মাও-এর শহর চাংশায় কিছুদিন

সেই অনেক দিন আগে চীনে যখন প্রথম এসেছিলাম, তখন বেইজিং থেকে চাংশা যাওয়ার ট্রেনের টিকেট ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। চীনে আসার আগে মাত্র তিন-চারটা শহর সম্বন্ধে ধারণা ছিল।

মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান খান,চীনের লুঝৌ থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Feb 2017, 08:32 AM
Updated : 6 Feb 2017, 08:33 AM

চাংশা (অনেকেই 'ছাংশা' উচ্চারণ করেন) সম্বন্ধে তখন কিছুই জানতাম না। শুধু এটুকু জানতাম, চাংশা হল হুনান প্রদেশের রাজধানী। আর এখানে ‘সেন্ট্রাল সাউথ ইউনিভার্সিটি’ নামক বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার পড়াশোনা আর গবেষণা করতে হবে। কে জানতো, অপরিচিত এই শহর একদিন আমার বড় আপনার আর ভালোবাসার হয়ে উঠবে?

কিছুদিন আগে চীনের লুঝৌ শহরকে আমার ‘দ্বিতীয় বাড়ি’ বলে অভিহিত করায় এক ছোট ভাই জিজ্ঞাসা করলো, চাংশা আর লুঝৌ- এ দুয়ের মধ্যে কোনটা আমার বেশি ভালো লেগেছে?

ভেবে দেখলাম, লুঝৌ শহর আমার ‘দ্বিতীয় বাড়ি’ হলেও চাংশা আমার মানসিক পুনর্জন্মের ‘আতুরঘর’। আমি যখন দেশ থেকে এসেছিলাম, তখন অনেকটা ভগ্ন হৃদয়। মানুষের প্রতি ভালোবাসা বিশ্বাস অনেকটাই চলে যাচ্ছিল। এই চাংশা শহর আর তার বাসিন্দারা আবার আমাকে মানুষকে ভালবাসতে আর বিশ্বাস করতে শুরু করিয়েছে। বছর চারেক এই শহরে ছিলাম। জীবনের অম্লান অধ্যায় সেটা। 

‘শিয়াংজিয়াং’-এর (শিয়াং নদী)  দুই পাড়ে গড়ে ওঠা প্রাচীন এই শহরের বয়স পাঁচ হাজার বছরেরও বেশি। এর ইতিহাস-ঐতিহ্য অনেক সমৃদ্ধ। বেশি পেছনে যাব না।

আধুনিক চীনের পথিকৃৎ মাও ঝেদং (আমাদের দেশিয় উচ্চারণে ‘মাও সেতুং’) তাঁর শৈশব ও কৈশোর এখানেই কাটিয়েছেন। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শুরু এখান থেকেই। সেই হিসেবে চাংশাকেই আধুনিক চীনের সূতিকাগার বলা যায়।

ইউয়েলু পর্বত থেকে চাংশা শহরের ছবি

চাংশা থেকে অনতিদূরের শহর ‘শাওশান’-এ তার পৈত্রিক বাড়ি।  শিয়াং নদীর মাঝখানে বেশ বড়সড় এক দ্বীপ আছে। অসংখ্য কমলালেবুর বাগানের জন্য এটাকে ‘কমলা-দ্বীপ’ বলে। এই দ্বীপই ছিল শুরুর দিকে মাওয়ের গোপন আস্তানা, যেখান থেকে তৈরি হওয়া চিন্তা-ভাবনা থেকেই ভবিষ্যৎ চীনের যাত্রা শুরু হয়েছিল। 

‘সেন্ট্রাল সাউথ ইউনিভার্সিটি’র অনেকগুলো ক্যাম্পাস। আমাদের ঠিকানা ছিল ‘শিয়াংইয়া স্কুল অব মেডিসিন’ ক্যাম্পাস। চমৎকার সাজানো ক্যাম্পাস। যদিও অপেক্ষাকৃত ছোট, কিন্তু প্রয়োজনীয় সব কিছুই ছিল। অসংখ্য ফুলের গাছ আর সবুজে ঢাকা ক্যাম্পাস, সুদৃশ্য ভবন, আর বড়সড় এক স্টেডিয়াম। পাশেই বিশাল শপিং মল, হালাল খাবারের দোকান, ব্যাংক ও হাসপাতাল। শুধু মসজিদটা ছিল একটু দূরে।

চাংশাতে অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়। এর বিভিন্ন ক্যাম্পাসে বেশ ক’জন বাংলাদেশি ভাইয়েরা ছিলেন। সপ্তাহান্তে মসজিদে দেখা হত শুক্রবারে। দুই-এক মাসে হয়তো একসাথে কারও বাসায় খাওয়া-দাওয়া আর আড্ডবাজি হত। আর রমজানের ইফতার আর ঈদের আনন্দ তো ছিলই।

পড়াশোনা আর গবেষণার বাইরে আমাদের সময় কাটানোর অভাব কখনই হতো না। চাংশার আনাচে-কানাচে আমরা ঘুরে বেড়াতাম। কখনও সবাই মিলে, কখনও দু-একজনে। 

শীতে চাংশা মসজিদ

ক্যাম্পাস থেকে অনতিদূরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ‘ইউয়েলুশান’ বা ‘ইউয়েলু পর্বত’। শিয়াংজিয়াং নদীর পশ্চিম পাশের অংশে এই পাহাড়কে বৃত্তাকারে ঘিরেই শহর গড়ে উঠেছে। মাসে দুই-তিনবার এই পাহাড় ঘুরে না এলে আমাদের মনে হয় পেটের ভাত হজমই হত না। খুব উঁচু নয়, মাত্র তিনশ’ মিটারের মত। কিন্তু আমাদের কাছে ছিল এর ভিন্ন রকম আকর্ষণ। বাহারি গাছপালা, ফুলে-ফলে সজ্জিত পাহাড়ের উপরে সুন্দর একটা হ্রদ। আছে বিশাল এলাকা জুড়ে জাল দিয়ে ঘেরা পাখিদের আবাস। ইউয়েলু পর্বতের উপর থেকে চাংশা শহরের একাংশ প্রায় পুরোটাই দেখা যায়। 

শিয়াংজিয়াং আমাদের  হাতছানি দিয়ে ডাকত। এর মাঝখানের মাও-এর স্মৃতিবিজড়িত ‘জুযিঝৌ’ বা কমলা-দ্বীপ বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন রকমের রূপের ডালি সাজিয়ে আমাদের আমন্ত্রণ জানাতো। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড গরমে দ্বীপের পাড়ে নদীর ঠাণ্ডা বাতাস, শীতের শুরুতে কমলা বাগানে ধরে থাকা অজস্র কমলালেবু, প্রচণ্ড শীতে তুষারাবৃত সাদা ধবধবে জমিনে জেগে থাকা সাদামাখা সবুজ গাছের মাথা কিংবা শীতের শেষের দিকে ফুটে ওঠা চেরি ফুলের বিস্তীর্ণ বাগান- এসব কিছুই অনিন্দ্য সুন্দর আর মোহময়ী।

কমলা-দ্বীপ

দ্বীপের মাঝখানে বেশ ক’টা হ্রদও আছে।  এ ক’বছরে কমলা-দ্বীপের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এটা এখন বেশ জমকালো ট্যুরিস্ট স্পট। চাংশা শহরের এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য ছোট-বড় পার্ক। আধুনিকতা আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মিলিত রূপে এই পার্কগুলোর প্রায় সবগুলোই নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে অনন্য।

শিয়াংজিয়াং নদীর পূর্ব পাশের অংশে শহরের কেন্দ্রের দিকে আছে ‘লিয়েশি গংইউয়ান’ বা ‘শহীদ উদ্যান’। বেশ বড়সড় একটা হ্রদকে ঘিরে উঠেছে এটি। এর পাশেই আছে হুনান জাদুঘর। হাজার হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা চৈনিক সভ্যতার অগণিত নিদর্শনে সমৃদ্ধ এই জাদুঘরের অন্যতম আকর্ষণ হল ২ হাজার ১০০ বছর ধরে সংরক্ষণ করে রাখা প্রাচীন এক রানির মৃতদেহ। না, মমি করে নয়। কয়েক স্তরের কফিন বানিয়ে কিছু নাম না জানা রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা হয়েছে এই পদ্ধতিতে।

শহরের উত্তর-পশ্চিম দিকে একটু গ্রামের দিকে আছে ‘বাইগুয়ো ইউয়ান’ বা ‘শত ফলের বাগান’। এখানে বিভিন্ন ফলের বাগানের দেখা মেলে। একটা নির্দিষ্ট প্রবেশ মূল্য দিয়ে ভেতরে ঢুকে ইচ্ছেমত ফল গাছ থেকে পেড়ে খাওয়া যায় আবার সংগ্রহ করে ওজন দিয়ে কিনেও আনা যায়।

শহরের দক্ষিণ দিকে খানিকটা দূরে আছে ‘ইকোলজিক্যাল পার্ক’। নানা দেশ থেকে আনা পশুপাখির সে এক বিশাল সংগ্রহশালা। মনে আছে, এখানে যখন প্রথম ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগার’ আনা হল, আমার কিছু চীনা বন্ধু খুব উৎসাহী হয়ে খবর দিতে এসেছিল। অনেকে এই বাঘ আসার পরে প্রথম দেশের নাম জানল!  

আমার ছেলেকে যখন চীনে নিয়ে আসি, তখন ওর বয়স মাত্র তিন মাস। এখানেই ওর বেড়ে ওঠা। এই শহরের অলিগলি, পাহাড়, নদী, দ্বীপ, উদ্যান- সবখানেই আমাদের তিনজনের অসংখ্য স্মৃতি। শহর ছেড়ে আসার পরে দুই বার গিয়েছিলাম। পুরনো কিছু বন্ধু-বান্ধব, আর গবেষণাগুরুর আমন্ত্রণে। তবে তার চেয়েও বেশি শহরের মায়ায়।

‘ইউয়েলু পর্বতের একটি হ্রদ

লেখকের পরিবার

ততদিনে চাংশা অনেক পরিবর্তন হয়েছে। চাংশা খুব দ্রুত বাড়ছে শিল্পক্ষেত্রে। নতুন সব উঁচু ভবন তৈরি হচ্ছে। এখন থেকে আর বছর পাঁচেক পরে হয়ত একে আর চেনাই যাবে না। কিন্তু কোন একদিন হয়ত কমলা-দ্বীপের পশ্চিম পাড়ে দাঁড়িয়ে দূরের ইউয়েলু পর্বতের পেছনের আকাশে অস্তগামী সূর্যের লাল আভা দেখে ঠিকই চিনে নেব প্রিয় এই শহরকে।  

লেখক: চীন প্রবাসী

ছবি কৃতজ্ঞতা: মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান খান

মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান খানের আরও লেখা  

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ, আড্ডা, আনন্দ বেদনার গল্প, ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!