'মিয়াও' হল পারিবারিক বা গোত্রীয় নাম। ওর কাছেই জানলাম ওরা চীনের এক বিশেষ ধরনের 'এথনিক মাইনরিটি'। ওদের আছে নিজস্ব ঐতিহ্য আর সাংস্কৃতিক ইতিহাস। চীনের অনেক এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেও গুইঝোউ, হুনান আর ইউনানেই এদের বাস প্রধানত।
কেন জানি না, মিয়াওদের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠলাম। ইন্টারনেটে পড়ে সামান্য কিছু জানা গেল। মিয়াওদের একেবারে কাছ থেকে দেখারও সুযোগ এল।
আমাদের 'সেন্ট্রাল সাউথ ইউনিভার্সিটি'র বিদেশি ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে একটা ট্যুর আয়োজন করা হল হুনানের পশ্চিম দিকে 'জিশো' আর 'ফংহুয়াং' এ।
এক বাস ভর্তি ৪০-৫০ জন 'বুড়ো' ছাত্র-ছাত্রী আমরা। হইচই করতে করতে ছুটলাম। চাংশা শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে। সকালে রওনা হয়ে দুপুর নাগাদ পৌঁছালাম। 'জিশো' অতি সুন্দর জায়গা। ছোট-বড় অসংখ্য পাহাড়, তার মধ্য দিয়ে বয়ে চলা নদী, গ্রাম। চারিদিকে সবুজ।
গ্রাম্য রাস্তা ধরে চলতে চলতে একসময়ে এক উপত্যকায় এসে বাস থামল। চারদিকে পাহাড়, মাঝখানে ছোট এক গ্রাম। ট্যুরগাইড বলল, এটা মিয়াওদের একটা গ্রাম, আমাদের প্রথম গন্তব্য। আমি বেশ চমকেই উঠলাম। মিয়াওদের সম্পর্কে জানার ইচ্ছা ছিল, তাই বলে একেবারে তাদের এক প্রত্যন্ত গ্রামে এসে পড়ব, এতটা ভাবিনি।
গ্রামের মধ্যে মঞ্চ আর গ্যালারি ধরনের আছে। সেখানে মিয়াওরা তাদের ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির প্রদর্শন করল। নাচ আর গানের মাধ্যমে তারা জানাল তাদের জীবনযুদ্ধের ইতিহাস। দুপুরে খাওয়ার পর আমরা বের হলাম গ্রাম ঘুরে দেখতে। ছোটগ্রাম। সরু, স্রোতস্বিনী পাহাড়ি নদী তিন দিক দিয়ে প্রবাহিত।
আর গ্রামের চারদিকে মাথা উঁচু করে থাকা পাহাড়ের চূড়াগুলো যেন মহাকাল ধরে অতন্দ্র প্রহরীর মত গ্রামের প্রতিরক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে। মিয়াওরা সুদৃশ্য কাপড় তৈরি করে। অনেকগুলো সুতার কাপড়ের কল দেখা গেল। আমি একজন বৃদ্ধার কাপড় কলে ঢুকে তার ছবি তুলতে চাইলে, তিনি আমাকে টেনে তার জায়গায় বসিয়ে দিলেন ছবি তোলার জন্য।
মিয়াওদের সুপ্রাচীন ইতিহাস আর তাদের জীবনযাত্রার একঝলক দেখে বিকেলে আমরা বেড়িয়ে এলাম। বাস চলতে শুরু করল। সন্ধ্যার আগে এক পাহাড়ি নদীর ধারে যাত্রাবিরতি। এখান থেকে দুই পাহাড়ের মাঝে সংযোগকারী বিখ্যাত 'আইঝাই সাসপেনশন ব্রিজ' দেখা যায়, যেটা উচ্চতার দিক দিয়ে পৃথিবীর সপ্তম আর পনেরতম লম্বা ঝুলন্ত সেতু। স্থাপত্যবিদ্যা এবং প্রকৌশলে চীনা মস্তিস্কের আরেকটি অনন্য উদাহরণ এই সেতু।
কিংবদন্তি অনুসারে প্রাচীনকালে ফংহুয়াং পাখিযুগল এই শহরের উপর দিয়ে উড়ে যেতে যেতে এই শহরকে ভালোবেসে ফেলে এবং এখানেই স্থায়ী আবাস গড়ে ফেলে। যাই হোক, এই শহরকে 'ফংহুয়াং অ্যানসিয়েন্ট টাউন' বলা হয়, কারণ এর সবকিছুই 'প্রাচীন'।
অধিবাসীদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি 'মিয়াও' এবং 'থুজিয়া' মাইনরিটির। অবিকল প্রাচীন চীনের কাঠামো ধরে রাখা হয়েছে এখানে। হোটেল রুমে ব্যাগ রেখে আমরা বেরিয়ে পড়লাম রাতের ফংহুয়াং দেখতে। শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে ছোট নদী। তার উপর দিয়ে বেশ ক'খানা সুদৃশ্য সেতু। দুপাশে আলো ঝলমলে শহর।
হোটেল, রেস্টুরেন্ট বাড়িঘর সব এমনভাবে তৈরি যেন সব প্রাচীন কালের, কিন্তু সুযোগ-সুবিধা আধুনিক। যেমন, ইলেকট্রিক বাতিগুলো এমনভাবে তৈরি করা যেন সব লণ্ঠন মনে হয়। রাতের আঁধারে ফংহুয়াংকে মনে হচ্ছিল প্রাচীন কোন জনপদ যেখানে অত্যাধুনিক সব ব্যবস্থা আছে।
খুব সকালে যখন বের হলাম, রাতের কোলাহল আর নেই তখন। কুয়াশাচ্ছন্ন ঘুমন্ত ফংহুয়াং এর পথে কিংবা নদীর ধার ধরে হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছিল, আমরা যেন সত্যিই হাজার বছর আগের চীনে চলে এসেছি। পেছনের খাড়া পাহাড়, সেখান থেকে নেমে আসা নদী আর তার দুধারের প্রাচীন শহর। কেমন যেন একধরনের ঘোর লেগে গিয়েছিল।
ধীরে ধীরে শহর আবার জেগে উঠল। অনেক নৌকা নদীতে। আমরা দলবেঁধে নৌকায় উঠলাম। মাঝিকে সরিয়ে আমরাই বেয়ে চললাম।
কখন যে বেলা হয়ে এলো, টের পেলাম না। ফেরার সময় হয়েছে। বাস যখন আমাদের নিয়ে ফিরে চলল চাংশার পথে, মনে হচ্ছিল টাইম মেশিনে চড়ে আমরা হাজার বছরের আগের চীন থেকে ঘুরে এসে আবার বর্তমানের পথে চলেছি।
লেখকের কথা
আমি লেখক নই। সাহিত্যজ্ঞানও শূন্যের কোটায়। বিজ্ঞানের ছাত্র। বৈচিত্র্যময় জীবনের নানা বাঁকের ছোট ছোট টুকরো কিছু ঘটনা মাঝে মাঝে দিনপঞ্জিতে লিখি, এই আর কি। পড়াশোনা এবং জীবিকার তাগিদে বেশ কিছুদিন ধরে প্রবাসে। এই মুহূর্তে আছি ভিয়েতনামের হো চি মিনে। তবে এর আগে চীনে ছিলাম বেশ ক'বছর। আমার অতি সাধারণ প্রবাস জীবনের সাধারণ কিছু টুকরো অভিজ্ঞতা, সাধারণ কিছু কথা বলার জন্যই এখানে লেখা।
লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি।