ভিয়েতনামের ম্যানগ্রোভ বনে

ম্যানগ্রোভ বনের প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য অন্য বন থেকে ভিন্ন। সুন্দরবনের দেশের মানুষ বলেই হয়ত 'ম্যানগ্রোভ' শব্দটি আমাদের মনে বিশেষ আগ্রহ তৈরি করে।

মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান খান, ভিয়েতনামের হো চি মিন থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Dec 2016, 11:02 AM
Updated : 9 Dec 2016, 01:30 PM

ভিয়েতনামের 'ক্যান জিও ম্যানগ্রোভ ফরেস্টে'র (লোকাল উচ্চারণ 'কানজা') প্রতি আগ্রহ ছিল অনেকদিন ধরেই। শুধু প্রাকৃতিক দিক দিয়ে নয়, আধুনিক ভিয়েতনামের ইতিহাসের সাথে এই বন ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

হো চি মিন শহর থেকে বেশি দূরে নয়, মাত্র ৪৫-৫০ কিলোমিটার দূরে। এইতো সেদিন আমরা ক'জন ঘুরে এলাম 'ক্যান জিও' এর ম্যানগ্রোভ বন থেকে। সে অভিজ্ঞতারই দুটো কথা লিখছি এখানে।

ষোলজনের দলে আমার সঙ্গে আরো দুজন বাংলাদেশি। নুরুল ইসলাম সাহেব আর জামান সাহেব। আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল  'তিমি'র উপাসনালয়ে' (হোয়্যাল টম্ব)।

কিংবদন্তী অনুসারে, ২০০ বছর আগে এক ভিয়েতনামি রাজার জাহাজ সমুদ্রে বিপদে পড়ে। বিশাল আকারের এক তিমি নাকি তাকে তীরে ফিরতে সাহায্য করে। তিমিকে তাই এখানকার জেলেরা ভক্তি ও উপাসনা করেন। প্রায় ১২ মিটার লম্বা এক তিমির কংকাল সংরক্ষিত আছে এখানে।

সেখান থেকে আমরা গেলাম পার্শ্ববর্তী এক সমুদ্র সৈকতে। তেমন একটা ভালো লাগল না। সৈকত বেশ নোংরা। তবে অজস্র ছোট ছোট শামুক ঝিনুকের দেখা মিলল। সম্ভবত ভাটার সময়।

বিস্তীর্ণ বালুভূমির পরে অনেক দূরে দেখা যায় পূর্ব সাগর('সাউথ চায়না সি'কে ভিয়েতনামে 'ইস্ট সি' বলা হয়)। পাশেই এক 'সি-ফুড মার্কেট'। চেনা অচেনা নানা রকম সামুদ্রিক খাবারের পশরা সাজিয়ে বসেছেন স্থানীয় অনেক মানুষজন।

এখানকার অধিবাসীদের অধিকাংশই জেলে। আমরা একটু তাজা চিংড়ি ভাজার স্বাদ নিলাম। কিছুক্ষণ পর দুপুরের খাওয়ার ডাক পড়ল। চমৎকার 'সি-ফুড লাঞ্চ' সারা হল স্থানীয় এক ছোট রেস্তোরাঁয়।

এর পরের গন্তব্য বনের মধ্যে। প্রথমেই বানরের এলাকায়। হাজার হাজার বানরে পূর্ণ এই দ্বীপের নাম দেওয়া হয়েছে 'মাঙ্কি আইল্যান্ড'। ট্যুরগাইড ড্যাট সাহেব সাবধান করলেন। মোবাইল ফোন এবং চশমা পকেটে লুকিয়ে রাখতে হবে। কারণ বানরেরা আক্রমন করে এগুলো ছিনিয়ে নেয়।

বাস থেকে নেমেই দেখা গেল, অসংখ্য বানর বনে এবং রাস্তায় ঘোরাঘুরি করছে। তারা যাতে পর্যটকদের তেমন কোন ক্ষতি না করতে পারে সেজন্য জলপাই রঙের পোশাকের অনেক বনরক্ষী বা পাহাড়াদার রয়েছেন। তারা গুলতি নিয়ে বানর তাড়ান।

এখানে একটা বন-যাদুঘর আছে। সেখানে এই বনের বিভিন্ন পশুদের স্টাফ করে রাখা আছে। সুন্দরবনের মত বাঘ এখানে নেই, তবে বেশ কিছু মেছোবাঘ বা বাগডাশ ধরণের প্রাণীর দেখা মিলল।

আরও আছে বিভিন্ন ধরনের পাখি, কাঠবিড়ালী, উদবেড়াল, ভোদর, কচ্ছপ, অজগর আর নানা রকমের সরীসৃপ।

যাদুঘর থেকে বের হয়ে খালের ওপরের সুদৃশ্য কাঠের সেতু পার হয়ে কুমিরের জন্য সংরক্ষিত এলাকা। বনবিভাগ বিশাল এলাকা আলাদা করে নিরাপত্তা বেষ্টনি দিয়ে ঘিরে দিয়েছে কুমিরের জন্য। এখানে মাছের টোপ দিয়ে ছিপ ফেলে কুমিরের সাথে খেলা যায় আর তাদের হুটোপুটি দেখা যায়।

কুমির দেখা শেষে ফেরার পথে কোন এক দুষ্ট বানর আমাদের নুরুল ইসলাম সাহেবকে আক্রমন করে বসল। ব্যাগের পার্শ্ব-পকেটে থাকা পানির বোতল নেয়া ছিল তার উদ্দেশ্য। সে সফল, এবং সেই সাথে আমাদের কিছু উত্তেজনা আর হাসি ঠাট্টাও হল।

বনের গভীরে আমরা ঢুকলাম স্পিডবোট দিয়ে, ছোট খাল দিয়ে। সে এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা! দুপাশে ঘনবন। বিশেষ ধরণের বড়বড় গাছ তাদের অসংখ্য পায়ের মত শিকড় ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে, কেউবা শিকড় নামিয়ে দিয়েছে খালের মধ্যে। মাঝখান দিয়ে তীব্র বেগে ছুটে চলা বনের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে।

ভাবছিলাম, এই বুঝি কোন কুমির এসে আক্রমণ করে বসল! না, তা হয়নি। সম্ভবত এইসব খালে কুমির নেই কিংবা থাকলেও খুব কম; সব ঐ বিশেষ সংরক্ষিত এলাকায়। মাঝখানে ছোট নদী পেরিয়ে ওপাশের খালে ঢুকে কিছুদুর এগোতেই একটা কাঠের সেতু আর লাগোয়া কাঠের সরু পথ চোখে পড়ল। এখানেই আপাতত থামতে হবে। ঘাটে আরো কয়েকটি স্পিডবোট বাঁধা আছে।

অনেকগুলো ছোট ছোট কুঁড়েঘর এখানে। গত শতাব্দীর ভয়াবহ সেই যুদ্ধে এই এলাকা ছিল 'ভিয়েত কং' যোদ্ধাদের লুকিয়ে যুদ্ধ করার জায়গা। কোন এক কুঁড়েঘরে কাপড় সেলাই হত সৈনিকদের জন্য, দিনের বেলার জন্য জলপাই রঙের আর রাতের জন্য কালো রঙের।

পাশের কুঁড়েঘর ছিল অস্ত্র তৈরির ঘর। আমেরিকান সৈন্যদের ছোড়া বোমা যেগুলো বিস্ফোরিত হত না, সেগুলোকে এখানে পুনঃব্যবহারযোগ্য করে তোলা হত। ম্যানগ্রোভ বনের মধ্যে খাবার পানি ছিল না। সৈন্যরা কখনো বৃষ্টির পানি ধরে রাখতেন বর্ষাতি বিছিয়ে আবার কখনো লোনা পানিকে পরিশোধন করে পানযোগ্য করে তুলতেন।

মডেল বানিয়ে রাখা হয়েছে সেইসব দিনের কার্যক্রম। আর একটা কুঁড়েঘর ছিল যুদ্ধের পরিকল্পনা করার জন্য মিটিং রুম। আরো দু'তিনটা সম্ভবত সৈন্যদের থাকার জায়গা।

বছরের পর বছর এখান থেকে যুদ্ধ করেছে অগণিত সেনা। মারাও গিয়েছে অনেক। কেউ শত্রুর বোমার আঘাতে, কেউ প্রাণ হারিয়েছে জোয়ারের সময়ে পানিতে ভেসে আসা কুমিরের আক্রমণে। আরো ছিল সাপ, অন্যান্য পোকামাকড় আর বিশেষ করে মশা।

এই ম্যানগ্রোভের বড় একটা অংশ বোমা হামলায় উজাড় করে দেওয়া হয়েছিল। ভাবি, বছরের পর বছর কি ভয়াবহ দিন পার করতে হয়েছে এদের! যুদ্ধ মানেই অশান্তি, যুদ্ধ মানেই ধ্বংস। পৃথিবীর যুদ্ধবাজ নেতা আর অত্যাচারী শোষকদের বোধোদয় ঘটুক।

মন বেশ ভরাক্রান্ত হয়ে উঠছিল। ফেরার সময়ে বনের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরলাম ধীরে ধীরে। গভীর বন থেকে বেরিয়ে 'মাঙ্কি আইল্যান্ড' পার হয়ে বাসে উঠলাম।

ফেরার পালা। দুইদিকে ঘনবন আর মাঝখান দিয়ে চওড়া সড়ক। অদ্ভুত এক আবেশে মন আচ্ছন্ন। বনপ্রকৃতির সৌন্দর্য আর ইতিহাসের নির্মমতার কিছু স্মৃতির মিশ্রণ সেখানে।

লেখকের কথা:

আমি লেখক নই। সাহিত্যজ্ঞানও শূন্যের কোটায়। বিজ্ঞানের ছাত্র। বৈচিত্র্যময় জীবনের নানা বাঁকের ছোট ছোট টুকরো কিছু ঘটনা মাঝে মাঝে দিনপঞ্জিতে লিখি, এই আর কি। পড়াশোনা এবং জীবিকার তাগিদে বেশ কিছুদিন ধরেই প্রবাসে। এই মুহূর্তে আছি ভিয়েতনামের হো চি মিনে। তবে চীনে ছিলাম এর আগে বেশ কিছুদিন। আমার অতি সাধারণ প্রবাস জীবনের সাধারণ কিছু টুকরো অভিজ্ঞতা, সাধারণ কিছু কথা বলার জন্যই এখানে লেখা।

মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান খানের আরও লেখা