জুয়ার শহর ম্যাকাওয়ে প্রবাস জীবন

সুবিশাল প্রশান্ত মহাসাগরের উত্তর-পশ্চিম কোণার একটি অংশ 'দক্ষিণ চীন সাগর' নামে পরিচিত। সম্পূর্ণ দক্ষিণ সীমানা এবং পূর্ব এশিয়ার আরও কিছু অংশ জুড়ে এর বিস্তৃতি।

মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান খান, ভিয়েতনামের হো চি মিন সিটি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 Nov 2016, 11:59 AM
Updated : 18 Nov 2016, 12:13 PM

নীল সাগরের মধ্য থেকে জেগে ওঠা অনেকগুলো ছোট ছোট দ্বীপ, সাগরে ভাসমান অসংখ্য বাণিজ্যিক জাহাজ নিয়ে ব্যস্ত এই সাগর যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমন সুন্দর। এই দক্ষিণ চীন সাগরের পাশে অতি ক্ষুদ্র এক দেশ, ম্যাকাও।

পুরোপুরি স্বাধীন বলা যায়না। প্রায় সাড়ে চারশ' বছর শাসন করার পরে পর্তুগিজরা এই সবেমাত্র ১৯৯৯ সালে চীনের কাছে ম্যাকাওকে হস্তান্তর করেছে।

চীনের 'স্পেশাল অ্যাডমিনিসট্রেটিভ রিজিওন' (এসএআর) বলা হয় একে। যদিও মুদ্রাব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, ভাষা, সীমানা সবই চীন থেকে স্বতন্ত্র।

আয়তনে মাত্র তিরিশ বর্গকিলোমিটার। খুবই ঘনবসতিপূর্ণ এবং পৃথিবীর অন্যতম ধনী দেশ। খরুচে শহরের তালিকায় ম্যাকাওয়ের নাম উপরের দিকেই। এদের নিজস্ব তেমন উৎপাদন নেই; প্রায় সব কিছুর জন্যই চীনের মূল ভূখণ্ড, হংকং কিংবা অন্য কোনও দেশের উপর নির্ভরশীল। আয়ের প্রধান উৎস পর্যটন আর জুয়া। সমস্ত ম্যাকাও জুড়েই অসংখ্য 'ক্যাসিনো'।

সারা দুনিয়া থেকে মানুষজন এখানে জুয়া খেলতে আসে। আর ক্যাসিনোগুলোর কতো কতো নাম- ভেনিসিয়ান, গ্যালাক্সি, গ্রান্ড লিসবোয়া ইত্যাদি। তবে এগুলো শুধু ক্যাসিনোই নয়, এর সাথে বিলাসবহুল হোটেল আর শপিং কমপ্লেক্সও যুক্ত।   

'ইউনিভার্সিটি অফ ম্যাকাও' এর অ্যাপয়েন্টমেন্ট হাতে পেয়ে ভাবলাম, যাই একটু ঘুরে আসি। ক'দিন কাটিয়ে আসি দক্ষিণ চীন সাগর তথা প্রশান্ত মহাসাগরের পানি, বাতাসে। বন্ধুরা ঠাট্রা করে বলল, "তুই তো জুয়া খেলবি না, বারে যাবিনা, ওখানে গিয়া করবি কি?"

হা হা। আল্লাহর রহমতে এসব জায়গায় যেতে হয়নি। বরং ম্যাকাওএর প্রকৃতির মাঝে বেশ খানিকটা সময় কাটিয়েছি। তবে, এও ঠিক, একাকিত্ব কিছুটা ভুগিয়েছে।   

ঢাকা থেকে যাত্রা শুরু করে চীনের কুনমিং, বেইজিং, সাংহাই হয়ে প্রায় ২৪ ঘণ্টার যাত্রা শেষে যখন ম্যাকাও পোঁছালাম, মাথার উপরে তখন গনগনে সূর্য। অগাস্টের শেষে প্রায় চল্লিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা। তবে বিমান থেকে অবতরণের সময়টা বেশ লাগল।

বিমান যখন অবতরণের জন্য ঘুরপাক খাচ্ছিল, নিচে দেখছিলাম সুনীল সাগর আর তার মাঝে জেগে ওঠা অনেকগুলো দ্বীপ। পশ্চিম দিকে কিছু পাহাড়ের সারি রেখে বিমান হঠাৎ নিচে নেমে এলো, মনে হল এই বুঝি সমুদ্রেই নেমে যাচ্ছে। বিমান বন্দরের রানওয়ে প্রায় সম্পূর্ণটাই সাগরের মধ্যে বানানো। দুইপ্রান্তে শুধু একটু যুক্ত করে দেয়া হয়েছে মূল বন্দরের সাথে।

শুরু থেকেই ম্যাকাওয়ে নিজেকে মানিয়ে নিতে একটু কষ্ট হচ্ছিল। হয়ত এই প্রথম স্ত্রী-সন্তান থেকে দূরে থাকার কারণে, হয়ত কর্মস্থলে কিছু অপ্রিয় অভিজ্ঞতার কারণে, কিংবা তার চেয়েও হয়ত বেশি ম্যাকাওয়ের কৃষ্টি-কালচার এবং জীবনবোধের কারণে, যা আমার জন্য খুবই প্রতিকূল ছিল।

মাত্র বছরখানেক ছিলাম ম্যাকাওয়ে। তবে ক্ষুদ্র এ মানবজীবনের জন্য একবছর নেহায়েত কম সময় নয়।

গরমের দেশ ম্যাকাও। শুধু ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে একটু শীত পড়ে, তবে সেই শীত কখনো কখনো প্রশান্ত মহাসাগরীয় ঠাণ্ডা বাতাসে তীব্র হয়ে ওঠে। এখানে তুষারপাত নেই । তবে সারাবছরই প্রচুর বৃষ্টি হয়, যখন তখন, বিশেষ করে শীতের সময়ে আরো বেশি করে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের মধ্যেই ছিল থাকার ব্যবস্থা। চমৎকার সাজানো গোছানো ক্যাম্পাস, শহরের সাথে যোগাযোগের ব্যবস্থা খুবই ভাল। সপ্তাহের ৫ দিন সকাল থেকে সন্ধ্যা কাজকর্মে চলে যেত, আর সাপ্তাহিক ছুটির দিন মানেই একা একা বেড়ানো।

ম্যাকাও এতই ছোট আকারের যে, একদিনেই পুরো শহর (দেশ) ঘুরে বেড়ানো সম্ভব।  দু'জন মাত্র বাংলাদেশি ছাত্রকে পেয়েছিলাম এখানে- শুভ আর তৌকির। সদ্য কৈশোর পার করা, বেশ হাশিখুশি প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর।

কোন কোন সাপ্তাহিক ছুটির দিনে ওদের সাথে একটু সময় কাটাতাম, কিন্তু ওদের এত বেশি পড়াশোনা আর 'এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটিজ' ছিল, যে নাগাল পাওয়াই ছিল মুশকিল।

পাকিস্তানি আরশাদ ভাই আর ফিনল্যান্ডের রিস্টো সাহেব ছিলেন বেশ সজ্জন মানুষ। কিন্তু তাদের সাথে দেখা হওয়া কথাবার্তা হওয়ার সুযোগ আরও কম। ব্যস্ত সবাই। বেশ কিছু ভারতীয়ও ছিল, কিন্তু ওরা নিজেদের এক আলাদা জগত তৈরি করে ফেলেছিল, যেখানে অন্যদের ঢোকার ঠিক সু্যোগ ছিল না। তাই একাকিত্বটাকেই উপভোগের বিষয় বানিয়ে নিতে হয়েছিল।

শান্ত সবুজ ক্যাম্পাসের মধ্য দিয়ে হাঁটতে, কখনো লেকের পাশে বসে পাখির ডাক শুনতে কিংবা কখনো নদীরপাড়ের রেলিং ধরে ওপারের পাহাড়যুগলের তাকিয়ে থাকতে বেশ ভালো লাগত।

দক্ষিণ দিক থেকে তখন প্রশান্ত মহাসাগরীয় ভেজা বাতাস ঝাপ্টা দিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশ ঘেঁসে নদী। নদী তীর ধরে বেশ চমৎকার হাঁটাপথ। একটু ভেতর দিয়ে বাসরাস্তা পেরিয়ে ভেতরে বেশ বড় আঁকাবাঁকা জলাশয়।

তার পাশে সবুজ বনানি; আকারে ছোট, তবুও বেশ সুন্দর। জলাশয়ের পানিতে সন্ধ্যার রঙ, মৃদু বাতাস, আর সন্ধ্যায় ঘরে ফেরা পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ। বেশ লাগত সন্ধ্যার সময়টা।

কর্তৃপক্ষ সিমেন্ট এবং কাঠের বেঞ্চ বসিয়ে রেখেছে বেশ কিছু। উদ্দেশ্য, জ্ঞানপিপাসুরা অধ্যয়নের পাশে প্রকৃতির মাঝে কিছু সময় কাটাবে। সবাই ব্যস্ত। কার সময় আছে এখানে দু'দণ্ড বসার ! এমনকি কারো সাথে প্রয়োজনের বেশি কথা বলার!

মুঠোফোন, 'কিউকিউ', ফেইসবুক, ওয়েসিন- আরও কত কী বন্ধুর স্থান, প্রকৃতির স্থান দখল করে ফেলেছে! দেড়বছর মাত্র ক্যাম্পাসের বয়স। অথচ এরই মধ্যে শ্যাওলা ধরে গেছে বসার বেঞ্চগুলোতে!

তবে ম্যাকাওয়ে আমার একাকী সময় কাটানোর সবচেয়ে আদর্শ জায়গা ছিল 'হ্যাকসা বিচে'র পাশে, পাহাড়ের ধারে সাগরের পারে। একদিকে সুবিশাল প্রশান্ত মহাসাগরের অংশবিশেষ অন্যদিক পাহাড়।

মাঝখানে পাথর কেটে বানানো হাঁটা রাস্তা। দূর দিগন্তে, যেখানে সাদা মেঘের ছোপ লাগা নীল আসমান এসে প্রশান্ত মহাসাগরের সুনীল জলের সাথে মিলিত হয়েছে বলে মনে হয়, সেদিকে তাকিয়ে ক্ষুদ্র আমাকে আরও বেশি ক্ষুদ্র আর নগণ্য মনে হত। আরও বেশি একলা মনে হত।

তারপরও মুগ্ধ হতাম। কতদিন পাহাড়ের ঢালে, বড় পাথর খণ্ডে শরীর এলিয়ে সমুদ্র দেখতে দেখতে আর তার গর্জন শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে গিয়েছি!

কখনো পেছনের 'অ্যাল্টো ডি কোলোয়ান' পাহাড়ের সবুজ পরিবেশে মেঠো পথ ধরে হারাতাম, কিংবা শহরের মধ্যে 'গুইয়া ফোর্ট', 'ম্যাকাও মিউজিয়াম', কয়েকশ' বছরের পুরনো গির্জা, মেরিটাইম মিউজিয়াম, সাইন্স মিউজিয়াম, ম্যাকাও টাওয়ার ইত্যাদি ঘুরে বেড়াতাম।

যদিও একাই ঘোরা হত, তবুও দুয়েকবার শুভ, তৌকির আর আরশাদ ভাই কিংবা আমার গবেষণা-সহকারী ফাংইয়ুয়ানও সঙ্গী হয়েছিল। এখানকার ক্রিকেট সংগঠনের পরিচালক আদনান ভাইয়ের উৎসাহে দু'তিনদিন ক্রিকেটও খেলে ফেললাম!

এমনকি আমরা ৮-১০ জন মিলে 'ইউনিভার্সিটি অফ ম্যাকাও' এর ক্রিকেট টিমও তৈরি করে ফেলেছিলাম, তবে আমার সেখানে নিয়মিত হয়ে যাওয়ার আগেই ম্যাকাও ছাড়তে হয়েছিল।

হালাল খাবারের দোকান ম্যাকাওতে একেবারেই কম। রান্নাবান্না করে খাওয়াই ছিল অবলম্বন অধিকাংশ সময়েই। তবে সারাদিন কাজের পরে সেটা খুব বিরক্তিকর ছিল। আমরা মাঝে মাঝে এক ইন্দোনেশিয় খাবার দোকানে যেতাম।

তবে সেটা অনেক দূর আর খাবারের স্বাদও আমাদের জিহ্বার জন্য ততটা উপাদেয় ছিল না, কিন্তু কাজ চলে যেত। তবে শুক্রবারে জুমার নামাজের পরে মসজিদে দেওয়া খাবারটা অসাধারণ লাগত।

ম্যাকাওয়ে মুসলিম খুবই অল্প সংখ্যক এবং মসজিদ মাত্র একটা, সাথে কবরস্থান। এখানে এলেই কি অদ্ভুত শান্তি লাগত!

অন্যদিন নিয়মিত সুযোগ না পেলেও জুমা আমরা 'মিস' করতাম না। আর দুপুরের পরে পথচলতি মুসলিমদের জন্য বেশ চমৎকার খাবারের ব্যবস্থা থাকত। কতোদিন লাইন ধরে দাঁড়িয়েছি সেই খাবারের আশায়!

ম্যাকাও থাকাকালীন দু'তিনবার বাংলাদেশ গিয়েছি। প্রতিবার ম্যাকাও ছাড়ার সময়ে বেশ ভাল লাগত। একে তো প্রিয়জনদের সাথে মিলিত হবার প্রত্যাশা, অন্যদিকে যাত্রাপথের অনিন্দ্য সৌন্দর্য।

'রানওয়ে' ধরে বিমান যখন দৌড়ানো শুরু করে, জানালা দিয়ে পাশেই সমুদ্র দেখতে পাওয়া যায়। উড্ডয়নের পরে সাগরের নীল জলে ভেসে থাকা মালবাহী জাহাজগুলো ছোট খেলনার মত লাগে। ছোটবেলায় আমরা সুপারি গাছের খোল দিয়ে নৌকা বানিয়ে পুকুরে ভাসাতাম- ঠিক ওই রকম।

কিছুক্ষণ পরপরই চোখে পড়ে সমুদ্র ফুঁড়ে মাথা উঁচু করে উঠে আসা ছোট ছোট অসংখ্য পাহাড়ি দ্বীপ। বিমান যখন দক্ষিণমুখো হয়ে ছুটে চলা শুরু করে, জানালা দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে সাদা পেঁজা তুলার মত মেঘের ফাঁকে প্রশান্ত মহাসাগরের সুগভীর নীলিমা অসম্ভব সুন্দর লাগে।

শেষবার ম্যাকাও ছাড়তে তেমন মনোকষ্ট হয়নি। আসলে এখানে আমার মন একেবারেই টিকছিলো না।

ম্যাকাও ত্যাগের সপ্তাহখানেক আগে আরশাদ ভাইয়ের নিমন্ত্রণ, আর খাওয়া-দাওয়া শেষে তিনিসহ শুভ তৌকিরকে নিয়ে একদিন ঘোরা হয়েছিল।

আরেকদিন বিকালে আদনান ভাইয়ের কফির নিমন্ত্রণ, কলকাতার প্রতীতি দিদির সান্ধ্য খাবারের নিমন্ত্রণ বেশ উপভোগ্য ছিল। 

বিমানবন্দরে বিদায় দিতে আসা শুভ, ইয়াসির আর ফাংইয়ুয়ানের প্রতি কৃতজ্ঞ বোধ করছিলাম। যাক, অন্তত কিছু ভালোবাসা নিয়ে এই দেশ ত্যাগ করতে পারছি।

লেখকের কথা:

আমি লেখক নই। জীবনের নানা বাঁকের ছোট ছোট টুকরো কিছু ঘটনা মাঝে মাঝে দিনপঞ্জিতে লিখি, এই আর কি। পড়াশুনা এবং জীবিকার তাগিদে বেশ কিছুদিন ধরেই প্রবাসে। এখন ভিয়েতনামে থাকলেও ম্যাকাওএ ছিলাম কিছুদিন। আমার অতি সাধারণ প্রবাস জীবনের সাধারণ কিছু টুকরো অভিজ্ঞতা, সাধারণ কিছু কথা বলার জন্যই এখানে লেখা।

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি