বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির ৩৪ সদস্যের মধ্যে যে চারজন এখনও জীবিত, ড. কামাল হোসেন তাদের অন্যতম। তার জন্ম ১৯৩৭ সালের ২০ এপ্রিল। তিনি ছিলেন এই কমিটির সভাপতি।
Published : 20 Apr 2024, 05:25 PM
বছরের পর বছর ধরে জনপরিসরে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে আছে যে, ড. কামাল হোসেনই বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন করেছেন। যে কারণে তার নামের সঙ্গে ‘সংবিধান প্রণেতা’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তিনি ছিলেন সংবিধানের খসড়া প্রণয়নের জন্য গঠিত ৩৪ সদস্যবিশিষ্ট কমিটির সভাপতি।
অস্বীকার করার সুযোগ নেই, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দিকনির্দেশনায় তৎকালীন আইন ও সংসদীয় বিষয়াবলী এবং সংবিধান প্রণয়ন বিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে ড. কামাল হোসেনই সংবিধান প্রণয়নের পুরো প্রক্রিয়াটি তত্ত্বাবধান করেছেন। কমিটির অন্যতম সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের ভাষ্য: “সংবিধান প্রণয়নের ব্যাপারটি পুরোপুরি ড. কামাল হোসেন নিয়ন্ত্রণ করতেন। তিনি সংবিধানের বিভিন্ন বিষয় উপস্থাপন করতেন। পরে সেটির ওপর কমিটির সদস্যরা আলোচনা করতেন, মতামত দিতেন। বঙ্গবন্ধুও মতামত দিয়েছেন। তারপর তা সংবিধানের ধারায় সন্নিবেশিত হয়েছে। (প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদ, সাখাওয়াত হোসেন মজনু-মর্জিনা আখতার, পৃ. ৭৫)।
যাত্রা শুরু ১৯৬৯ সালেই
বঙ্গবন্ধু যে ড. কামাল হোসেনের ওপর এরকম একটি গুরুদায়িত্ব অর্পণ করলেন, তার একটি প্রেক্ষাপট রয়েছে। ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবকে মুক্তি দেওয়া হয় এবং তিনি সংবিধানবিষয়ক আলোচনার জন্য গোলটেবিল সম্মেলনে যোগ দেওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। যেহেতু বৈঠকে সাংবিধানিক বিষয় জড়িত ছিল, তাই তিনি ড. কামালকে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দেন। আওয়ামী লীগের সদস্য না হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও আইনজীবী হিসেবে সাংবিধানিক আইনে তার দক্ষতা ছিল, তাই শেখ মুজিব তাকে এই প্রস্তাব দেন।
১৯৭০ সালের দিকে তাকে আওয়ামী লীগের পক্ষে পাকিস্তানের সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন কমিটির কাজ করতে বলা হয়। নির্বাচনের পর ওই খসড়া সংবিধানসভার (গণপরিষদ) কাছে পেশ করার কথা ছিল। ড. কামাল বলেন, “নির্বাচন ঘনিয়ে এলে শেখ মুজিব আমাকে বললেন, আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে আমাকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে হবে। তিনি আশা করছিলেন, সংবিধানসভায় সংবিধান বিলের ব্যাপারে আমি আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দেব। তিনি বললেন, আইন পেশায় সফল হয়েও আমাকে হয়তো তা ছাড়তে হবে। তবে তিনি আমাকে আশ্বস্ত করলেন যে, মানুষকে প্রতিনিধিত্ব করা এবং জনসেবা করার যে আনন্দ, তাতে আমার ওই ক্ষতি ভালোভাবে পুষিয়ে যাবে। আমাকে ঢাকায় শেখ মুজিবের নির্বাচনী প্রচারণার দায়িত্ব নিতে বলা হলো। একইসঙ্গে আমাকে তার প্রধান নির্বাচনী প্রতিনিধি বানানো হলো। শেখ মুজিব দুটি আসনে জিতে এলেন, পরবর্তী সময়ে তিনি একটি আসন ছেড়ে দিলে আমি সেই শূন্য আসনে উপনির্বাচন করে জিতে আসি।”
১৯৭১ সালের ৩ মার্চ সংবিধানসভার অধিবেশন বসার কথা ছিল। ড. কামাল ছিলেন আওয়ামী লীগের খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য। এই কমিটি প্রতিদিন বৈঠক করে সংবিধানের একটি খসড়া দাঁড় করিয়ে ফেলে। কামাল হোসেনের ভাষায়: “সংবিধানের (পাকিস্তানের) খসড়া প্রণয়ন কমিটির নেতৃত্ব দিতে তৃতীয় আলোচক হিসেবে আমাকে নেওয়া হয়। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদের সহযোগী হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেয়ে যাই। আমরা প্রতিটি অনুচ্ছেদ ধরে ধরে আলোচনা করছিলাম। সংবিধানসভা বসলেই এটা নিয়ে আলোচনা শুরু হওয়ার কথা ছিল।” কিন্তু ইয়াহিয়া খান হঠাৎ করেই ১৯৭১ সালের পয়লা মার্চ অনির্দিষ্টকালের জন্য সংবিধানসভা স্থগিত করেন। তারপর বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম, ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার, আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধ শুরু, ৪ এপ্রিল ড. কামালকেও গ্রেপ্তার এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কারামুক্ত হয়ে পাকিস্তান থেকে লন্ডন ও দিল্লি হয়ে ঢাকায় প্রত্যাবর্তন; নতুন রাষ্ট্রের জন্য সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়া শুরু।
জন্ম, বেড়ে ওঠা, শিক্ষা
কামাল হোসেনের পূর্ব পুরুষের বাড়ি বরিশালের শায়েস্তাবাদে। তাদের বাড়িটি ‘নবাব বাড়ি’ নামে পরিচিত ছিল। তার বাবা সৈয়দ আহাম্মদ হোসেন পড়ালেখা করতে কলকাতায় যান এবং প্রেসিডেন্সি কলেজ ও মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা শেষ করে সেখানেই চিকিৎসক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। কামাল হোসেনের জন্ম ১৯৩৭ সালের ২০ এপ্রিল কলকাতা শহরের ৩৬ চৌরঙ্গী রোডের বাড়িতে। তার বাবা প্রথমে এই সড়কের একটি বাসায় চিকিৎসা পেশা শুরু করেন। এরপর ওই সড়কের আরেকটি বাসায় চলে যান।
দুই ভাইবোনের মধ্যে কামাল হোসেন ছোট। তার বড় এক বোন ছিলেন। তাকে আইরিশ সন্ন্যাসিনীদের পরিচালিত কলকাতার সেরা স্কুল লরেটো স্কুলে ভর্তি করা হয়। কামাল হোসেনও সেই স্কুলের কিন্ডারগার্টেন শাখায় পড়েছেন। ছেলেরা সেখানে ওপরের ক্লাসে পড়ার সুযোগ পেত না। ফলে এক বছর পর তাকে কলকাতার আরেক সেরা স্কুল সেন্ট জেভিয়ার্সে ভর্তি করা হয়, যার পরিচালনায় ছিলেন জেসুইট ধর্মপ্রচারকেরা। ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত তিনি সেখানে পড়াশোনা করেন। এর আগেই ১৯৪৭ সালে দেশভাগ হয়ে যায়।
১৯৪৯ সালে পরিবারের সঙ্গে তিনি ঢাকায় চলে আসেন এবং ভর্তি হন সেন্ট গ্রেগরিস নামে একটি ক্যাথলিক স্কুলে, যেটি হলিক্রসের মিশনারিদের দ্বারা পরিচালিত হতো; যাদের মূল প্রতিষ্ঠান ছিল যুক্তরাষ্ট্রের নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয়। সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুলে কামাল হোসেনকে এক ক্লাস উপরে ভর্তি করা হয়। কারণ কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল থেকে আসায় তার শিক্ষার মান ভালো ছিল। ১৯৫১ সালে এক বছরের মধ্যে তিনি স্কুলের পাঠ শেষ করেন। পরবর্তী দুই বছর তিনি সেন্ট গ্রেগরিজ কলেজে পড়াশোনা করেন, যার বর্তমান নাম নটর ডেম কলেজ।
ভাষা আন্দোলন ও শিক্ষকতা
ড. কামাল হোসেন যে ভাষা আন্দোলনেও যুক্ত ছিলেন, সেটি জানাচ্ছেন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান। তার ভাষায়: “১৯৫৩ সালের ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম হয়ে ড. কামাল হোসেন পূর্ণবৃত্তি নিয়ে যখন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানার নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যান, তার আগেই তিনি রাজনৈতিকভাবে যুক্ত ছিলেন। নটর ডেম কলেজের ছাত্র থাকাকালীন ভাষা আন্দোলনে ভাষা মতিনের সহযোগী হিসেবে কাজ করে অনুপ্রাণিত হওয়ার সুযোগ হয়েছিল তাঁর।” (ড. কামাল হোসেন সম্মাননাগ্রন্থ, প্রথমা/২০২৪, পৃ. ১৩৮)।
১৯৫৩ সালে তিনি উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। তার এই কৃতিত্বের স্বীকৃতি হিসেবে কলেজ কর্তৃপক্ষ তাকে পূর্ণ বৃত্তি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে তাদের মূল প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ ইন্ডিয়ানার নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়ে দেয়। সেখান থেকে মাত্র ১৮ বছর বয়সে তিনি স্নাতক সম্পন্ন করেন।
এখানে কামাল হোসেনের পড়াশোনার মূল বিষয় ছিল অর্থনীতি। যদিও রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও দর্শনের কিছু কোর্সও তিনি নিয়েছিলেন। তবে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার ব্যাপারে কামাল হোসেনের স্থির লক্ষ্য ছিল। কেননা ওই সময়ে তার ‘আদর্শ’ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। তিনি ১৯২০-এর দশকের গোড়ার দিকে সেখান থেকে বিসিএল (ব্যাচেলর অব সিভিল ল) ডিগ্রি নিয়েছিলেন। সোহরাওয়ার্দী ছিলেন কামাল হোসেনের বাবার দিকের দূরসম্পর্কের আত্মীয়। একইসঙ্গে তিনি কামাল হোসেনের বাবার রোগীও ছিলেন এবং সেই সূত্রে প্রায়ই তাদের বাসায় আসতেন।
১৯৫৫ সালে কামাল হোসেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কুইন্স কলেজে ভর্তি হন। ১৯৫৭ সালে প্রথমে আইনবিজ্ঞানে (জুরিসপ্রুডেন্স) স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর ১৯৫৮ সালে বিসিএল অর্জন করেন। সব মিলিয়ে মাত্র ২০ বছরের মধ্যে তিনি আনুষ্ঠানিক পড়াশোনা শেষ করে ফেলেন!
বিসিএলের পর তিনি বার অ্যাট ল করেন। ১৯৫৯ সালে লিংকনস ইন থেকে ব্যারিস্টারি সম্পন্ন করেন এবং দেশে ফিরে এসে আইন পেশা শুরু করেন। তিনি একটি আইনি প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন। তবে পূর্ব বাংলা তথা আজকের বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহের কারণে রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে যান ড. কামাল হোসেন। ১৯৫৯ সালের দিকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার কথা বলার সুযোগ হয়।
এই সময়ে ড. কামাল হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। সেখানে তিনি আন্তর্জাতিক আইনের ইতিহাস পড়াতেন। বিকেলে ক্লাস নিতেন। সপ্তাহে ছয় থেকে আট ঘণ্টা। পড়ানোর ব্যাপারে তার আগ্রহ ছিল, সে কারণে সাংবিধানিক বা আন্তর্জাতিক আইন পড়ানোর জন্য তিনি আবেদন করেন।
বারের মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে প্রবেশ
বারের মধ্য দিয়ে ড. কামালের রাজনীতিতে প্রবেশ। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা কর্মসূচি পেশ করার পরে শেখ মুজিবুর রহমান রাজনৈতিক সফর শুরু করেন এবং এর মধ্য দিয়ে তিনি ছয় দফা দাবির প্রচার করেন। এই কর্মসূচি ব্যাপক সমর্থন পেতে শুরু করে। এরপর শুরু হয় অন্তহীন গণগ্রেপ্তার। ব্যাপারটা এমন হয়ে দাঁড়ায় যে প্রতিটি জনসভার পর তাকে গ্রেপ্তার করা হতো, এরপর তিনি জামিন পেতেন এবং আবার জনসভা করতেন ও গ্রেপ্তার হতেন। এ সময় আইনজবীরাও এই আন্দোলনে একাত্ম হয়ে যান। তারা হাইকোর্টে সংবাদপত্র বন্ধের আদেশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করেন। শেখ মুজিব ও ইত্তেফাক পত্রিকার সম্পাদককে মুক্ত করতে ‘হেবিয়াস কর্পাস পিটিশন’ দাখিল করেন। এভাবে তারা আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনে একাত্ম হয়ে যান। ড. কামাল ছিলেন এই আইনজীবীদের অন্যতম। এরপর পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে শেখ মুজিব ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। শেখ মুজিবের পক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে ড. কামালও ছিলেন।
কামাল হোসেনের জবানিতে সংবিধান প্রণয়ন
১৯৭০ সালের নির্বাচনে তৎকালীন জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে ঢাকা-৯ আসন থেকে জয়ী হন ড. কামাল হোসেন। এরপর ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হন। মাসখানেক পরে তাকেও গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। ড. কামাল হোসেন কীভাবে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হলেন, এ বিষয়ে তার ভাষ্য: “পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেশে ফেরার পরদিন ১১ জানুয়ারি একটি বার্তায় আমাকে হেয়ার রোডে যেতে বলা হলো; যেটি প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে পরিণত হয়েছিল; তখন তাজউদ্দীন আহমদ সে বাড়িতে থাকতেন। আমি তাৎক্ষণিকভাবে এতে সাড়া দিয়ে আমীর-উল ইসলামের সঙ্গে সেখানে যাই। আমীর-উল ইসলামকেও সেখানে ডাকা হয়েছিল। সেখানে পৌঁছে আমরা জানলাম, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকেও ডাকা হয়েছে। তখন সেখানে মন্ত্রিসভার একটি বৈঠক চলছিল। সেই অবস্থায় বঙ্গবন্ধু বেরিয়ে এলেন এবং আমাদের বললেন, সংবিধান প্রণয়নের কাজকে প্রক্রিয়াধীন রেখে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার চালু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। তিনি জানতে চাইলেন, পরদিনই যাতে মন্ত্রিসভা শপথ গ্রহণ করতে পারে, সে জন্য জরুরি ভিত্তিতে একটি অস্থায়ী শাসনতান্ত্রিক বিধি প্রণয়ন করা যায় কি না। এক ঘণ্টার মধ্যে একটি খসড়া কি মন্ত্রিসভার কাছে উপস্থাপন করা যেতে পারে? স্বাধীনতার পরের দিনগুলোতে কাজের ধারা ছিল এমনই। আমরা তাড়াহুড়ো করে একটি খসড়া তৈরি করলাম এবং তা মন্ত্রিসভার কাছে পেশ করা হলো। সেটা অনুমোদিত হলো এবং তা গেজেট আকারে প্রকাশের জন্য সরকারি ছাপাখানায় পাঠানো হলো।… পরদিন সকালে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতি শপথ গ্রহণ করেন। সেই অনুষ্ঠান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বঙ্গবন্ধু ওই দিন দুপুরে অনুষ্ঠেয় নতুন মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে আমাকে আসতে বললেন। আমাকে অবাক করে দিয়ে জানালেন যে তিনি মন্ত্রিসভায় আমাকে অন্তর্ভুক্ত করতে যাচ্ছেন। আমাকে আইনমন্ত্রী করা হবে এবং সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়ার দায়িত্ব নিতে হবে, যা ছিল সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারমূলক বিষয়।’
ড. কামাল হোসেন লিখেছেন, “গণপরিষদ একটি সংবিধান প্রণয়ন কমিটি গঠন করে এবং আমাকে তার সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়। কমিটিকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটি খসড়া সংবিধান প্রণয়নের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল।”
তিনি জানান, কমিটিতে ব্যাপকভিত্তিক আলোচনা হয়েছিল, যা কয়েক মাস ধরে প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা, এমনকি গভীর রাত পর্যন্ত চলেছিল। কমিটির আলোচনায়ও বিভিন্ন ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটেছে। এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মধ্যে যেমন ছিল রাষ্ট্র পরিচালনার মৌল নীতি সংজ্ঞায়ন করা এবং ফ্লোর ক্রসিং, যার অর্থ একজন সদস্য দলের টিকিটে সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার পর যদি তার দলের বিরুদ্ধে ভোট দেন, তাহলে তাকে পদত্যাগ করতে হবে। দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনা ও বিতর্কের পর প্রায়ই ঐকমত্যের ভিত্তিতে বিষয়গুলোর সুরাহা হয়েছে। খসড়া সংবিধান বিলের ওপর বিপুলসংখ্যক সংশোধনী প্রস্তাব আনা হয়েছিল এবং সদস্যদের প্রস্তাবিত ৫০টির বেশি সংশোধনী এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। (কামাল হোসেন, বাংলাদেশ স্বাধীনতা ও ন্যায়ের সন্ধানে, প্রথমা/২০২০, পৃ. ১৮৯)।
সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় ড. কামাল হোসেনকে যে বঙ্গবন্ধু আরও আগেই, অর্থাৎ ১৯৬৯ সালেই যুক্ত করেছিলেন, সে কথা ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিষয়ে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. স্যু অন্সলোকে দেয়া সাক্ষাৎকারে ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে উপস্থাপন করার জন্য আমরা একটি খসড়া প্রস্তুত করেছিলাম। এটা অবশ্যই একটি সম্পূর্ণ খসড়া ছিল এবং ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ এটা উপস্থাপন করার কথা ছিল। কিন্তু ১ মার্চ সম্পূর্ণ আকস্মিকভাবে এ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হলো।’
তিনি বলেন, ‘আমরা নতুন একটি সংবিধানের খসড়া তৈরি করছিলাম। কারণ, এর আগে যে সংবিধান ছিল, তা সামরিক আইনের অধীনে জারি করা হয়েছিল। আমরা সেটাকে অসাংবিধানিক বলেছিলাম। সামরিক আইন জারি করা হয়েছিল, সে কারণে ১৯৭১ সালে কোনো সংবিধানের অস্তিত্ব ছিল না। স্বাধীনতার পর তাই আমরা জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটাতে গণপরিষদ গঠন করলাম।’ (সম্মাননাগ্রন্থ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৪)।
ড. কামাল হোসেনের ভাষায়, সংবিধান প্রণয়ন কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন বেশ কঠিন কাজ ছিল। তাদের প্রথম কাজ ছিল সব সদস্যকে একত্র করা। ভাগ্যক্রমে জাতীয় পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদে নির্বাচিত বেশির ভাগ সদস্যই জীবিত ছিলেন। তাদের এমন একটা সনদের খসড়া তৈরি করতে হয়েছিল, যেখানে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় পরিষদের পূর্ব অংশের নির্বাচিত প্রতিনিধি এবং পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধি উভয় দলকে একসঙ্গে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে গণ্য করা হবে এবং তারা সংবিধান প্রণয়ন কমিটির (বাংলাদেশ গণপরিষদ) সদস্য হিসেবে কাজ শুরু করবেন। এটাই তখনকার জন্য আইন ছিল। তিনি জানান, সংবিধানের প্রতিটি অনুচ্ছেদের খসড়া চূড়ান্ত করার পরে সেটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পড়তেন তাজউদ্দীন আহমদ (সাক্ষাৎকার, ০৮ মার্চ ২০২৪)।
গণপরিষদে ড. কামাল হোসেন
আইন ও সংসদীয় বিষয়াবলী এবং সংবিধান-প্রণয়ন-মন্ত্রী হিসেবে ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর গণপরিষদে সংবিধান বিল উত্থাপন করেন ড. কামাল হোসেন। এ সময় তিনি স্পিকারকে উদ্দেশ্য করে বলেন,“এই গণপরিষদের খসড়া সংবিধান-প্রণয়ন কমিটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জন্য যে সংবিধান-বিল রচনা করেছেন, কমিটির সভাপতি হিসাবে তা উত্থাপন করতে পেরে আমি গৌরব বোধ করছি।” বাংলা ভাষায় খসড়া সংবিধান পেশ করতে পারার ঘটনাকে বাঙালি ও বাংলা ভাষার ইতিহাসে স্মরণীয় ঘটনা বলে উল্লেখ করেন ড. কামাল হোসেন। বলেন, “আমাদের সৌভাগ্য যে, বাঙালির স্বাধীনতাকামনার প্রতীক যিনি, সেই বঙ্গবন্ধু আজ এই পরিষদের নেতা এবং তার নেতৃত্বে স্বাধীনতা-সংগ্রামে জয়যুক্ত হয়ে আমরা আজ বাংলাদেশের খসড়া সংবিধান পেশ করতে পেরেছি।”
সংবিধান বিল উত্থাপনকালে ড. কামাল হোসেন বলেন, “আমাদের রাষ্ট্রই বাঙালি জাতীয়তাবাদের ফল। নিপীড়িত বাঙালি জাতি আজ স্বাধীন ও সার্বভৌম সত্তা নিয়ে বিশ্ব-সভায় স্থান পেয়েছে। এই স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ণ রাখা আমাদের মৌলিক দায়িত্ব, লক্ষ্য ও কর্তব্য।” তিনি তার দীর্ঘ বক্তৃতায় সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে সমাজতন্ত্রের ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, “সমাজতন্ত্র বলতে বোঝায় অর্থনৈতিক শোষণ থেকে মুক্তি। সমাজতান্ত্রিক সমাজ বলতে আমরা বুঝি এমন এক সমাজ-ব্যবস্থা, যেখানে জাতিকে এবং জাতীয় অর্থ-ব্যবস্থাকে গড়ে তোলার জন্য যে আত্মত্যাগের প্রয়োজন, সকলে তা ভাগ করে নেবে। আবার সকলের প্রচেষ্টায় যে সম্পদ গড়ে উঠবে, তাও সকলে সুষমভাবে ভাগ করে নেবে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সমাজতন্ত্রের দিকে যাত্রা করতে গিয়ে আমরা যে নতুন পথে চলছি, সে বিষয়ে আমরা সচেতন।”
সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে কেন ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ যুক্ত করা হলো তার ব্যাখ্যায় ড. কামাল হোসেন বলেন, “সাম্প্রদায়িকতার ভয়াবহ ফল আমরা দেখেছি। ক্ষমতালোভী লোকেরা কিভাবে ধর্মের অপব্যবহার করে, তাও আমরা দেখেছি। সংবিধানে প্রত্যেক ব্যক্তির নিজস্ব ধর্মপালনের স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে সর্ব প্রকার সাম্প্রদায়িকতা, রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদাদান এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার বিলোপ করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। সুতরাং, আমাদের সমাজে কোনো সাম্প্রদায়িক বা ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের স্থান হতে পারবে না।”
তত্ত্বাবধায়কের আলোচনা ১৯৭২ সালেই!
এই সময়ের বাংলাদেশে যে কেয়ারটেকার বা নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে নানা আলোচনা হচ্ছে এবং বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনীতির সংকটের অন্যতম প্রধান কারণ যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা, সেই ইস্যুটি ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নকালেও যে আলোচিত হয়েছে, সেটি জানা যাচ্ছে ড. কামাল হোসেনের বক্তব্যে।
২ নভেম্বরের বৈঠকে দেশের নির্বাচনি ব্যবস্থা নিয়ে সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদের বিধান নিয়ে আবদুল আজিজ চৌধুরীর একটি বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ড. কামাল হোসেন বলেন, “সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত ব্যক্তিগণ পরবর্তী নির্বাচনে বিজয়ী হলেও তাদের মেয়াদ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত সংসদ-সদস্য হিসেবে কার্যভার গ্রহণ করবেন না। অর্থাৎ মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্ববর্তী অথবা পরবর্তী ৯০ দিনের যে কথা এখানে বলা হয়েছে, সেই ৯০ দিনের মধ্যে যদি প্রধানমন্ত্রীর পদ শূন্য হয়ে যায়, তাহলে ওই ৯০ দিনের জন্য যারা সংসদ-সদস্য ছিলেন, তাদের মধ্যে থেকে একজনকে নেওয়ার বিধান করা হয়েছে। সেই ৯০ দিনের জন্য একটি বিধান করা হয়েছে এবং ওই ৯০ দিন পরে সাধারণ নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এই সময়ের জন্য কোনো একজন উপযুক্ত লোককে নিযুক্ত করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী যদি পদে ইস্তফা দেন অথবা মৃত্যুবরণ করেন, তাহলে তখনও প্রেসিডেন্টকে কোথাও থেকে একজনকে নিযুক্ত করতে হচ্ছে। সেই ৯০ দিনের সম্বন্ধে বলা হয়েছে যে, যে সংসদ ভেঙে গিয়েছে, সেই সংসদের মধ্যে হতে একজনকে ৯০ দিনের মেয়াদে অথবা ৫০ দিন, ৩০ দিন- যাই হোক, নিযুক্ত করার সাময়িক ব্যবস্থা করা হয়েছে। এটাকে caretaker Government বলা হয়।”
শুধু নির্বাচনি ব্যবস্থাই নয়, বরং গণপরিষদ সদস্য এমনকি গণপরিষদ সদস্যদের মধ্যে যারা সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন কমিটির সদস্য ছিলেন, তাদেরও অনেকে খসড়া সংবিধান বিলের ওপরে যেসব আলোচনা করেছেন, মতামত দিয়েছেন, সে বিষয়ে ড. কামাল হোসেন তাৎক্ষণিকভাবে উত্তর দিয়েছেন। প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। খসড়া সংবিধান বিলে যেসব সংশোধনী আনা হয়েছে, সেসব সংশোধনীর ওপরেই তিনি সংবিধান প্রণয়ন মন্ত্রী হিসেবে তাঁর অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। প্রাণবন্ত আলোচনা ও তর্ক-বিতর্কের পরে ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর সংবিধান বিল পাসের জন্য ড. কামাল হোসেন প্রস্তাব করেন এবং কণ্ঠভোটে পাস হয়।
বাহাত্তর পরবর্তী রাজনীতি: বাকশালের পরোক্ষ বিরোধিতা
১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-১৪ (আওয়ামী লীগ) থেকে নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয়লাভ করেন ড. কামাল হোসেন। এই আসনে মোট ভোটার ছিল ১ লাখ ৩৪ হাজার ৫৯৫। তিনি পেয়েছেন ৭০ হাজার ২৬ ভোট। প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে ড. কামাল হোসেনকে পররাষ্ট্র মন্ত্রী করা হয়। জ্বালানি মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানে চতুর্থ সংশোধনী এনে দেশে একদলীয় শাসন চালু করা হলে ড. কামাল হোসেন এর বিরোধিতা করেন। নীরব প্রতিবাদ হিসেবে ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে বিল পাস হওয়ার দুই সপ্তাহ আগে তিনি অক্সফোর্ডে চলে যান। স্বাভাবিকভাবেই একজন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অস্বাভাবিক অনুপস্থিতি কূটনৈতিক মিশনগুলোকে আকর্ষণ করেছিল। (সম্মাননাগ্রন্থ, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮৩)।
বঙ্গবন্ধু জানতেন যে তার শিষ্য তাকে ‘ত্যাগ’ করেছিলেন একদলীয় শাসনের জন্য। এই গণতান্ত্রিক ভিন্নমতের ঘটনাকে বঙ্গবন্ধু স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছিলেন। তার এই ভিন্নমত পোষণ সত্ত্বেও রাষ্ট্রপতি তাকে লন্ডন থেকেই টেলিফোনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার প্রস্তাব দেন। পরবর্তীকালে তিনি ঢাকায় এসে এই প্রস্তাবে মৌন সম্মতি দেন।
তবে বাকশাল গঠনের পরোক্ষ বিরোধিতা এবং চতুর্থ সংশোধনী পাসের সময় দেশে না থাকায় ড. কামালের সমালোচনা করেছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি। ড. কামাল হোসেনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান লিখেছেন: “কামালের কাছে একবার গিয়ে জানতে পারলাম, জার্মানির কোনো এক পত্রিকায় ঢাকায় দেওয়া ফজলুল হক মনির সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে। তাতে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে কামালের সম্পর্কে কিছু মন্তব্য আছে। তিনি যে জাতীয় কর্তব্য পালন না করে বিদেশে বসে বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা করছেন, তা নিয়ে কটাক্ষ আছে, কিন্তু সবচেয়ে মারাত্মক কথা, বাংলাদেশের প্রতি কামালের আনুগত্যে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে। সেইসঙ্গে এ কথাও বলা হয়েছে যে, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানে বন্দিজীবন-যাপনকালে কামালের ভূমিকা রহস্যাবৃত। মনি তখন বাকশালের তিন সম্পাদকের একজন-এমনিতেই প্রতাপশালী, তার ওপরে আনুষ্ঠানিক পদ অলংকৃত করে রয়েছে। স্বভাবতই কামাল খুব ব্যথিত হলেন। কেন তিনি এই আকস্মিক আক্রমণের লক্ষ্য হলেন, এ প্রশ্ন নিশ্চয় তাঁর মনে উঠে থাকবে। কিন্তু তার চেয়ে প্রবল হলো এই জিজ্ঞাসা যে, এই আক্রমণ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু আদৌ ওয়াকিবহাল কি না। এই প্রকাশিত সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর কী করা উচিত, এ-প্রশ্নও দেখা দিলো। শেষ অবধি তিনি স্থির করলেন, ওই সাক্ষাৎকার সম্পর্কে তিনি কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবেন না, তবে বঙ্গবন্ধুকে তাঁর ক্ষোভের কথা জানাবেন।” (আনিসুজ্জামান, বিপুলা পৃথিবী, প্রথমা/২০১৫, পৃ. ১৪৬)।
অগাস্ট ট্র্যাজেডি ও ড. কামাল হোসেন
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট যেদিন সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়, ড. কামাল হোসেন তখন যুগোস্লাভিয়ায়। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের পেরু সম্মেলনের প্রস্তুতিমূলক কাজের ব্যাপারে সেখানে গিয়েছিলেন ঘটনার কয়েক দিন আগে। তাকে সেখানে যেতে বলা হয়েছিল কারণ প্রেসিডেন্ট টিটোর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বেশ ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। ড. কামাল বলছেন, “যুগোস্লাভিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমাকে জানালেন, আপনি অনুগ্রহ করে আসুন। আগস্টে লিমায় অনুষ্ঠেয় সম্মেলনের বিষয়বস্তু ও ঘোষণাপত্র প্রস্তুত করতে হবে। ১০ আগস্ট আমি বেলগ্রেড গেলাম এবং আমি সেখানেই ছিলাম। শেখ মুজিব বলেছিলেন, যেহেতু তারা এত আগ্রহ দেখাচ্ছে, আপনি যান। কিন্তু সময়মতো চলে আসতে বললেন তাঁর সঙ্গে ভারত সফরে যাওয়ার জন্য।”
অগাস্ট ট্র্যাজেডির খবর তিনি কীভাবে শুনলেন এবং কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল? ‘সকালবেলা খবর পেলাম যে সাংঘাতিক খারাপ ঘটনা ঘটেছে। একটি ক্যু সংঘটিত হয়েছে এবং শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। আমি তখনই বনে (জার্মানির শহর) চলে গেলাম। কারণ, শেখ মুজিবের কন্যা, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, তখন সেখানে ছিলেন, তার স্বামী সেই সময় বনে গবেষণারত ছিলেন। যদিও আমি ঢাকায় ফিরে আসব বলে ঠিক করেছিলাম, তারপর ভাবলাম, আমার বনে গিয়ে সেখানকার অবস্থা দেখে আসা উচিত। আমি সেখানে গেলাম এবং সারাটা দিন শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানার সঙ্গে কাটালাম। তারা বললেন, আপনি নিশ্চয়ই আমাদের এখানে রেখে ফিরে যাবেন না? আমি বললাম, না, আমি আপনাদের আশ্বস্ত করতে পারি যে আমি সেটা করব না। তবে আমি লন্ডনে যাচ্ছি। কারণ, সেখানে আরও অনেক তথ্য পাওয়া যাবে। যদি আমাকে ফিরে যেতেই হয়, আমি অবশ্যই দেখব যেন আপনারা নিরাপদে এবং সম্মানের সঙ্গে ফিরে যেতে পারেন এবং সেটা নিশ্চিত না করে আমি কখনোই ফিরে যাব না।”
ড. কামাল বলছেন, “১৫ আগস্ট ঘটনাটা ঘটল, ১৬ তারিখ আমি তাদের সঙ্গে দেখা করলাম এবং ১৭ তারিখে আমি লন্ডনে গেলাম। বাংলাদেশ দূতাবাসে আমি আমার কূটনৈতিক পাসপোর্ট জমা দিয়ে বললাম, যে সরকার ক্ষমতা দখল করেছে, তার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। তারা বলল, না, সে প্রশ্নই ওঠে না।…সেই সময়টায় অনেকটা দৈব ঘটনার মতোই অক্সফোর্ড থেকে একটা ফোন এল এবং আমাকে একটি গবেষণা ফেলোশিপের আমন্ত্রণ জানানো হলো।” (সম্মাননাগ্রন্থ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮০)।
পরবর্তী রাজনৈতিক জীবন
১৯৮১ সালের ১৫ নভেম্বর ড. কামাল হোসেন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন ড. কামাল হোসেন। তবে তিনি বিএনপির প্রার্থী বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের কাছে হেরে যান।
১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৪ (আওয়ামী লীগ) আসন থেকে নির্বাচন করে হেরে যান। ওই আসনে ভোটার ছিল ৮১ হাজার ৫৯০। ড. কামাল পান ২৫ হাজার ৭২৩ ভোট।
১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ঢাকা-১১ (আওয়ামী লীগ) থেকে নির্বাচন করেও হেরে যান। এই আসনে মোট ভোটার ছিল ২ লাখ ৪১ হাজার ১৪২। তার প্রাপ্ত ভোট ৪৭ হাজার ৭৫০।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয় ইস্যুতে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার সঙ্গে ড. কামালের দূরত্ব তৈরি হয়। শেখ হাসিনা নির্বাচনে ‘সূক্ষ্ম কারচুপির’ অভিযোগ আনলেও ড. কামাল হোসেন তখন বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে'। এ সময় আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকর্মী প্রকাশ্যে কামাল হোসেনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। কামাল হোসেনেরও কিছু কিছু মন্তব্যে আওয়ামী লীগ-নেতৃত্বের তীব্র সমালোচনা প্রকাশ পায়। অবস্থা এমনই দাঁড়ায় যে, তার পক্ষে আওয়ামী লীগে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে। অবশেষে ড. কামাল হোসেন ১৯৯৩ সালের অগাস্ট মাসে গণতান্ত্রিক ফোরাম গড়ে তুললে পরের মাসে তাকে আওয়ামী লীগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া। গণতান্ত্রিক ফোরাম পরবর্তীতে ‘গণফোরাম’ নামে রাজনৈতিক দলে রূপ নেয়—যে দলে সংবিধান প্রণয়ন কমিটির আরও তিন সদস্য ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ ও আব্দুর রউফ যোগ দেন।
১৯৯৬ সালের নির্বাচনেও হেরে যান কামাল হোসেন। এরপর দেশের নানা ইস্যুতে তিনি সোচ্চার থাকলেও আর কোনো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি। অবশেষে ২০২৩ সালের ২৭ অক্টোবর রাজনীতিকে বিদায় জানান কামাল হোসেন। এদিন জাতীয় প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে তিনি বলেন, “দলের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আপনাদের নিয়ে পথ চলেছি, জাতীয় সমস্যা ও সংকট নিরসনে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার চেষ্টা করেছি। এখন আমার বয়স এবং শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় আর সক্রিয়ভাবে সভাপতির দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় আমি সমস্ত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে তথা গণফোরামের সভাপতি পদ থেকে অব্যাহতি নেয়ার ঘোষণা দিচ্ছি।”
পরিবার
ড. কামাল হোসেন ১৯৬৫ সালে মানবাধিকারকর্মী হামিদা হোসেনকে বিয়ে করেন। এই দম্পতির দুই মেয়ে। বড় মেয়ে সারা হোসেন বাবার মতোই আইনজীবী। আর ছোট মেয়ে দিনা হোসেন চলচ্চিত্রনির্মাতা।
প্রসঙ্গত, সংবিধান প্রণয়ন কমিটির ৩৪ সদস্যের মধ্যে চারজন এখনও জীবিত। ড. কামাল হোসেন ছাড়া বাকি তিনজন হলেন ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ এবং আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরী (দীর্ঘদিন যাবৎ অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী)।