চীনাদের আরও কয়েকটি গুণের গল্প

ছ’বছর চীনে কাটানো অভিজ্ঞতার টুকরো গল্প এর আগে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে ‘চীনাদের ভালোমানুষীর গল্প’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছিল।

মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান খান, ভিয়েতনামের হো চি মিন সিটি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Oct 2016, 07:40 AM
Updated : 21 Oct 2016, 09:26 AM

এ ধরণের আরও কিছু গল্প জমা ছিল। এবার সেগুলোই তুলে ধরলাম-

১. ওয়ালেট

একবার ‘চেংডু’ শহর থেকে ভ্রমণ-বাসে ‘আমেই’ শহরে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। বাসের নম্বর মিলিয়ে উঠে বসলাম। ট্যুর গাইড এসে আইডি কার্ড আর টিকেট মিলিয়ে বললেন আমাদের অন্য বাসে যেতে হবে।

হুড়মুড় করে নেমে বাস পরিবর্তন করলাম। বাস ছাড়ার একটু আগে একজন দৌড়ে আসলেন এবং বললেন, “পেছনের বাসে আপনার ওয়ালেট রেখে এসেছেন।”

তারপর তিনি হাঁপাতে হাঁপাতেই আমার সেই ফেলে আসা ওয়ালেট ফিরিয়ে দিলেন।

খুব কৃতজ্ঞতা বোধ করলাম। ওয়ালেটে আমার ক্রেডিট ও আইডি কার্ড, বেশ কিছু নগদ অর্থ এবং বেশকিছু জরুরী কাগজপত্র ছিল। এগুলো ছাড়া বিদেশের মাটিতে নিজ শহরের বাইরে খুব বিপদে পড়তাম। 

আরেক দিন বাজার করে বাসায় আসার সময়ে ট্যাক্সি থেকে নামার সময়ে আবারো ওয়ালেট ছেড়ে এসেছি। সম্ভবত নামার সময়ে রাস্তায় পড়েছে এবং টের পাইনি।

বাসায় আসার দুই ঘণ্টা পরে একজন ফোন করে ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজি বলে আমাকে বোঝাতে পারলেন যে আমি আমার ওয়ালেট হারিয়েছি এবং উনি তা পেয়েছেন।

ভদ্রলোকের দেওয়া ঠিকানায় গেলাম এবং দেখলাম উনি আমার কার্ডগুলো সযত্নে শুকিয়ে রাখছেন বৃষ্টির পানিতে ভেজা ওয়ালেট থেকে বের করে।

কৃতজ্ঞতার সাথে ধন্যবাদ দিতে গেলে তিনি খুবই লজ্জা পেলেন, এবং অফিসের আরেকজনকে দেখিয়ে বললেন, আসলে ওয়ালেটটা উনি খুঁজে পেয়েছেন।

আমি ওয়ালেট খুঁজে পাওয়া ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে দেখলাম তিনি প্রায়-বৃদ্ধা, দরিদ্র ভদ্রমহিলা যিনি ঝাড়ু দেওয়ার কাজ করেন।

ওয়ালেট পেয়ে উনি আগে একজনকে খুঁজে বের করেছেন যিনি ইংরেজি জানেন, তারপর তাকে দিয়ে আমার ভিজিটিং কার্ড খুঁজে নম্বর বের করে আমাকে ফোন করিয়েছেন! 

২. খেলনা গাড়ি

আমাদের ছেলের স্কুলের পাশে বেশ কয়েকটি ছোট ছোট দোকান। এর মধ্যে একটাতে বাচ্চাদের খেলনা বিক্রি হয়। বেশিরভাগই খুব সস্তা দরের। একজন বৃদ্ধা ভদ্রমহিলা এখানে বসেন, মাঝে মাঝে তার স্বামী। দোকানের অবস্থা এবং তাদের পোশাক-আশাক দেখে মনে হবে না তাদের আর্থিক অবস্থা খুব ভালো।

ছেলের যেহেতু নিয়মিত খেলনা কেনার বায়না এবং কেনার পর এগুলোর প্রতি বেশি আগ্রহ থাকে না, তাই সেই দোকান থেকে মাঝে মাঝে তাকে সস্তায় কিছু কিনে দেয় তার মা।

একদিন ছেলে আবদার করে বসল স্কুলের পরে যেন খেলনা দেয়া হয়। ওই ছোট দোকানটাতে ঢুকলাম। সে একটা ছোট গাড়ি পছন্দ করল।

একটু কপালে ভাঁজ পড়ল, কারণ গাড়িটা একটু দামি ছিল। ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও ছেলের কান্নাকাটিতে ভদ্রমহিলাকে বললাম, গাড়িটা দিতে। তিনি ব্যাটারি ভরে দেখলেন, চলে না।

হয়ত বিক্রি না হওয়ায় অনেকদিন পড়ে থেকে নষ্ট হয়ে গেছে। টাকা দিয়ে এই জিনিস নেয়ার কোন মানে হয় না।

তাই চলে এলাম, কিন্তু ছেলে প্রায় পুরো পথ কান্নাকাটি করল। অবশেষে পরের দিন তাকে আরেকটি আরও সুন্দর গাড়ি কিনে দেব বলে নিরস্ত করতে পারলাম।  

পরদিন যখন আবার যাওয়া হল, আরেকটি গাড়ি নেয়া হল। ওই ভদ্রমহিলা কালকের রেখে দেয়া গাড়িটা সুন্দর ভাবে পরিস্কার করে সামনে এনে রাখলেন।

এর বিনিময়ে কোন দাম নিবেন না। ইচ্ছা করলে তিনি অল্প কিছু দামে এটা বিক্রি করতে পারতেন। তার দরিদ্র সংসারে এটা নেহায়েত কম নয়। কিন্তু ছোট শিশুর কান্না তাকে ছুঁয়ে গেছে। তিনি তাকে খুশি করার জন্য এটা দিয়ে দিলেন।

উপহার হিসেবে খুব দামি কিছু নয়। কিন্তু পরবাসে, একজন অনাত্মীয় অপরিচিত দরিদ্রা বৃদ্ধা ভদ্রমহিলার কাছ থেকে এই প্রাপ্তি আমাদের কাছে অনেক বড়। 

৩. সহৃদয় অধ্যাপকেরা

চীনে এসে বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপকদের আচরণ বরাবরই মুগ্ধ করেছে। আমার গুরু চেন সাহেবকে দেখতাম ঝাড়ুদার এবং টয়লেট পরিষ্কারের কাজে নিয়োজিত এক ভদ্রমহিলাকে নিয়ে এক সাথে চা খেতে!

নিজের রুম নিজেই ঝাড়ু দিতেন। আমি একদিন জোর করে ঝাড়ু কেড়ে নিতে গেলাম; তিনি খুশি হলেন কিন্তু দিলেন না।

বললেন, “তুমি কি ভাবছ, আমি বুড়ো হয়ে গেছি!” আমাকে তিনি ছাত্র না ভেবে ‘সহকর্মী’ কিংবা ‘বন্ধু’ ভাবতেন। আমার ছেলেকে যখন চীনে নিয়ে এলাম, তিনি শিশুর মত খুশি হলেন। ওর সাথে খেলতে কয়েকবার বাসায়ও চলে এসেছেন! ওকে বলতেন, ‘মাই গ্র্যান্ডসন’।

২০১৩ সালের শেষ দিকে ভিসা সংক্রান্ত জটিলতার কারণে দেশে গিয়ে দুই মাস বসে থাকতে হয়েছিল। চীনে আর আসা হবে কি না তাই নিশ্চিত ছিল না!

সেই সময়ে আমার কর্মস্থল আমাকে বেতন দিয়ে গেছে। এটা হয়ত বিশেষ কিছু নয়। যা অপ্রত্যাশিত ছিল তা হল, আমার তৎকালীন গুরু ফু সাহেব ব্যাংক থেকে সেই টাকা তুলে আমাকে দেশে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন যাতে আমার বাংলাদেশে চলতে সমস্যা না হয়!

৪. ধর্মীয় উদারতা  

অনেকের কাছ থেকেই শুনি, মাঝে মাঝে পত্রিকাতেও পড়ি অমুসলিম দেশগুলোতে মুসলমানরা একটু-আধটু হেনস্তা হন।

ছ’বছরের চৈনিক জীবনে সেরকম কোন অবস্থায় পড়তে হয়নি। বরং রাস্তাঘাটে, পার্কে, বাজারে প্রায় সবাই ‘বিদেশি মেহমান’  হিসেবে সম্মান দিয়েছেন।

কি বিচিত্র পৃথিবী! দাড়ি রাখার জন্য মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ নিজ দেশে অনেক খারাপ আচরণের শিকার হয়েছি, অথচ পৃথিবীর সবচেয়ে ‘বড় ধর্মহীন’ হিসেবে পরিচিত চীনের মানুষের কাছ থেকে সত্যিকারের সম্মান পেয়েছি!   

২০০৯ সালে রোজার মাসে চীনে এসেছিলাম। তখনও চেন সাহেবের সঙ্গে দেখা হয়নি।

পরের বছর রোজায় আমি তার ল্যাবের ছাত্র। প্রথম রোজার দিনে ল্যাবে বেশ কিছু কাজ ছিল। উনি দেখলেন আমি ঘেমে গেছি।

তার ফ্রিজ থেকে ঠাণ্ডা এক বোতল পানি দিলেন খাওয়ার জন্য।

আমি বললাম, “এটা আমাদের ফাস্টিং মান্থ, কিছু খাওয়া বা পান করা যাবে না।”

পানিও খাওয়া যাবে না শুনে উনি অবাক হলেন। রোজার বিষয়েও জানতে চাইলেন।

আমি তাকে রোজার গুরুত্ব এবং নিয়ম সম্পর্কে দুই মিনিট বললাম।

তিনি আমাকে বললেন, “আগামী একমাস তোমার ল্যাবে আসার দরকার নেই, রমজানে বিশ্রাম নাও!”

না, আমি একদিনের জন্যও বিশ্রাম নেইনি। কিন্তু অমুসলিম একজন অধ্যাপকের কাছ থেকে ধর্মীয় ব্যাপারে এইরকম সহযোগিতা আমাকে মুগ্ধ করেছিল। তার ল্যাবে চার বছর ছিলাম। নামাজের সময়ে কোনদিন সমস্যা হয়নি। ল্যাবের অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রীরাও জানত। তারাও সবসময়ে সহযোগিতা করেছে। 

পরে অধ্যাপক ফু সাহেবের সঙ্গে কাজ করতে গিয়েও একই অভিজ্ঞতা হয়েছে। পার্টিগুলোতে খাবার টেবিলে প্রচুর মাছ থাকত শুধু আমাদের জন্যই। যেহেতু মাংস খেতাম না, ওদের ধারণা ছিল আমাদের খাওয়াই হচ্ছে না!

তাই চারদিক থেকে ঠেসে ঠেসে মাছ খাওয়াত। আপনারা অনেকে হয়তো চীনাদের খাবার সম্পর্কে জানেন, এদের জীবনে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে ওয়াইন জড়িত। এই তরল ছাড়া খাবার পার্টি এরা কল্পনাই করতে পারে না।

এরা যেহেতু জানত আমরা মদ ছুঁই না, আমাদের বাসার পার্টিতে কোনদিন মদ নিয়ে আসত না। এমনকি অনেক সময়, বাইরে খেলেও আমরা যে টেবিলে বসতাম সেখানেও মদ রাখত না।

একবার গ্রীষ্মের ছুটির আগে অনুষদ সদস্যদের একসাথে পেটপুরে খানাপিনার আয়োজন। রোজার মাস হওয়ায় সপরিবারে আমি অনুপস্থিত। 

বিকেলের দিকে অফিস রুমের দরজায় ঠক ঠক। খাওয়া-দাওয়া শেষে ফিরছে তারা। আর দুই প্যাকেট খাবার নিয়ে এসেছে রোজাদারের রাতের খাবার অর্থাৎ ‘সেহরি’ হিসেবে!

লুঝোউ মসজিদে শেষ জুম্মার নামাজ আদায় করতে গেলাম। সেখানকার একজন ইমাম সাহেব ছিলেন আমার খুব সুহৃদ।

এখানকার অধিকাংশ মুসলিমই বেশ ভাল সহজ, সাধারণ মানুষ। তরুণ বয়সী একটা ছেলে, মুয়াজ্জিনের কাজ করে এই মসজিদে।

ওকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বললাম, “পরশু দিন চলে যাচ্ছি। আর হয়তো দেখা হবে না। সামনে ঈদ। আমি এই মসজিদে কিছু অর্থ দিতে চাই।”

আমি ৩০০ আরএমবি (চীনা মুদ্রা) বের করে দিতে গেলাম।

সে আমাকে অনেকভাবে বুঝিয়ে যা বলতে চাইল তা হল, “এখানে মসজিদের জন্য যা দরকার, তার সব সরকার দিয়ে থাকে। এখানে কিছু দেয়ার দরকার নেই।  তারচেয়ে বরং তুমি এই টাকা তোমাদের দেশের মসজিদে কিংবা গরীব মানুষদের দাও। আমরা জানি তোমাদের দেশে অনেক গরীব মানুষ আছে।”

আমি আরেকবার এদের প্রতি শ্রদ্ধাবনত হলাম।

লেখকের কথা

আমি লেখক নই। জীবনের নানা বাঁকের ছোট ছোট টুকরো কিছু ঘটনা মাঝে মাঝে দিনপঞ্জিতে লিখি। পড়াশুনা এবং জীবিকার তাগিদে বেশ কিছুদিন ধরেই প্রবাসে। এখন ভিয়েতনামে থাকলেও চীনে ছিলাম প্রায় ছয় বছর। মাঝে কিছু সময় কাটিয়েছি ম্যাকাওতে।

এখানে ওখানে ছোটাছুটি করার সময় যেসব টুকরো অভিজ্ঞতা হয়েছিল সেগুলো খুব কাছের কিছু বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে বলতাম; কখনো আড্ডায়, কখনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সাধারণত প্রাচ্যের দেশগুলোতেই ঘুরেছি। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে আমার প্রথম প্রবাস চীনের কিছু অভিজ্ঞতা দিলাম।

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি