়াতাড়ি ফোনসেট বের করে ইন্টারনেটে দেখে নিলাম, এর মূল্য বাংলাদেশি টাকায় ২ হাজার ৯৮ টাকা!

এদের নোটগুলাও এমন- পাঁচ লাখ, দুই লাখ, এক লাখ, ৫০ হাজার, ২০ হাজার, ১০ হাজার, ৫ হাজার, ২ হাজার, ১ হাজার দং- এর নোট; আর পেলাম ৫০০ আর ২০০ দং এর নোট, এটাই এখন পর্যন্ত পাওয়া সর্বনিম্ন। 

লেখকের কথা

আমি লেখক নই। সাহিত্যজ্ঞানও শূন্যের কোটায়। বিজ্ঞানের ছাত্র। বৈচিত্র্যময় জীবনের নানা বাঁকের ছোট ছোট টুকরো কিছু ঘটনা মাঝে মাঝে দিনপঞ্জিতে লিখি, এই আর কি। পড়াশোনা এবং জীবিকার তাগিদে বেশ কিছুদিন ধরেই প্রবাসে। এই মুহূর্তে আছি ভিয়েতনামের হো চি মিনে। আমার অতি সাধারণ প্রবাস জীবনের সাধারণ কিছু টুকরো অভিজ্ঞতা, সাধারণ কিছু কথা বলার জন্যই এখানে লেখা।

লেখক পরিচিতিঃ প্রবাসী বাংলাদেশি।

এই লেখকের আরও পড়ুন: