পাহাড়ি লাল নদীর খোঁজে

গবেষণাগারে একটানা কাজ করতে করতে অনেক সময় একঘেয়েমি লাগে, বিরক্তিও। একটু পরিবর্তন দরকার হয়। শারীরিক ক্লান্তির চাইতে মানসিক অবসাদই বেশি লাগে।

মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান খান, ভিয়েতনামের হো চি মিন সিটি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Nov 2016, 09:20 AM
Updated : 12 Nov 2016, 09:29 AM

এমনই একদিনে আমাদের গুরু ফু সাহেব ডেকে বললেন, "ছেলেমেয়েরা ইদানিং ল্যাবে তেমন একটা ভাল করছেনা, কেমন যেন সবার মধ্যে ছাড়া ছাড়া ভাব। অল্প কিছুদিনের মধ্যে কিছু কাজ শেষ করা দরকার। কীভাবে এদের সাইজ করা যায় বলতো?"

আমি বললাম, "ওদের কি দোষ? আমারই যা অবস্থা ! বেশ ক্লান্ত লাগছে ইদানিং। তোমার চেহারাতেও ক্লান্তির ছাপ। চল, কোথাও ঘুরে আসি সবাই মিলে।"

আইডিয়া পছন্দ হল। কিন্তু কোথায় যাওয়া যায়? সুবিশাল চীনে বেড়ানোর মত হাজারো জায়গা! আমি চাইলাম, এমন কোথাও, যেখানে থাকবে নিস্তব্ধতা আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।

একজন প্রস্তাব করল, চলো 'ফুবাও' এ যাই, 'লাল নদী' দেখে আসি। ইন্টারনেট ঘেঁটে তেমন তথ্য পেলাম না।

ওরা বলল, কিছু চীনা ওয়েবসাইটে অল্প কিছু তথ্য আছে, আর যারা সেখানে গিয়েছে সবাই পছন্দ করেছে। ওদের কথায় তেমন ভরসা পেলাম না। কিন্তু দেখলাম প্রায় সবাই রাজি হয়ে গেছে। অগত্যা, আমিও।

নির্দিষ্ট দিনে লুঝৌ থেকে বাসে 'হাজিয়াং' রওনা দিলাম। 'হাজিয়াং' সিচুয়ানের দক্ষিণদিকের কাউন্টি। একদিকে পাহাড় সারি আর অন্যদিকে ইয়াংজে নদী। চোখ জুড়ানো সৌন্দর্য্য। বেশ ভালো লাগল। কিন্তু এটা আমাদের গন্তব্য নয়। দূরের ওই পাহাড়শ্রেণির মধ্যদিয়ে আরো কোন প্রত্যন্ত জায়গায় যেতে হবে।

একটা মাইক্রোবাস ভাড়া করলাম। পাহাড়ি পথে আমাদের চলা শুরু হলো। দুই ধারে পাহাড়ের সারি, মাঝখানে সরু রাস্তা, কখনো পাহাড়কে দূরে ঠেলে দিয়ে সবুজ প্রান্তর। বেশ অনেক দূরে দূরে কিছু ঘরবাড়ি দেখা যায়।

বাংলাদেশের বরিশালের ছেলে আমি। দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ মাঠ, মেঠো পথ, নদী, খাল এই দেখেই বড় হয়েছি। সবুজে আমার চিরকালীন মুগ্ধতা।

তবে এই সবুজ অন্য রকম, আমাদের সমতল ভূমির সৌন্দর্য্যের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। গাড়ির মধ্যে ছেলেমেয়েরা হই-হুল্লোড় করছে, খাওয়া-দাওয়া করছে, আর আমি অদ্ভুত এক মুগ্ধতা নিয়ে পথের পাশের প্রকৃতি দেখছি।

হঠাৎ ব্রেক কষে গাড়ি থেমে গেল। দেখলাম সামনে পুরাতন ধাঁচের কিছু ঘরবাড়ি।

নিচে নামলাম। হ্যাঁ, এটা এক প্রাচীন শহর। বিশেষ কোন নাম নেই। ঘুরে ঘুরে দেখা হল পুরাতন আমলের বাজার, ঘরবাড়ি, মন্দির, কারখানা। এখানেই দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থা। ভুট্টার স্যুপ, আলু-বেগুনভাজি আর একটুখানি ভাত- আমার হয়ে গেল। তাছাড়া অনেক শুকনো খাবার সাথে আছে গাড়িতে। আমাদের চলা ফেরা শুরু হল।

এবারে প্রকৃতির আরেক অপরূপ দৃশ্য। একদিকে সু-উচ্চ পাহাড়, কোথাও হাজার মিটারের উপরে, আর আরেক দিকে গভীর খাদ, কোথাও কয়েকশ’ (নাকি হাজার?) ফুট। মাঝখানে মেঠো রাস্তা, তবে গাড়ি চলাচলের উপযুক্ত।

গাড়ি আস্তে আস্তে চলছিল। এর সামান্য শো শো শব্দ, মাঝে মাঝে খাদের অনেক নিচ থেকে ভেসে আসা বয়ে যাওয়া পানির কুলকুল ধ্বনি। বেশ লাগছিল চলতে।

এক সময়ে খাদের শেষ আর রাস্তার দূরত্ব কমে এলো। বেশ সুন্দর উপত্যকার মত জায়গা। অজস্র বোল্ডার। আমরা নেমে ঝটপট কিছু ছবি তুলে ফেললাম।

খানিক পরে দেখলাম দুদিকের পাহাড় বেশ একটু দূরে সরে গিয়ে চমৎকার স্বচ্ছ টলটলে পানির এক হ্রদকে জায়গা করে দিয়েছে। নেমে সবাই আমরা হাত পা মুখ ভেজালাম। প্রফেসর সাহেব তার ছাত্রছাত্রীদের সাথে শিশুসুলভ আনন্দে মেতে উঠলেন।

সন্ধ্যার একটু আগে আমরা পৌঁছে গেলাম এক 'রেস্ট হাউজে'। আশেপাশে দুই-এক কিলোমিটারের মধ্যে আর কোন ঘরবাড়ি নেই। পাহাড়ের গায়ে ছোট দুই তলা ইট-কাঠের বাংলো। রাতে খাওয়ার ব্যবস্থা পাহাড়ি আলু, মাশরুম, কচি বাঁশ আর নাম না জানা কিছু পাহাড়ি সবজি। দুইটা বনমোরগ আনা হল।

এ জিনিস আমার খাওয়া হবে ভাবতেই পারছিলাম না! নাহ্, মিস করা যাবে না। লাফ দিয়ে সামনে গিয়ে প্রফেসরকে বললাম, আমি মুরগি কাটবো, আমাকে ছুরি  দিতে বলো।

অবাক হলেও আমার হাতে ছুরি দিলেন রন্ধন-মাসী। আমি 'বিসমিল্লাহ আল্লাহু আকবর' বলে জবাই করে ফেললাম। যাক এবারে আর সমস্যা নেই।  

সারাদিন ক্লান্তির পরে চমৎকার এক খাওয়া হল মাগরিবের পরে। পাহাড়ি বিভিন্ন সবজি আর হালকা ঝালে বনমোরগের ভুনা, সেই সাথে ইয়াংজে নদীর তাজা মাছ। আহা! সেই স্বাদ ভুলে যাওয়ার মত নয়।

খাওয়া শেষে বাংলোর উঠানে মাদুর পেতে বসল সবাই। ওরা একে একে গান গাইছে, নাচছে। আমি একটু সরে সিঁড়ি দিয়ে তিন ধাপ নিচে এসে হাতে কফির মগ নিয় রেলিংয়ে গা এলিয়ে বসলাম।

অন্ধকার ফুঁড়ে ওঠা চারদিকের উঁচু পাহাড়ের কাঠামো, তার উপর চন্দ্রবিহীন তারকাখচিত ঝকঝকে এক আকাশ, ঝরনার একটানা শো শো আর কুলকুল শব্দের মিশ্রণ- বাকি সব নির্জন আর নিস্তব্ধ। আহা! জীবনের কিছু কিছু মুহূর্ত এত অদ্ভুত সুন্দর মনে হয়!

খুব ভোরে ফজরের পরে বের হলাম হাঁটতে। সফরসঙ্গীদের তখনো ওঠার সময় হয়নি। বাংলো থেকে বেড়িয়ে দুইদিকে প্রায় দুই দুই করে চার কিলোমিটার হেঁটে এলাম। এই সময়ে তেমন কাউকে রাস্তায় চোখে পড়ল না। এক বাড়ির পাশে শুধু এক বৃদ্ধা ভদ্রমহিলাকে দেখলাম মিষ্টি আলু তুলে ডালায় রাখছে। আমায় দেখে ফোকলা দাঁতে হাসি দিয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করলো। বুঝলাম না।

আমি 'নি হাও' আর 'থিংপুতং' বলে কেটে এলাম। রাস্তার পাশে পাহাড়ি নদী।

সরু কিন্তু তীব্র স্রোতস্বিনী। কিছুক্ষণ পরপরেই ঝরনার দেখা মিলে। এতোক্ষণে বুঝলাম, কেন ওরা 'রেড রিভার' বা ‘লাল-নদী’ বলে। লাল পাথরের নদীগর্ভ। বয়ে যাওয়া পানিকে তাই দূর থেকে রক্তের মতই লাল দেখায়। এগুলো কী পাথর কিংবা কীভাবে এরকম হয় তার ব্যাখ্যার জন্য ভূ-বিজ্ঞানীরা রয়েছেন, আমি শুধু উপভোগ করলাম।

কিছুক্ষণ পরে দলের অন্য সবাই নেমে এলো। নদীর পানিতে দাপাদপি, হাঁটুপানিতে সাঁতার কাটা, একে অন্যকে পানি ছিটানো- মনে হচ্ছিল একদঙ্গল পূর্ণবয়স্ক শিশুরা খেলছে।

দ্বিপ্রহরের আগেই খেয়েদেয়ে ফেরার পথ ধরলাম। আবার সেই অনিন্দ্যসুন্দর প্রকৃতি- পাহাড়ি পথ, পাহাড়, ঝরনা, হ্রদ, কুলকুল কিংবা শো শো শব্দ কিংবা কখনো বেলা পড়ে যাওয়া ক্লান্ত দুপুরের পাখিদের ডাক।

মাঝে মাঝে পাহাড়ের গায়ে দুয়েকটা বাড়ি চোখে পড়ে। একবার মনে হলো, কী হবে ফিরে গিয়ে, এখানেই কোথাও এরকম এক বাড়িতে থেকে যাই সারা জীবনের জন্য। কিন্তু তা হওয়ার নেই।

এই অনিন্দ্যসুন্দর পাহাড়ি প্রকৃতি হল 'স্বপ্নে'র মত, আর স্বভাবসিদ্ধ যাপিত জীবনই বাস্তবতা। আমাদের বাস্তবে ফিরে আসতেই হয়, কিন্তু স্বাপ্নিক সৌন্দর্যের এই স্মৃতি বার বার হাতছানি দিয়ে ডাকে।

লেখকের কথা:

আমি লেখক নই। জীবনের নানা বাঁকের ছোট ছোট টুকরো কিছু ঘটনা মাঝে মাঝে দিনপঞ্জিতে লিখি, এই আর কি। পড়াশুনা এবং জীবিকার তাগিদে বেশ কিছুদিন ধরেই প্রবাসে। এখন ভিয়েতনামে থাকলেও চীনে ছিলাম প্রায় ছয় বছর। আমার অতি সাধারণ প্রবাস জীবনের সাধারণ কিছু টুকরো অভিজ্ঞতা, সাধারণ কিছু কথা বলার জন্যই এখানে লেখা।

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি