হো চি মিনের নানা রঙের মানুষ

মানুষই বোধহয় সবচেয়ে বিচিত্র প্রাণী। নানা বর্ণের, নানা ভাষার। তার চেয়েও বেশি বিচিত্র তার আচরণ। একই দেশের, একই চেহারার, একই পেশার মানুষের আচরণে কত পার্থক্য! কিংবা সময়ভেদে অবস্থাভেদে একই মানুষ হয়ত তার রঙ বদলায়। মানুষের এই নানা রঙ আমাকে বরাবরই চমৎকৃত করে।

মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান খান, ভিয়েতনামের হো চি মিন থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Dec 2016, 01:07 PM
Updated : 13 Dec 2016, 04:07 PM

এক.

কিছুদিন আগে, এক সন্ধ্যার পরে হো চি মিন শহরের কেন্দ্র (ডিসট্রিক্ট ১) থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসব। শেষ বাস চলে গেছে। উপায় না দেখে মোটর-সাইকেলে চেপে বসলাম। আমাদের দেশে যেমন রিক্সায় চলাচল করা হয়, হো চি মিনে তেমনি মোটর-সাইকেল। ভাড়া ঠিক করেছিলাম ৪০ হাজার দং (ভয় পাবেন না, ১৩৬ টাকা মাত্র)।

ক্যাম্পাসের গেইটে এসে চালককে এক লাখ দং এর নোট (সাড়ে তিনশ' টাকা) দিলাম। সে উল্টো দিকে ঘুরে ৩০ সেকেন্ড সময় নিয়ে টাকা নাড়াচাড়া করে আমার দিকে তাকিয়ে ১০ হাজার দং এর নোট দেখিয়ে বলে আমি নাকি ওটা দিয়েছি! চিল্লাচিল্লি শুরু করল। লজ্জা আর অপমান কাটাতে ওকে আরো ৩০ হাজার দং দিয়ে বিদায় করলাম। ব্যাটা, আমার ৯০ হাজার দং জোচ্চুরি করে মেরে দিলো! ভাবলাম, ধুর এখানে আর মোটর-সাইকেলেই উঠবো না।

কিন্তু উঠতে হয় মাঝে মাঝে। বিশেষ করে তাড়া থাকলে, আর বাস না পেলে। ক'দিন আগে দুপুরে জুমা’র নামাজ থেকে ফিরলাম মোটর-সাইকেলে। চালকের হাতে হেলমেট জমা দিয়ে ভাড়া মিটিয়ে গেট দিয়ে ঢুকছি। সে জোড়ে 'ফ্রেন্ড' বলে ডাক দিল। দেখি নিচ থেকে কুড়িয়ে ৫০ হাজার দং এর নোট আমার হাতে দিচ্ছে! আমি টাকা বের করার সময় পড়ে গেছে।

আরেক সন্ধ্যায় ডিসট্রিক্ট ১ থেকে ফিরছি। ট্যাক্সিতে। আমার এক সহকর্মী সাথে। সেও বিদেশি। সাধারণত ওখান থেকে আমাদের ক্যাম্পাসের ভাড়া হয় ৮০-৮৫ হাজার দং। কিন্তু চালক সাহেব রাস্তা ভুল করে অনেক ঘুরিয়ে আনলেন।

সময় বেশি লাগল ১০ মিনিট। ভাড়া উঠল এক লাখ ৩৫ লাখ দং। বেশ বিরক্ত হলাম। আমার সহযাত্রী ইংরেজি আর জার্মান মিলিয়ে আস্তে আস্তে গালি-গালাজ করতে শুরু করল। নেমে চালককে জিজ্ঞাসা করলাম, এইভাবে ঘুরিয়ে আনার আর ভাড়া বেশি ওঠার কারণ?

সে মাথা নিচু করে বলল ভুল হয়ে গেছে, সে ভুল রাস্তায় ঢুকে পড়েছে। টাকা বের করলাম। সে এক লাখ দং এর নোট নিয়ে বলল, আর দিতে হবে না। আমি বললাম, সমস্যা নেই, নাও; ভুলই তো হয়েছে। নাহ, সে নিলো না!

দুই.

বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ছোট ছোট অনেক খাবারের দোকান। ছাত্র-ছাত্রীরা সেখানে খায়। আমি আর আমার আরেক বিদেশি সহকর্মী মাঝে মাঝে সখ করে সেখানে খেতে যাই। এখানকার খাবার-দাবার বেশ সস্তা। বেশিরভাগ সময়েই যেখানে যাওয়া হয়, সেটা অপেক্ষাকৃত ছোট দোকান এবং জৌলুশহীন। তবুও যাই। ভাল লাগে।

প্রথম দিন থেকেই ওরা জানে, আমি এখানে মাংস ছুঁইনা। আলাদা করে রাখা কাঁচা সবজি আর মাছ নামিয়ে নতুনভাবে খাবার তৈরি করে দেয়। তিন প্রজন্মের তিন নারী এই দোকান চালান। এক বৃদ্ধা, তার তরুণী কন্যা আর তরুণীর কোলে ছোট এক মেয়ে। বেশ ভালো লাগে এদের আপ্যায়ন।

পাশের আরেক খাবারের দোকানে একবার ঢুকেছিলাম। অপেক্ষাকৃত বড় আর আলোকজ্জ্বল। ভাত, মাছ আর সবজি চাইলাম। শুকরের মাংসের পাত্রে রাখা চামচ উঠিয়ে তিনি আমাকে মাছ দিল।

বুঝিয়ে বললাম, আমরা শুকরের মাংস খাই না, তাই এর ঝোলমাখা মাছ খাওয়া যাবে না। অনুরোধ করলাম, পরিবর্তন করে দিতে। সে ক্ষেপে গিয়ে উল্টা-পাল্টা বলা শুরু করল। আমি খাবারের দাম জিজ্ঞাসা করে খাবার না ছুঁয়েই দাম দিয়ে বের হয়ে এলাম!

তিন. 

সপ্তাহে একদিন 'ব্যাক-প্যাকারস এরিয়া'তে যাই খেতে। সাথে আরও কয়েকজন বাংলাদেশি থাকে। এই এলাকা খুব ব্যস্ত আর এখানে বিভিন্ন দেশি, বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের দেখা মেলে। অনেক ভিয়েতনামিজও আছে। বিভিন্ন পেশার বিভিন্ন বয়সের মানুষ ধান্দায় ঘোরে এখানে। কয়েকজন বৃদ্ধার দেখা মেলে। ছোট ডালায় সস্তা দরের কিছু পণ্য সাজিয়ে বিদেশিদের পেছনে ঘোরে।

"হ্যালো, হ্যালো, প্লিজ বাই"- হয়ত এই তিনটি শব্দই শিখেছে। হাত দিয়ে ইশারা করে মুখ আর পেট দেখায়। বৃদ্ধাদের চোখে পণ্য বিক্রির আকুতি আর ক্ষুধার মিশ্র দৃষ্টি।

পাশেই কিছু পরপর সাজু-গুজু করা তরুণীদের দেখা মেলে। হাতে লিফলেট নিয়ে তারা 'হ্যাল্লো, ম্যাসাজ' বলে ডাকে, যদিও শুধু ম্যাসাজ নয় তারা আরো কিছুর উদ্দেশ্যে ডাকে।

সবই ক্ষুধার জ্বালা আর পেট ভরাবার জন্য কিংবা আরও একটু আয়েশি জীবনযাপনের জন্য। কেউ বেচতে চায় কষ্টে বানানো ক্ষুদ্রশিল্প-সম্পদ, কেউ বেচতে চায় সৃষ্টিকর্তার তৈরি করা সম্পদ।

চার.

হো চি মিন শহরে প্রচুর টুরিস্ট আসে। বিশেষ করে ডিসট্রিক্ট ১- এ প্রচুর বিদেশি দেখা যায়। ধবধবে সাদা, লালচে সাদা, বাদামী, শ্যামলা, কালো বিভিন্ন বর্ণের; কেউ লম্বা, কেউ খাটো; কেউ মোটা, কেউ চিকন। তারা বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে।

অধিকাংশই জোড়ায় জোড়ায়। কেউ যুবক-যুবতী, কেউ বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। কেউ কেউ যেখানে সেখানে পরস্পরের অন্তরঙ্গ হয়, কেউ শুধু হাত ধরাধরি করে হাঁটে। কেউ ছোট ছোট পোশাকে, কেউ পুরো শরীর ঢেকে। অনেকেই আসে একা। এসে দুদিনের জন্য সঙ্গী জুটিয়ে নেয়। টাকার বিনিময়ে সঙ্গী পাওয়া এখানে সহজ। দুদিন পরে যে যার পথে। দু’পক্ষই খুশি; কেউ সঙ্গী পেয়ে, কেউ রোজগার করে।

আরও কেউ কেউ একা আসে। আসতে হয়। প্রিয়জনদের প্রতি দায়িত্ব পালনের জন্য রোজগারের উদ্দেশ্যে। দিনের পর দিন তাদেরকে একা কাটাতে হয়। দুটো কথা বলার মত কেউ তাদের কাছে থাকেনা। তবুও ক্ষণিকের সঙ্গীর কথা তারা কোনভাবেই চিন্তাতেও আনেনা। দেশে ফেলে আসা প্রিয়তমা স্ত্রী আর আদরের সন্তানের প্রতি ভালোবাসা আর বিশ্বস্ততা কিংবা তার চেয়েও বেশি সৃষ্টিকর্তাভীতি তাদের কাছে অনেক বড়।  

সাইগন সেন্ট্রাল মসজিদের সামনে বসে আছি। জোহরের নামাজ শেষ। মসজিদের বারান্দায় ইমাম সাহেব বসেছেন। তার সামনে একজন পুরুষ আর একজন মহিলা। দু’জনের পরনেই লম্বা সাদা পোষাক। তাদের পেছনে আরও দুজন। ইমাম সাহেব বিয়ে পড়াচ্ছেন। বর বা কনে কেউ একজন নও-মুসলিম। কিছুক্ষণ বাদে তারা বেড়িয়ে আসলেন।

আমার পাশের গেট পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে নিচে চলে গেলেন। দু’জনে হাত ধরে। পরস্পরের মধ্যে ছোট ছোট কথা বলতে বলতে। আশপাশ- বাকি দুনিয়া তাদের কাছে এখন তুচ্ছ। বৈধ প্রেমের অদ্ভুত আনন্দের দীপ্তি তাদের চোখে মুখে। মহম্মদ রফি সাহেবের কণ্ঠে ওই গানের লাইন মনে পড়ে গেল- "কিসি সে প্যায়ার করকে দেখিয়ে, ইয়ে জিন্দেগি কিতনি হাসিন হ্যায়"।

পাঁচ.

আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে বাঙ্গালি নেই। খুব অল্প কয়েকজন মাত্র বিদেশি এবং তাদের সাথে আমার খুব কম কথা হয়। ভিয়েতনামিজদের ইংরেজিতে যে দক্ষতা, তাতে সহকর্মী এবং ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে প্রয়োজনের বাইরে তেমন একটা কথা হয়না।

যদিও স্বল্প কথায়, বেশি ইঙ্গিতে তাদের সাথে বেশ একটা হৃদ্যতার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, তবুও বাংলায় কথা না বলতে পারার কারণে কেমন যেন এক শুন্যতার সৃষ্টি হয় মনে।

বিদেশের মাটিতে তাই নিজ দেশি কাউকে পেলে তাকে নিজের রক্তের ভাইয়ের মতই মনে হয়। হো চি মিনে কয়েকজনের সাথে বেশ সুন্দর একটা ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে, এবং মূলত তা মসজিদকেন্দ্রিক।

শুক্রবারে জুমার নামাজে আমাদের দেখা হয়, কুশলাদি বিনিময় হয়। শনিবারে এবং রবিবারে একসাথে কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়। মসজিদে একসাথে আসর, মাগরিব আর এশার নামাজ আদায় করে কোন এক হালাল খাবারের দোকানে নৈশভোজ সেরে যে যার বাসায়। সারা সপ্তাহের জমানো কত কথা, গল্প সেরে ফেলা হয় এই সময়ে!

জীবন খুব ক্ষুদ্র এবং তাতে দুঃখ-কষ্ট, অস্থিরতার মাত্রাই বেশি। তবুও জীবনে আনন্দিত হবার মত অনেক কিছুই আছে। ছোট ছোট টুকরো কিছু আনন্দময় মুহূর্ত, পরষ্পরের প্রতি একটু সহানুভূতি, সহমর্মিতা, ভালোবাসা জীবনকে অনেক সুন্দর এবং আনন্দিত করে।

লেখকের কথা:

আমি লেখক নই। সাহিত্যজ্ঞানও শূন্যের কোটায়। বিজ্ঞানের ছাত্র। বৈচিত্র্যময় জীবনের নানা বাঁকের ছোট ছোট টুকরো কিছু ঘটনা মাঝে মাঝে দিনপঞ্জিতে লিখি, এই আর কি। পড়াশোনা এবং জীবিকার তাগিদে বেশ কিছুদিন ধরেই প্রবাসে। এই মুহূর্তে আছি ভিয়েতনামের হো চি মিনে। তবে চীনে ছিলাম এর আগে বেশ কিছুদিন। আমার অতি সাধারণ প্রবাস জীবনের সাধারণ কিছু টুকরো অভিজ্ঞতা, সাধারণ কিছু কথা বলার জন্যই এখানে লেখা।

মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান খানের আরও লেখা

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ, আড্ডা, আনন্দ বেদনার গল্প, ছোট ছোট অনুভূতি,  দেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!