আমি শুরুতে তেমন একটা ইচ্ছুক না হলেও শেষে রাজি হলাম দুটো কারণে। প্রথমত, লিউপানসুই একটা শৈল-শহর, আর পাহাড় আমাকে বরাবরই মুগ্ধ করে। দ্বিতীয়ত, চীনের কোন এক মুসলিম পরিবারকে একেবারে কাছ থেকে দেখা। আমাদের ধারণা ছিল, তাদের সাথে একবেলা খাওয়া-দাওয়া করব আর হয়ত শহর ঘুরে দেখতে তাদের একটু সাহায্য পাব।
লুঝৌ থেকে আমরা চারজন বাসে চেপে বসলাম। সহজ হিসেব, সবসময় প্লেনে ঘোরার মত যথেষ্ট অর্থকড়ি নেই। আর লুঝৌ থেকে ট্রেন নেই। সাথের দু’জন বাংলাদেশি ছাত্র- রাজু এবং সাদ। আর মুজাহিদ ভারতীয় বাঙালী।
চীনের প্রায় সব শহরেই কিছু না কিছু পাহাড়-পর্বত থাকে। কিন্তু ‘লিউপানসুই’- এ এসে অভিভূত হলাম। এখানে শহরের মাঝে পাহাড় নেই, বরং অসংখ্য পর্বতের মাঝে খণ্ড খণ্ড শহর।
আমাদের চীনা-বন্ধু ঝাং ছাইদং (তার ইসলামিক নাম নুরুল ইসলাম) সাথে যখন দেখা হল, তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। আমরা চরম ক্ষুধার্ত। সে আমাদের নিয়ে গেল শহরের প্রধান মসজিদের পাশে এক মুসলিম-খাবারের দোকানে। গরুর মাংসের সাথে স্থানীয় সবজি দিয়ে হটপট আর ভাত পেটপুরে খেলাম। খাওয়া শেষে পাশের মসজিদে গিয়ে ইমাম সাহেবের সাথে দেখা আর কুশলাদী বিনিময় সেরে আসরের নামাযের পরে আমরা বের হলাম।
আমাদের নিয়ে ঘোরার জন্য সে তার গাড়ি নিয়ে এসেছে। আমরা ভাবছিলাম, দীর্ঘ যাত্রার পরে হোটেলে গিয়ে একটু বিশ্রাম নিতে পারলে মন্দ হত না। কিন্তু সে আমাদের নিয়ে গেল মূল শহর থেকে অনেক দূরে। পর্বতের গায়ে আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে সে আমাদের নিয়ে যাচ্ছিল আর আমরা দেখছিলাম অনেক নিচে উপত্যকার মাঝে শহর।
বেশ সুন্দর এক আলো ঝলমলে জায়গায় আমরা সন্ধ্যা কাটালাম। পাহাড়ের গায়ে আর হ্রদের ধারে রঙ-বেরঙের আলো দিয়ে বিভিন্নভাবে সাজানো হয়েছে। এ শহরের মানুষেরা বিদেশি দেখে তেমন অভ্যস্ত নয়। পৃথিবীর ধনী দেশগুলোতে আমাদের গায়ের রঙের জন্য আমরা সমাদৃত না হলেও চীনে আমাদের ‘বিদেশী’ মেহমান হিসেবেই দেখা হয়। অনেক মানুষের ছবি তোলার আবদার মেটাতে হল।
খাওয়া শেষে হাসি-ঠাট্টায় গল্প-গুজব হল অনেক। তাদের একটা বড় অংশই ‘মান্দারিন’ ভাষা ব্যবহার করতে পারে না। কথা বলে ‘গুইঝৌ’-এর আঞ্চলিক ভাষায়। তাই ভাষা বোঝা- না বোঝা নিয়ে বেশ মজা হল। তাদের প্রস্তাব ছিল, আমরা যেন তাদের বাসায় থেকে যাই। কিন্তু আমরা ভেবে দেখলাম, এতে তাদের খুব কষ্ট হবে আর আমরাও সহজ বোধ করব না। তাই হোটেলে উঠলাম।
সারাদিনের ক্লান্তি আর ভরপেটের কল্যাণে বেশ সুন্দর একটা ঘুম হল। যদিও মাঝখানে দুই-তিন বার উঠতে হয়েছে। আমাদের মধ্যে দু’জন প্রতিযোগিতা করে নাক ডাকছিল (নাম উল্লেখ করলাম না)। এই বয়সে এমন নাসিকাগর্জন, ভাবাই যায় না!
পরদিন সকালে নুরুল ইসলাম আবার এসে হাজির গাড়ি নিয়ে। আমরা খেয়ে-দেয়ে বেরিয়ে পড়লাম ‘লিউপানসুই’-এর সৌন্দর্য দেখতে। সমস্ত দিন আমরা ঘুরে বেড়ালাম ‘মেইহুয়া শান’ আর ‘জিউছাইপিং’ পর্বতে।
পাহাড়ি পথে আমাদের ভ্রমণ করতে হয়েছে দুইশ’-তিনশ’ কিলোমিটার। দেখা হয়েছে এই দুই পর্বতের দর্শনীয় প্রায় সব জায়গা।
সন্ধ্যায় ফিরে আবার তার বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া। আবার আড্ডা। তারপর নিয়ে যাওয়া হল নুরুল ইসলামের চাচার বাড়িতে। পাশেই। আবার একপ্রস্থ খাওয়া-দাওয়া হল ফল-ফলাদি দিয়ে। সেই সাথে আড্ডা, হাসি আর ছবি তোলা।
সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যখন বের হলাম, তীব্র এক ভালোলাগা ও সম্মান অনুভব করছিলাম এই পরিবারের প্রতি। শেষ হয়েও যেন শেষ হচ্ছিল না। তাদের বাড়ি থেকে বের হয়ে গাড়িতে ওঠার আগে রাস্তার পাশে কাবাবের দোকানে ঢুকে আরেক প্রস্থ আপ্যায়ন চলল। আর সবশেষে হোটেলে পৌঁছে দিতে এসে সে আমাদের হোটেলের বিলও পরিশোধ করে দিয়ে গেল। ফেরত দিতে গেলাম। নেবে না। বলে এটা ‘হাদিয়া’ (ইসলামিক উপহার)।
আসার পথে এবং আসার পরে আমাদের সবার মুখে ঘুরে-ফিরেই আসে তাদের কথা। এই চীনা মুসলিম পরিবারের আতিথেয়তা জীবনেও ভুলব না। তাদের চিরকল্যাণ হোক, এই শুভ কামনা করি।
লেখক: চীন প্রবাসী
ছবি কৃতজ্ঞতা: মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান খান
মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান খানের আরও লেখা
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ, আড্ডা, আনন্দ বেদনার গল্প, ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |