তাদের ভাষায়, এই পথনকশায় মূল বিষয়টিই ‘অস্পষ্ট’ ও ‘অনির্দিষ্ট থেকে গেছে।
Published : 17 Apr 2025, 12:34 AM
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের যে ‘রোডম্যাপ’ বা পথনকশা কর্তৃপক্ষ প্রকাশ করেছে, সেখানে সুনির্দিষ্ট ভোটের তারিখ না থাকায় হতাশা প্রকাশ করেছে ক্যাম্পাসে সক্রিয় ছাত্র সংগঠনগুলো।
পথনকশায় বলা হয়েছে, আগামী মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করে তারপর ভোটার তালিকা চূড়ান্ত করা হবে। সব প্রস্তুতি সেরে নির্বাচন কমিশন ভোটের তফসিল ঘোষণা করবে।
সেই তফসিল কবে ঘোষণা করা হবে, আর নির্বাচন কবে হবে, তার কোনো সম্ভাব্য সময়সূচি পথনকশায় না থাকায় সন্তুষ্ট হতে পারছে না ছাত্র সংগঠনগুলো। তাদের ভাষায়, এই পথনকশায় মূল বিষয়টিই ‘অস্পষ্ট’ ও ‘অনির্দিষ্ট থেকে গেছে।
বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সভাপতি নূজিয়া হাসিন রাশা বলছেন, এই রোডম্যাপ দেখে তার মনে হচ্ছে, প্রশাসন কার্যত ডাকসুর কার্যক্রমকে ‘ঝুলিয়ে’ দিয়েছে।
কোনো অংশীজনের সঙ্গে ‘আলাপ না করেই’ নিজেদের মত করে একটি ‘অস্পষ্ট’ সময়সীমা ঘোষণা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
রাশা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “৫ অগাস্টের পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বারবার অগণতান্ত্রিক আচরণ করে চলেছে, সেটা তোফাজ্জল হত্যাকাণ্ডের বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে হোক, কিংবা সন্ত্রাসী ছাত্রলীগের তালিকা প্রকাশের প্রশ্নে।
“শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত করতে একটি কার্যকর ছাত্র সংসদের বিকল্প নেই। অথচ প্রশাসন একের পর এক টালবাহানা করে ডাকসু পেছাচ্ছে। এমনকি ডাকসুর পূর্বশর্তগুলো পূরণেও তারা ব্যর্থ।”
শতবর্ষী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এখন পর্যন্ত ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়েছে ৩৭ বার। এর মধ্যে ২৯ বারই হয়েছে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলের ৫০ বছরে। স্বাধীন দেশে ৫৩ বছরে মাত্র ৮ বার ভোট দেখেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
১৯৭৩ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ অনুসারে, প্রতি বছর ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। ডাকসু মনোনীত পাঁচ শিক্ষার্থী প্রতিনিধি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম সিনেটের সদস্য হন। তারা শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সমস্যা ও সুযোগের বিষয় তুলে ধরেন সিনেটে।
সববেশ ডাকসু নির্বাচন হয়েছিল ২০১৯ সালে। সেই সংসদের মেয়াদপূর্তির পর পেরিয়ে গেছে আরো পাঁচ বছর। নির্বাচন না হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটে থাকছে না শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব।
নূজিয়া হাসিন রাশা বলেন, ডাকসুর গঠনতন্ত্র সংশোধন প্রস্তাব প্রতিটি সংগঠনই জমা দিয়েছিল। প্রায় সকলেরই একটি প্রধান দাবি ছিল ভিসির ‘একচ্ছত্র ক্ষমতা’ খর্ব করা।
“কিন্তু প্রশাসনের পক্ষ থেকে যে গঠনতন্ত্রের খসড়া দেওয়া হয়েছে, সেখানে ভিসির ক্ষমতা একটুও কমানো হয়নি। আরও উদ্বেগজনক বিষয় হল, এই খসড়াটি কোনো আলোচনা বা মত বিনিময় ছাড়াই সিন্ডিকেটে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে–যে সিন্ডিকেটে কোনো ছাত্র প্রতিনিধি নেই!”
ছাত্র মৈত্রীর সভাপতির ভাষায়, ছাত্রশূন্য এই সিন্ডিকেট ‘অবৈধ ও অপূর্ণাঙ্গ’। ফলে সেখান থেকে আসা সিদ্ধান্তগুলোও ‘অগণতান্ত্রিক’।
ডাকসু নির্বাচনের পথনকশা ঘোষণাকে ‘ইতিবাচক’ হিসেবে দেখলেও ‘দীর্ঘসূত্রতা দুঃখজনক’ বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবিরের সভাপতি এস এম ফরহাদ।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরকে তিনি বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে অংশীজনদের প্রয়োজনীয় মিটিং সম্পন্ন হলেও এখনো পর্যন্ত গঠনতন্ত্রের চূড়ান্ত কপি প্রকাশ করা হয়নি। নির্বাচন কমিশন গঠন ও ভোটার তালিকা প্রস্তুত করতে আন্তরিকতা থাকলে মে মাস পর্যন্ত সময় লাগার কথা নয়।”
তার ভাষায়, দ্ব্যর্থবোধক’ নির্দেশনা ও ‘অস্পষ্ট’ শব্দচয়নে তৈরি ওই পথনকশা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ‘নাটকীয়তার শামিল’।
ডাকসু নির্বাচন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অসমাপ্ত প্রতিটি কাজের জন্য সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করার দাবি জানান ফরহাদ।
সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সভাপতি সালমান সিদ্দিক বলেন, “৫ অগাস্ট পরবর্তী আমরা একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পেয়েছি। গণতান্ত্রিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য ছাত্র সংসদ ও ডাকসু নির্বাচন বিশেষ জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যে উদ্যোগটা নিয়েছে আমরা সেটাকে সাধুবাদ জানাই।
“তবে প্রশাসন যে পথনকশাটা দিয়েছে সেখানে কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। যে কাজগুলো হয়েছে সেটা পথনকশায় তুলে ধরেছে। নির্বাচন কমিশন কবে গঠন হবে তা বলেছে, কিন্তু নির্বাচনের পুরো প্রক্রিয়াটা কেমন হবে তা আসলে স্পষ্ট হয়নি। আমরা মনে করি নির্বাচনটা কবে হবে সেটা খুব দ্রুতই প্রকাশ করা দরকার।”
এ নির্বাচন যেন সুষ্ঠ হয়, একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশে হয় এবং ছাত্র সংগঠনগুলোর সহাবস্থান যেন নিশ্চিত হয়, সে বিষয়গুলো প্রশাসনকে দেখার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
ছাত্রফ্রন্টের সভাপতি বলেন, “২০১৯ সালে যে নির্বাচন হয়েছে সেটা মূলত প্রহসনের নির্বাচন ছিল। সেখানে ছাত্ররা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে তাদের ভোট দিতে পারেনি। তাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যেন বিষয়টি মাথায় রাখে, যাতে এ নির্বাচন প্রহসনের নির্বাচন না হয়।”
তিনি বলেন, “যে পথনকশা ঘোষণা করেছে প্রশাসন, তার সীমাবদ্ধতাগুলো দূর করা হোক। অর্থাৎ তফসিল ঘোষণা ও নির্বাচনের একটি নির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করা হোক।”
একই দাবি জানিয়ে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ ঢাবি শাখার আহ্বায়ক তাহমিদ আল মুদাসসির চৌধুরী বলেন, “ডাকসু নির্বাচন কবে হবে, তফসিল ঘোষণা কবে হবে এরকম পূর্ণাঙ্গ একটি ‘পথনকশা’ আশা করেছিলাম, যেটা আমরা পাইনি। এটা নিয়ে আমাদের মধ্যে কিছুটা হলেও হতাশা আছে।
“এখানে কালক্ষেপণের অবকাশ আছে। আগামী মে মাসের মধ্যে তফসিল ঘোষণা করা হোক– এটাই আমরা চাই।”
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় সাহস বলেন, ঘোষিত পথনকশায় গঠনতন্ত্র সংশোধন ও নির্বাচন অনুষ্ঠান সংক্রান্ত আলোচনার প্রক্রিয়াটিকে ‘স্বচ্ছতরভাবে’ সকলের সামনে তুলে ধরা হয়েছে যা ‘আপাতদৃষ্টিতে ইতিবাচক’।
“কিন্তু সংস্কার প্রক্রিয়া ও সংস্কারের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং নির্বাচনের আচরণবিধি নির্ধারণের নানা বিষয়ে এখনও অস্বচ্ছতা বিদ্যমান।”
তিনি বলেন, “কীসের ভিত্তিতে সিদ্ধান্তসমূহ চূড়ান্ত করা হয়েছে? চূড়ান্ত হিসেবে প্রচারিত সিদ্ধান্তসমূহের বিষয়েও সকলের মত প্রকাশের বিষয় রয়েছে। না হয় এসব বিষয় নিয়ে পরবর্তীতে জটিলতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির সুযোগ থেকে যাবে।”
প্রশাসনের ভাবনা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা বলছেন, নির্বাচন নিয়ে তারা ‘গড়িমসি’ করছেন–এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই।
“আমরা নির্বাচন নিয়ে ধাপে ধাপে এগোচ্ছি। ইতোমধ্যে আমরা ধাপে ধাপে কাজগুলোকে গুছিয়ে এনেছি। বলতে গেলে, শিক্ষার্থীসহ অংশীজনদের সাথে আমরা ধাপে ধাপে বসেছি। তাদের মতামত নিয়েছি। আমাদের প্রাথমিক কাজগুলো প্রায় শেষ হয়েছে।
“আর কয়েকটা কাজ বাকি আছে, সেগুলো শেষ করে উপাচার্য ও নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণা করবেন। তারপরেই নির্বাচনের একটা নির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করা যাবে।”
উপ-উপাচার্য বলেন, অংশীজনদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে আলোচনা, ডাকসুর গঠনতন্ত্র সংশোধন কমিটির ছয়টি সভা, ডাকসু নির্বাচনের আচরণবিধি রিভিউ কমিটির সাতটি সভা এবং পরামর্শ কমিটির নয়টি সভা হয়েছে।
“ছাত্র সংগঠনগুলোর মতামতও নেওয়া হয়েছে। প্রভোস্ট, ডিন, বিভাগের চেয়ারম্যান, ইনস্টিটিউটের পরিচালকের লিখিত মতামত চলতি মাসের মধ্যে শেষ করা হবে। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে নির্বাচন কমিশন গঠন এবং দ্বিতীয় সপ্তাহে ভোটার তালিকা প্রস্তুত করা হবে। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করবে।”
দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে ডাকসু নির্বাচন না হওয়ায় পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল ডাকসু ভবন। সেখানকার বিভিন্ন সরঞ্জাম ও আসবাবপত্র অনেকটা নষ্ট হয়ে গেছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
গত বছর অগাস্টে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বন্যা হলে ডাকসু ভবনকে ত্রাণ সংরক্ষণের কাজে ব্যবহার করেছে শিক্ষার্থীরা। এরপর থেকে ভবনটি অনেকটা পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে।
এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা বলেন, “আমরা বিষয়টি নিয়ে ভাবছি। আশা করি ডাকসু নির্বাচনের আগে আমরা এটাকে সংস্কার করব। যা যা প্রয়োজন তা নিয়ে আমার কাজ করছি।”