সাগরযাত্রা, অতঃপর হংকংয়ে দেড়দিন

ছেলেবেলায় পাঠ্যবইয়ের একটা কবিতার প্রতি মোহাচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিলাম- 'বাণিজ্যেতে যাবো আমি সিন্দাবাদের মতো...'। কবিতাটার সাথে অনেক রঙিন ছবি ছিল। সমুদ্রে বিশাল ঢেউয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সিন্দাবাদের ময়ূরপঙ্খী জাহাজ।

মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান খান, ভিয়েতনামের হো চি মিন সিটি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Nov 2016, 01:23 PM
Updated : 1 Nov 2016, 01:25 PM

বাণিজ্যের প্রতি আকর্ষণ ছিল না। কিন্তু শৈশব থেকে সবসময় স্বপ্ন ছিল, বড় হয়ে আমিও দেশ-বিদেশে ঘুরব সমুদ্র পথে। সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় দেশ-বিদেশের কিছু অংশ আকাশপথে ঘোরা হলেও সমুদ্র ভ্রমণের ইচ্ছা তাই অপূর্ণই ছিল।

সময়ের প্রয়োজনে ম্যাকাও থাকতে হয়েছিল কিছুদিন। তখন দেখলাম, ম্যাকাও থেকে হংকং যাওয়া যায় সমুদ্রপথে। ব্যস, মনে হল এইতো সুযোগ!

পরিকল্পনা করলাম কোনও এক সাপ্তাহিক ছুটির দু'দিন হংকং-এ কাটিয়ে আসব। সেই সাথে শৈশবের স্বপ্ন সমুদ্রভ্রমণ।

শীতের এক সকালে ম্যাকাওয়ের ‘তাইপা ফেরিঘাট’ থেকে ‘কোতাই ওয়াটার জেট’ (অত্যন্ত দ্রুত গতির জলযান)-এ চেপে বসলাম। বৃষ্টি হচ্ছিল, সেই সাথে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা বাতাস। সমুদ্রও ছিল উত্তাল। প্রকাণ্ড সব ঢেউ কাটিয়ে তীব্রবেগে আমাদের ছোট জাহাজটা এগিয়ে চলছিল। আর আমি রোমাঞ্চিত হচ্ছিলাম দক্ষিণ চীন সাগরের (প্রশান্ত মহাসাগরের অংশ) নীলাভ উত্তাল রূপে।

কিছুক্ষণ পরপরই চোখে পড়ছিল ছোট ছোট দ্বীপ আর বিশালাকারের মালবাহী জাহাজ। ঠিক এক ঘণ্টায় হংকং উপকূলে পৌঁছে গেলাম। ইমিগ্রেশন পার হয়ে দেখতে বের হলাম হংকং, এশিয়ার অন্যতম উন্নত শহর।

পুরো হংকং মেট্রোরেল দিয়ে যুক্ত। যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব সহজ। এছাড়া শহরের মধ্যে রয়েছে ট্রাম। আমি আসার আগে ‘অক্টোপাস’ নামের বিশেষ ধরণের কার্ড সংগ্রহ করেছিলাম, সেটা ১০০ হংকং ডলার খরচ করে ‘রিচার্জ’ করিয়ে নিলাম। এই কার্ড মেট্রো, ট্রাম, বাস এমনকি বিভিন্ন দোকানেও ব্যবহার করা যায়।

সময় খুব কম। তড়িঘড়ি করে বের হলাম। মেট্রো ধরে চলে এলাম ‘ভিক্টোরিয়া গার্ডেন’র ট্রাম স্টেশনে। ট্রামে চড়ে ‘ভিক্টোরিয়া পিক’-এ। এটা হল হংকং-এর ঠিক মাঝখানের পাহাড়, যার চূড়া থেকে সমস্ত হংকং দেখা যায়। খুব ভীড়, ট্রামের জন্য বিশাল লম্বা লাইন থাকে এখানে।

যারা হংকং এ ঘুরতে আসেন, তারা প্রায় সবাই এখানে একবার আসেন। হংকং-এর ‘স্কাই ভিউ’ দেখা শেষে গেলাম ‘আর্থ ভিউ’ দেখতে। শহরের একটা অংশ এমাথা-ওমাথা ঘুরে ফেললাম ট্রামে চেপে। 

এক রাত থাকার জন্য ঠিক করেছিলাম ‘কোলুন’-এর একটা মোটেলে। এখানে এসে দেখি পুরো এলাকা জুড়ে রয়েছে অসংখ্য বাংলাদেশি, আরবিয়, পাকিস্তানি, মালয়েশিয়, ভারতীয় লোকজন। আশেপাশে অনেক পরিচিত ধরনের খাবার দোকান, বিশেষ করে ‘সিম সা সুই’ স্টেশনের পাশে ‘চুংকিং’ ম্যানশনে। পাশেই ‘কোলুন’ মসজিদ এবং ইসলামিক সেন্টার।

মুগ্ধ হয়ে গেলাম মসজিদের বিশালতা, সৌন্দর্য এবং নিয়মিত নামাজে আসা মুসল্লিদের পরিমাণ দেখে। পাশেই ছেলে এবং মেয়েদের জন্য আলাদা দুটো মাদ্রাসা।

বিকেলটা ঘুরলাম ব্যস্ততম ‘ভিক্টোরিয়া হার্বারে'র তীরে। ছোট-বড়, আধুনিক-পুরনো যুগের অসংখ্য জাহাজ।

সন্ধ্যায় দুই পুরনো চীনা বন্ধুর সাথে খাওয়া-দাওয়া করলাম এক আরবিয় খাবার দোকানে।

তারপর আর কিছুক্ষণ ‘ভিক্টোরিয়া হার্বারে'র দিকে কাটিয়ে বেশ সুন্দর এক সন্ধ্যা শেষে রাতের আলো ঝলমলে হংকং দেখে মোটেলে ফিরলাম।

এক রুমে চারজন, সবাই সবার অপরিচিত- এ অভিজ্ঞতা এই প্রথম! কিন্তু কি আর করা! হংকং অসম্ভব রকমের ব্যয়বহুল।

দ্বিতীয় দিনের জন্য ঠিক করেছিলাম ‘আর্ট মিউজিয়াম’ আর ‘স্পেস মিউজিয়াম’ ঘুরে দেখব। কিন্তু হল না। নির্মাণ কাজের জন্য দুটোই বন্ধ।

চলে গেলাম ‘ল্যানটাউ’ দ্বীপে। হংকং এর বিখ্যাত ‘ডিজনিল্যান্ড’ সেখানে। শিশু-কিশোর থেকে যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা হাজারো মানুষের সমারোহ এখানে। মিকি মাউস আর টম-জেরিরা ঘুরে ঘুরে সবাইকে অভিবাদন জানাচ্ছে। কিছুক্ষণের জন্য নিজেও মনে হয় শিশু হয়ে গেলাম।

‘সানি বে’ আর ‘টুংচুং’ এ অল্প কিছুক্ষণ ঘুরে ফিরে এসে যোহরের নামাজ শেষ করে খাওয়া-দাওয়া হল এক মালয়েশিয় খাবার দোকানে। এর আগে সকালের নাস্তা হয়েছিল আফগান পাঠানদের দোকানে। বেশ চমৎকার এদের খাওয়া-দাওয়া।

ফেরার টিকেট ছিল বিকাল সাড়ে পাঁচটায়। আড়াইটার মধ্যেই চলে এলাম। স্টেশনে এক মগ কফি শেষ করে ইমিগ্রেশন পার হয়ে দেখি তিনটার জাহাজ ঘাটে। আমার চীনা বন্ধু বলল, ‘এটাতেই চলে যাও’।

জানালার পাশে সিট পেয়ে গেলাম। ভালোই হল। সন্ধ্যার মধ্যেই পৌঁছনো যাবে। আবার শুরু হল সমুদ্র ভ্রমণ। সংক্ষিপ্ত কিন্তু রোমাঞ্চকর।

লেখকের কথা

আমি লেখক নই। সাহিত্যজ্ঞানও শূন্যের কোটায়। বিজ্ঞানের ছাত্র। বৈচিত্র্যময় জীবনের নানা বাঁকের ছোট ছোট টুকরো কিছু ঘটনা মাঝে মাঝে দিনপঞ্জিতে লিখি, এই আর কি। পড়াশোনা এবং জীবিকার তাগিদে বেশ কিছুদিন ধরেই প্রবাসে। এই মুহূর্তে আছি ভিয়েতনামের হো চি মিনে। মাঝে কিছু সময় কাটিয়েছি ম্যাকাওতে। তখন একবার ঘুরতে গিয়েছিলাম হংকং এ, সাগরপথে। সেই অভিজ্ঞতারই সংক্ষিপ্ত রূপ এখানে। 

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি