মেকং ডেল্টা: যেখানে বরিশালের গন্ধ পাওয়া যায়

হো চি মিন শহরে আসার পরে বিভিন্নজনে বিভিন্ন সময়ে পরামর্শ দিচ্ছিলো মেকং ডেল্টা থেকে ঘুরে আসতে। এটা ভিয়েতনামের অন্যতম পর্যটন এলাকা।

মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান খান, ভিয়েতনামের হো চি মিন থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Nov 2016, 11:37 AM
Updated : 30 Nov 2016, 11:55 AM

প্রতিদিন হাজারো পর্যটক আসে এখানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে।  শুরুর দিকের ব্যস্ততার দিনগুলো শেষে একটু সুযোগ পেলাম গত সপ্তাহে। হো চি মিন শহর থেকে ৭০-৮০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে এর অবস্থান। প্রায় ৩৯ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে অবস্থিত মেকং নদীর অববাহিকা ভিয়েতনামের প্রধানতম কৃষি এলাকা।

বিশেষ করে, সমস্ত ভিয়েতনামে উৎপাদিত ধান বা চালের অর্ধেকেরও বেশি উৎপাদিত হয় এখানে। ধান ছাড়াও অন্যান্য ফসল এবং সবজি ও ফলমূলের জন্য মেকং বিখ্যাত। এখানকার অধিবাসীদের মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগই কৃষক।

মেকং'র প্রতি বিশেষ আকর্ষণ তৈরি হওয়ার অন্যতম কারণ আমার জন্মভুমি। ধান-নদী-খালের দেশ বরিশালের প্রকৃতির মাঝে জন্ম আর বেড়ে ওঠার জন্য এ ধরনের প্রকৃতির প্রতি আমার ভালোবাসা চিরায়ত।

একদল পর্যটকের সাথে সাত-সকালে হো চি মিন থেকে আমরা বাসে রওনা হলাম। একেবারে নিজের সফরসঙ্গী বলতে তিনজন- এক বাংলাদেশি ভাই ও তার সাড়ে তিন বছরের পুত্র আর আমার এক জার্মান সহকর্মী।

পৌনে দুই ঘণ্টায় পৌঁছে গেলাম বিখ্যাত মেকং নদীর তীরে। চীনের তিব্বতের কোন এক পর্বত থেকে জন্ম নিয়ে ইউনান প্রদেশ পার হয়ে মায়ানমার, লাওস, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া অতিক্রম করে ভিয়েতনামের দক্ষিণ অংশের ওপর দিয়ে সমুদ্রে মিলিত হতে মেকং পাড়ি দিয়েছে চার হাজার সাড়ে তিনশ' কিলোমিটার (এটা পৃথিবীর দ্বাদশ দীর্ঘতম নদী; এশিয়ার সপ্তম)।

এক সুদৃশ্য ইঞ্জিনবোটে চেপে বসলাম আমরা। আমাদের দেশের ছোট লঞ্চগুলোর চেয়ে একটু ছোট আর ট্রলারের চেয়ে একটু বড়। অনায়াসে ৬০-৭০ জন ধরে যায়, আর বেশ দ্রুতগামী। দু' পাশের সবুজ প্রকৃতি দেখতে দেখতে চলছি আর ভাবছি নিজের ফেলে আসা গ্রাম আর নদীর কথা।

আহা! কি সুন্দর এই নদী, ভেসে থাকা নৌকা কিংবা ছোট ইঞ্জিনবোট, নদীর বিশুদ্ধ বাতাস, দুই তীরের সবুজ নিসর্গ, ওপরের নীল আকাশ, সাদা মেঘের টুকরো, আর দিগন্তে নদীর সাথে আকাশের মিতালি!

বেশ কিছুক্ষণ নদীর উপর দিয়ে চলে কূলে এসে বোট ভিড়ল। আমাদের নেমে হাঁটতে হবে। সরু বন্য পথ ধরে হেঁটে যেতে দেখলাম দুপাশের অসংখ্য ফলের গাছ-গাছালি। বেশিরভাগই ফল ধরা।

ভালো কথা, নভেম্ভরের এই শীতের মৌসুমেও কিন্তু এখানে বেশ গরম। তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি।

হো চি মিন কিংবা মেকং ডেল্টার এই দিকে সারাবছরই গরম। শীতের অস্তিত্ব এখানে নেই। গাছের ফলফলাদিও সে কথা জানান দিচ্ছিল। নারকেল, কলা, আম, পেপে, কাঁঠাল গাছে ধরে আছে পথের পাশে। এক বাড়িতে চাল থেকে পাপড় বানানোর কল দেখা গেল। এটা এখানকার এক ঐতিহ্যবাহী খাবার।

দুপুরের খাওয়া হল এখানেই। ভিয়েতনামী খাবার-দাবারের ভক্ত আমি নই, কিন্তু মেকং নদীর মাছভাজা দিয়ে চাল দিয়ে বানানো বিশেষ ধরনের এক খাবার বেশ সুস্বাদু ছিল। শোল মাছের ঝোল আর কলমি শাকটাও ছিল বেশ। 

খাওয়া শেষে আবার আমরা মেকং নদীতে ইঞ্জিনবোটে। কিছুক্ষণ পরে ঢুকলাম এক খালে। অবিকল যেন আমাদের দক্ষিণ বাংলার কোন এক খাল। ঘোলা পানির তীব্র স্রোত আর দুপাশে পানির মধ্য থেকে উঠে আসা অসংখ্য গোলপাতার সারি।

খাল দিয়ে বেশ খানিকটা ভেতরে এসে যেখানে থামলাম, সেখানে মৌমাছির চাষ হয় মধু আহরণের জন্য। এখানে আমাদের আপ্যায়িত করা হল চায়ে মধু মিশিয়ে (হানি-টি)। এরপর বেশ খানিকটা হেঁটে এবং ঘোড়ার গাড়িতে চেপে আমাদের যেতে হল গ্রামের অন্য প্রান্তে। প্রচণ্ড গরমে প্রায় সবার অবস্থাই কাহিল। আমরা গলা ভেজালাম বরফ মেশানো তাজা আখের সুমিষ্ট রস দিয়ে।

কিছুদূর সামনে এগোতেই আমাদের অভ্যর্থনা জানানো হল বিভিন্ন ফল আর চা দিয়ে। সেইসাথে ভিয়েতনামের লোকজ সঙ্গীত। এখান থেকেই আরেক খালের উপর দিয়ে আমাদের বেশ লম্বা পথ পাড়ি দিতে হল। ছোটছোট নৌকায় চারজন করে। বেশ চমৎকার ছিল এই ভ্রমণ।

সত্যি বলতে কি এই খালে ছোট নৌকায় ভ্রমন করতে করতে অনেকটাই স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ছিলাম। মনে হচ্ছিল, বুঝি আমাদের গ্রামের বাড়ির সেই খাল দিয়ে নৌকা বেয়ে চলছি। কখনো বন্ধুদের সাথে উৎসবের মেজাজে, কখনো দাদার সাথে ধান কাটতে।

খাল পেরিয়ে নদীর মুখে এসে দেখি আমাদের বড় ইঞ্জিনবোট এখানেই অপেক্ষা করছে। আমরা চেপে বসলাম। নদীপথ ধরে বেশ খানিকটা এগিয়ে আমাদের আবার নামতে হল। এখানে নারকেলের চকলেটের একটা কারখানা আছে। আমাদের ঘুরিয়ে দেখানো হল কীভাবে গাছ থেকে নারকেল কাটা থেকে শুরু করে চকলেট বানিয়ে প্যাকিং করা হয়।

আমাদের ছেলেবেলায় এরকম নারকেলের চকলেট বেশ পাওয়া যেত। আমরা খুব পছন্দ করতাম। সেই স্মৃতি থেকেই হয়তো বেশ কিছু কিনে ফেললাম। আবার আমাদের বোট এগিয়ে চলল।

এক জায়গায় দেখি, নদীর মাঝে সারি করে লম্বা গাছের গুঁড়ি পোতা। সম্ভবত জাল ফেলা হয়েছে মাছ ধরার জন্য। যারা বরিশালের দিকে নদীপথে গিয়েছেন, তারা জানেন এভাবে বাঁশের সারি পুতে জাল ফেলা হয় নদীতে। অনেকটা সেরকমই।

এই মেকং ডেল্টাতেই আছে বিখ্যাত ভাসমান বাজার, যেখানে নৌকায় করে ফলমূল, সবজি আর ফসল বিক্রি হয়। ঠিক আমাদের বরিশালের স্বরূপকাঠির মত। মেকং ডেল্টা প্রতিদিন হাজার হাজার দেশি-বিদেশি পর্যটকে মুখর থাকে। তবে এর তুলনায় দক্ষিণবাংলার বরিশাল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে আরও বেশি সমৃদ্ধ। এটা অবশ্যই আমার আবেগের কথা নয়। তবে বহির্বিশ্বে বরিশালের সৌন্দর্য প্রায় সম্পূর্ণই অজানা।

প্রবাসী মন সবসময়েই দেশের জন্য ভালোবাসা আর আবেগ অনুভব করে। মেকং ডেল্টা ঘুরতে এসে বেশ ভালো লাগল। যেন অনেকদিন পরে নিজের জন্মভূমির কিছু ছোঁয়া, কিছু গন্ধ পেলাম।

লেখকের কথা:

আমি লেখক নই। সাহিত্যজ্ঞানও শূন্যের কোটায়। বিজ্ঞানের ছাত্র। বৈচিত্র্যময় জীবনের নানা বাঁকের ছোট ছোট টুকরো কিছু ঘটনা মাঝে মাঝে দিনপঞ্জিতে লিখি, এই আর কি। পড়াশোনা এবং জীবিকার তাগিদে বেশ কিছুদিন ধরেই প্রবাসে। এই মুহূর্তে আছি ভিয়েতনামের হো চি মিনে। আমার অতি সাধারণ প্রবাস জীবনের সাধারণ কিছু টুকরো অভিজ্ঞতা, সাধারণ কিছু কথা বলার জন্যই এখানে লেখা।

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি।