এক চীনা মুসলিম পরিবারের আতিথেয়তার কথা

বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশি ছাত্রদের কয়েকজন এসে ধরল একসাথে একটু দূরে কোথাও থেকে ঘুরে আসার জন্য। ওরা জানালো, ‘গুইঝৌ’ প্রদেশের ‘লিউপানসুই’ শহরের কোনও এক মুসলিম বন্ধু আমন্ত্রণ জানিয়েছে।

মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান খান, চীনের লুঝৌ থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Feb 2017, 06:40 AM
Updated : 15 Feb 2017, 06:45 AM

আমি শুরুতে তেমন একটা ইচ্ছুক না হলেও শেষে রাজি হলাম দুটো কারণে। প্রথমত, লিউপানসুই একটা শৈল-শহর, আর পাহাড় আমাকে বরাবরই মুগ্ধ করে। দ্বিতীয়ত, চীনের কোন এক মুসলিম পরিবারকে একেবারে কাছ থেকে দেখা। আমাদের ধারণা ছিল, তাদের সাথে একবেলা খাওয়া-দাওয়া করব আর হয়ত শহর ঘুরে দেখতে তাদের একটু সাহায্য পাব।  

লুঝৌ থেকে আমরা চারজন বাসে চেপে বসলাম। সহজ হিসেব, সবসময় প্লেনে ঘোরার মত যথেষ্ট অর্থকড়ি নেই। আর লুঝৌ থেকে ট্রেন নেই। সাথের দু’জন বাংলাদেশি ছাত্র- রাজু এবং সাদ। আর মুজাহিদ ভারতীয় বাঙালী।

বাস যাত্রা আমাদের কারোরই তেমন পছন্দ নয়, তবে মন্দ লাগল না। যাত্রাপথের অধিকাংশ সময়েই পথের দু’পাশে উঁচু উঁচু পর্বত আমাদের সঙ্গ দিয়ে চলল। মাঝে মাঝে চোখে পড়ছিল উপত্যকা কিংবা পর্বতের গায়ে ছোট ছোট শহর। আমরা সম্ভবত সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অনেক উপর দিয়ে চলছিলাম। কারণ রাস্তার ধারে পর্বতের গায়ে মেঘেদের লুকোচুরি দেখতে পাচ্ছিলাম। ছয় ঘণ্টার যাত্রা আমাদের মনকে আনন্দিত করলেও শরীর খুব ক্লান্ত হয়ে এসেছিল।

চীনের প্রায় সব শহরেই কিছু না কিছু পাহাড়-পর্বত থাকে। কিন্তু ‘লিউপানসুই’- এ এসে অভিভূত হলাম। এখানে শহরের মাঝে পাহাড় নেই, বরং অসংখ্য পর্বতের মাঝে খণ্ড খণ্ড শহর।

আমাদের চীনা-বন্ধু ঝাং ছাইদং (তার ইসলামিক নাম নুরুল ইসলাম) সাথে যখন দেখা হল, তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। আমরা চরম ক্ষুধার্ত। সে আমাদের নিয়ে গেল শহরের প্রধান মসজিদের পাশে এক মুসলিম-খাবারের দোকানে। গরুর মাংসের সাথে স্থানীয় সবজি দিয়ে হটপট আর ভাত পেটপুরে খেলাম। খাওয়া শেষে পাশের মসজিদে গিয়ে ইমাম সাহেবের সাথে দেখা আর কুশলাদী বিনিময় সেরে আসরের নামাযের পরে আমরা বের হলাম। 

নুরুল ইসলাম একজন পুলিশ। সে বয়সে তরুণ। ইসলাম সম্বন্ধে তার জ্ঞান সাধারণ চীনা মুসলিমদের থেকে অনেক ভালো। সে বেশ সুন্দর আরবি বলে (বলা বাহুল্য, আমাদের সবার চেয়ে তার আরবিতে দক্ষতা অনেক বেশি)।

আমাদের নিয়ে ঘোরার জন্য সে তার গাড়ি নিয়ে এসেছে। আমরা ভাবছিলাম, দীর্ঘ যাত্রার পরে হোটেলে গিয়ে একটু বিশ্রাম নিতে পারলে মন্দ হত না। কিন্তু সে আমাদের নিয়ে গেল মূল শহর থেকে অনেক দূরে। পর্বতের গায়ে আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে সে আমাদের নিয়ে যাচ্ছিল আর আমরা দেখছিলাম অনেক নিচে উপত্যকার মাঝে শহর।

বেশ সুন্দর এক আলো ঝলমলে জায়গায় আমরা সন্ধ্যা কাটালাম। পাহাড়ের গায়ে আর হ্রদের ধারে রঙ-বেরঙের আলো দিয়ে বিভিন্নভাবে সাজানো হয়েছে। এ শহরের মানুষেরা বিদেশি দেখে তেমন অভ্যস্ত নয়। পৃথিবীর ধনী দেশগুলোতে আমাদের গায়ের রঙের জন্য আমরা সমাদৃত না হলেও চীনে আমাদের ‘বিদেশী’ মেহমান হিসেবেই দেখা হয়। অনেক মানুষের ছবি তোলার আবদার মেটাতে হল।   

ফিরে নুরুল ইসলামের বাসায় এসে দেখি পুরো পরিবার আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আর সেই সাথে বাহারি খাবার-দাবার। খাবারের রন্ধন প্রণালী আমাদের দেশিয় ঘরানার নয়। এমনকি সিচুয়ানের খাবার থেকেও অনেক ভিন্ন, কিন্তু বেশ ভাল লাগল।

খাওয়া শেষে হাসি-ঠাট্টায় গল্প-গুজব হল অনেক। তাদের একটা বড় অংশই ‘মান্দারিন’ ভাষা ব্যবহার করতে পারে না। কথা বলে ‘গুইঝৌ’-এর আঞ্চলিক ভাষায়। তাই ভাষা বোঝা- না বোঝা নিয়ে বেশ মজা হল। তাদের প্রস্তাব ছিল, আমরা যেন তাদের বাসায় থেকে যাই। কিন্তু আমরা ভেবে দেখলাম, এতে তাদের খুব কষ্ট হবে আর আমরাও সহজ বোধ করব না। তাই হোটেলে উঠলাম।

সারাদিনের ক্লান্তি আর ভরপেটের কল্যাণে বেশ সুন্দর একটা ঘুম হল। যদিও মাঝখানে দুই-তিন বার উঠতে হয়েছে। আমাদের মধ্যে দু’জন প্রতিযোগিতা করে নাক ডাকছিল (নাম উল্লেখ করলাম না)। এই বয়সে এমন নাসিকাগর্জন, ভাবাই যায় না! 

পরদিন সকালে নুরুল ইসলাম আবার এসে হাজির গাড়ি নিয়ে। আমরা খেয়ে-দেয়ে বেরিয়ে পড়লাম ‘লিউপানসুই’-এর সৌন্দর্য দেখতে। সমস্ত দিন আমরা ঘুরে বেড়ালাম ‘মেইহুয়া শান’ আর ‘জিউছাইপিং’ পর্বতে।  

‘মেইহুয়া শান’ অনিন্দ্য সুন্দর পর্বত। এখানে আছে খুব সুন্দর একটা মসজিদ, সমতল ভূমি থেকে অনেক উপরে পর্বত চূড়ায় বিশাল এক ‘ওয়াচ টাওয়ার’, আছে বেশ কতগুলো বাহারি নকশার হোটেল, টানেল। আর ‘জিউছাইপিং’ ২ হাজার ৯০০ মিটার উচ্চতা নিয়ে ‘গুইঝৌ’-এর সবচেয়ে উঁচু পর্বত। এই দুই পর্বতের ছবি আর সৌন্দর্য অন্য লেখায় বর্ণনা করব।

পাহাড়ি পথে আমাদের ভ্রমণ করতে হয়েছে দুইশ’-তিনশ’ কিলোমিটার। দেখা হয়েছে এই দুই পর্বতের দর্শনীয় প্রায় সব জায়গা। 

সন্ধ্যায় ফিরে আবার তার বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া। আবার আড্ডা। তারপর নিয়ে যাওয়া হল নুরুল ইসলামের চাচার বাড়িতে। পাশেই। আবার একপ্রস্থ খাওয়া-দাওয়া হল ফল-ফলাদি দিয়ে। সেই সাথে আড্ডা, হাসি আর ছবি তোলা।

সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যখন বের হলাম, তীব্র এক ভালোলাগা ও সম্মান অনুভব করছিলাম এই পরিবারের প্রতি। শেষ হয়েও যেন শেষ হচ্ছিল না। তাদের বাড়ি থেকে বের হয়ে গাড়িতে ওঠার আগে রাস্তার পাশে কাবাবের দোকানে ঢুকে আরেক প্রস্থ আপ্যায়ন চলল। আর সবশেষে হোটেলে পৌঁছে দিতে এসে সে আমাদের হোটেলের বিলও পরিশোধ করে দিয়ে গেল। ফেরত দিতে গেলাম। নেবে না। বলে এটা ‘হাদিয়া’ (ইসলামিক উপহার)। 

পরদিন ভোরে আমরা ‘লুঝৌ’-এর পথ ধরলাম। ভাবতে লাগলাম, দেড় দিনে নুরুল ইসলাম আমাদের নিয়ে ঘুরেছে প্রায় পাঁচশ’ কিলোমিটার। বাইরে আমাদের খাওয়া-দাওয়াতে কোনভাবেই খরচ করতে দেয়নি। আবার বাড়িতে সবাই মিলে আপ্যায়ন করেছে। অথচ লিউপানসুই যাওয়ার আগে আমরা তাকে কেউ চিনতাম না। শুধু আমাদের দুই ছাত্রের সাথে ‘উইচ্যাট’-এ (চীনা সামাজিক-যোগাযোগ মাধ্যম) পরিচয় এবং কথায় কথায় আমন্ত্রণ!  

আসার পথে এবং আসার পরে আমাদের সবার মুখে ঘুরে-ফিরেই আসে তাদের কথা। এই চীনা মুসলিম পরিবারের আতিথেয়তা জীবনেও ভুলব না। তাদের চিরকল্যাণ হোক, এই শুভ কামনা করি। 

লেখক: চীন প্রবাসী

ছবি কৃতজ্ঞতা: মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান খান

মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান খানের আরও লেখা 

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ, আড্ডা, আনন্দ বেদনার গল্প, ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!