মেঘের ওপরে সবুজ দেশে

পাহাড় আমার চিরকালীন মুগ্ধতা। হয়ত সমতলভূমির মানুষ বলেই আগ্রহটা বেশি।

মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান খান, ভিয়েতনামের হো চি মিন থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Dec 2016, 12:28 PM
Updated : 6 Dec 2016, 01:30 PM

চীনে প্রায় সব শহরেই ছোট-বড় পাহাড় কিংবা পর্বত আছে। আমাদের লুঝৌ জীবনে পথ চলতে কখনো দূর দিগন্তের দিকে চোখ পড়লে পাহাড়ের দেখা মিলত মাঝে মাঝেই।

সাদা মেঘ ভেসে যাওয়া নীল আকাশের পটভূমিতে মাথা উঁচু করে সারি সারি দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়গুলো নিজেদের বিশালতার জানান দিয়ে আমাদের ডাকত।

কিন্তু ব্যস্ত কর্মজীবনে সময় বের করা খুব সহজ নয়। বিশেষ করে পরবাসে, যেখানে সময়ের হিসেবে ঘাম বিক্রি করে পেট চালাতে হয়।

কোন এক গরমের ছুটির প্রাক্কালে আমার বন্ধু লিউ প্রস্তাব করল, কোথাও ঘুরতে যাব নাকি?

আমার ইচ্ছে ছিল এমেই পর্বত। চীনের অন্যতম বিখ্যাত পর্বত 'এমেই শান' (চীনা ভাষায় 'শান' মানে পর্বত, আর 'এমেই' কে কেউ উচ্চারণ করেন 'অমেই' বা কেউ 'আমেই')।

সিচুয়ান প্রদেশের মধ্যবর্তী এলাকায় এমেই পর্বতের অবস্থান। উচ্চতা ৩ হাজার ৯৯ মিটার (১০ হাজার ১৬৭ ফুট)। শুনেছি, অনেক সুন্দর। অনেক দিন থেকেই ইচ্ছে ছিল ওখানে যাবো। 

ছেলে আর তার মা খুব খুশি। আসলে অনেকদিন ধরে কাজের ব্যস্ততায় পারিবারিক সময় একেবারেই কম কাটানো হচ্ছিল। আমাদের দুই পরিবারের একসাথে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। আমরা লুঝৌ থেকে, আর তারা চাংশা থেকে।

আমাদের দেখা হওয়ার কথা ছিল চেংদুতে। কিন্তু শেষ সময়ে লিউ'র স্ত্রীর যাওয়া হল না ব্যক্তিগত কিছু কারণে।

শুরু করলাম চেংদুর বিখ্যাত পান্ডা পার্ক (জায়ান্ট পান্ডা ব্রিডিং রিসার্চ বেজ) দিয়ে। বিভিন্ন ধরনের পান্ডার জীবনধারণ পদ্ধতি দেখতে দেখতে এক বিকেল কেটে গেল।

পরদিন খুব সকালে আমরা রওনা হলাম 'লে'শান' শহরের পথে। এখানে বুদ্ধের বিশাল এক মূর্তি আছে। প্রচুর মানুষের সমাগম হয়। আমাদের অবশ্য আগ্রহ ছিল অন্যদিকে।

পাহাড় আর নদী নিয়ে 'লে'শান'ও খুব সুন্দর। আমরা তাই প্রকৃতি নিয়েই মুগ্ধ হয়ে থাকলাম। এর বাইরে এ শহরে পাওয়া গেল হাজার বছর আগের গাছ আর কাঠের জীবাশ্ম নিয়ে এক যাদুঘর  আর একটি 'ক্রিস্টালে'র যাদুঘর।

বিকেলের আগে আবার যাত্রা শুরু। এবার আসল গন্তব্য।

'এমেইশান' শহরে ঢোকার সময় অনেকক্ষণ ধরে পর্বতের চূড়া দেখা যায়। মেঘেদের দেশের অনেক উপরে মাথা উঁচু করে সে যেন আমন্ত্রণ জানাচ্ছে পর্যটকদের। গোধূলির রক্তিম আলো এসে চূড়ার সোনালী রঙের মন্দিরে প্রতিফলিত হয়ে ঝলমল করছে।

নীল আকাশ, সাদা মেঘ, তার উপরে সবুজ পাহাড়, আর তার মাথার এককোণে একবিন্দু সোনালী আলোর ঝলকানি। আহা! কি সেই দৃশ্য! 

হোটেলে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। রাতে আমরা গেলাম বিশ্বখ্যাত 'সিচুয়ান অপেরা'র প্রদর্শনীতে। এদের 'মুখ পরিবর্তনের' (চীনা ভাষায় যাকে বলে 'বিয়ান লিয়ান') শিল্পটি অসাধারণ। চোখের পলকেই মুখোশের মাধ্যমে তারা মুখাবয়ব এবং মুখভঙ্গী পরিবর্তনের মাধ্যমে দারুণভাবে সমাজচিত্র বা জীবনচিত্র তুলে ধরেন।

পথের ক্লান্তি আর সেই সাথে পরবর্তী দিনের ভ্রমণ প্রস্তুতি, তাই তাড়াতাড়ি বিছানায় চলে গেলাম।

ভোর রাত তিনটায় আমাদের বের হতে হল। সাড়ে তিনটার মধ্যে পাহাড়ের বেজ-স্টেশনে পৌঁছাতে হবে। মনে মনে ভাবছিলাম "হাগল নি (পাগল নাকি) ! এই আন্ধার রাইতে কেউ ঘুরতে বাইর হয়!"

বেজ-স্টেশনে গিয়ে দেখি হাজার হাজার মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়ে ওঠার বাসের অপেক্ষায়।

আমাকে অবাক হতে দেখে লিউ বলল, "অনেকে রাত ৯-১০টায় এমেইশান শহরের  এই বেজ-স্টেশনে এসে লাইনে দাঁড়িয়ে (নাকি শুয়ে!) যায়। আগে সিরিয়ালও পাওয়া গেল, আবার হোটেল ভাড়াও বেঁচে গেল।

বেশিক্ষণ অবশ্য লাইনে দাঁড়াতে হল না। প্রচুর বাস। আধ-ঘণ্টায় আমাদের পালা এসে গেল। পাহাড়ের গায়ে এঁকেবেঁকে বাসের রাস্তা করা হয়েছে। এতটুকু চওড়া যাতে অনায়াসে দু'টো বাস পাশাপাশি চলতে পারে কিংবা উলটো দিক থেকে এসে পাশ কাটাতে পারে।

একদিকে খাড়া পাহাড় আর অন্য দিকে বিশাল খাদ, আবার কখনো পার্শ্ববর্তী পাহাড়ের ঢাল। রাস্তা আর ঢালের মাঝে খুব ঘন গাছের সারি। বাস পড়ে যাওয়ার তাই তেমন একটা ভয় হল না।

এক সময় চলার পথে এখানে-সেখানে খণ্ড খণ্ড মেঘ ভেসে বেড়াতে কিংবা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। মনে হল, মেঘেদের বাচ্চাগুলো ভোরবেলার অতিথিদের অবাক হয়ে দেখছে।

পূর্বাকাশ লাল হয়ে উঠল ধীরে ধীরে। কিছুক্ষণ পরে পূর্বদিকে সবুজ পাহাড়ের পরে বিস্তীর্ণ সাদা মেঘের বিছানা থেকে লাল থালার মত সূর্য্যি মামা আস্তে আস্তে মাথা তুলে তাকালেন। সে এক অপার্থিব সৌন্দর্য!

প্রায় তিন ঘণ্টা পথ চলে বাস থেমে গেল সমতলভূমির মত জায়গায়। এখানে বিশাল এক বাজার আছে। আছে বেশ কিছু হোটেলও। খাবার দোকানের জানালা দিয়ে দেখা যায়, অনেক নিচে মেঘেদের ভেসে বেড়ানো আর তার নিচে ছোট খেলনার মত দেখতে ঘর-বাড়ি।

আমাদের সামনে এবার হাঁটাপথ। 'ট্র্যাকিং'র সুবিধার জন্য আমরা প্রত্যেকেই একটা করে লাঠি (বাঁশ) কিনে নিলাম।

আমাদের তিন বছরের ক্ষুদে পর্বতারোহী আম্মার বাবুও ((মানে আমার ছেলে আর কি) একটা নেবে ! কি আর করা, দিলাম। বড়দের মত লাঠি হাতে নিয়ে (লাঠি টানতে টানতে) সে হাঁটা শুরু করল। কিছুক্ষণ পরে অবশ্য ক্লান্ত হয়ে তার মায়ের হাতে লাঠি ধরিয়ে বাবার কাঁধে চেপেই চলতে শুরু করল।

উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথ ধরে শত শত মানুষ হেঁটে চলছে। ডান পাশে খাড়া পাহাড়ের দেয়াল। আর বাম পাশে কখনো খাদ, কখনো অন্য পর্বতের দেয়াল, কখনো ছোট-খাট জঙ্গল। আবার কখনো বিস্তীর্ণ শুন্যতা।

শত মাইল দূরে হয়ত কোন পর্বতের চূড়া দাঁড়িয়ে আছে। মাঝখানে ছোট ছোট অসংখ্য পাহাড়, আর পাহাড়ি সবুজের মাঝে সাদা মেঘের লুকোচুরি।

প্রায় তিন-চার কিলোমিটার হেঁটে আমরা এক পর্বত চূড়ায় পৌঁছলাম। সামনে যাওয়ার উপায় নেই আর। এখান থেকে শুরু বিশাল খাদ। সামনের পর্বতচূড়া আমাদের গন্তব্য।

পার হতে হবে বিশাল আকারের 'কেবল কারে'। একেকটা কেবল কারে ৩০ জন করে! অনেকটাই মাইক্রোবাসের মত। ভেতরে সবার দাঁড়ানোর ব্যবস্থা। আমাদের আম্মার সাহেব তার আধো আধো বোল দিয়ে নাম দিল 'হেলিকপ্পার মত গাড়ি', মানে হেলিকপ্টারের মত গাড়ি আর কি! 

কি প্রযুক্তি তা জানি না, তবে এত বড় কেবল কার মিনিট বিশেকের মধ্যেই পাঁচ-সাত কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ফেলল। তাও আড়াআড়িভাবে উপরে উঠেছে। আমরা পৌঁছে গেলাম এমেই পর্বতের একেবারে চূড়ায়। ভূমি থেকে তিন কিলোমিটার উচ্চতায়।

আমার খুব সখ ছিল মেঘের সমুদ্র দেখব। হল না। একেবারে পরিষ্কার ঝকঝকে আবহাওয়া। সকালে যে মেঘটুকু ছিল, তাও প্রায় কেটে গেছে। শুধু এখানে ওখানে কিছু ছোপ ছোপ মেঘ। তাও অনেক নিচে। এমেই পর্বতচূড়া থেকে নিচের দিকে মেঘের সমুদ্র দেখতে বেশ লাগে। সে চিত্র আমাদের দেখা হল না।

যদি কারো সখ থাকে 'গুগল'-এ ইংরেজিতে 'মাউন্ট এমেই ক্লাউড সি' লিখে খুঁজে দেখতে পারেন। উইকিপিডিয়াতেও আছে বেশ সুন্দর কিছু ছবি।

বেশ কিছু মন্দির আছে চূড়ায়। ভক্তরা সেখানে ভিড় জমাচ্ছে। একটা বেশ বড় মন্দির সোনালী রঙের, এখানেই সূর্যের আলো প্রতিফলিত হতে দেখেছিলাম সন্ধ্যার আগে।

আমরা হাঁটলাম, ঘুরলাম, খেলাম, খাদের কিনারায় গিয়ে ঘুরে দেখে এলাম। আহ! পর্বত, সবুজ, মেঘের উপরে কি অসাধারণ সৌন্দর্য!

বেলা একটু পড়ে এলে ফেরার পালা। এবার কেবল কার নিচের দিকে নামল। আরো কয়েকটি জায়গা ঘুরে আবার একটি ছোট কেবল কার পার হয়ে আমরা যেখানে এলাম, সেখান থেকে নিচের দিকে হেঁটে নামতে হবে। গাইড সাবধান করে বলল, হাতে লাঠি রাখতে আর দল বেধে যাত্রা করতে। এখানে নাকি বানরের দল বেশ ঝামেলা করে।

কতক্ষণ হেঁটেছিলাম মনে নেই। ছেলে কাঁধে কিংবা কোলে। নামতে হচ্ছে নিচে, কখনো সিঁড়ি বেয়ে, কখনো ঢালু পথ ধরে। এক সময় শরীর অবশ হয়ে এলো। বন্ধু লিউ অনেক সাহায্য করল।

ছেলের মায়ের অবস্থাও করুন। এত হাঁটার অভ্যাস তার নেই। তার উপর উঁচু পাহাড়ি পথে এই প্রথম। যখন মনে হল আর পারব না, তখনই যেন হঠাৎ পথ শেষ হয়ে সমতলভূমিতে এসে পড়লাম।

সামনে নদী। পানি খুব কম। পাথরের বিছানা। কোথাও একেবারে শুকনো, আবার কোথাও টলটলে পানি। স্রোত অবশ্য কম। নদীর পাড় ধরে হেঁটে হেঁটে এক জায়গায় গিয়ে কাঠের ঝুলন্ত সেতু পার হয়ে শহরের মধ্যে ঢুকলাম। এখানেই আমাদের ট্যুর গ্রুপের সবার থাকার কথা।

রাতখানা শহরে কাটিয়ে খুব ভোরে চেংদু শহরের পথে রওনা দিলাম। লুঝৌ পৌঁছতে বিকেল হয়ে এলো। এমেই পর্বতে উঠানামা করতে আমাদের প্রায় ১২-১৪ কিলোমিটার হাঁটতে হয়েছিল। তার উপর ভ্রমণক্লান্তি। টানা এক সপ্তাহের বিশ্রামের পরেও মনে হচ্ছিল শরীর ক্লান্ত।

তবে মনের ব্যাপার ঠিক উল্টো। এই ক'দিনে আমরা শুধু এমেই পর্বতের গল্প করেই কাটিয়েছি। এমনকি তিন বছরের শিশুর চোখ থেকে মস্তিষ্কেও মেঘের দেশের সবুজ পর্বতের বিশালতা আর অসীম সৌন্দর্য। এ এক অদ্ভুত ভালো লাগার স্মৃতি! 

লেখকের কথা:

আমি লেখক নই। সাহিত্যজ্ঞানও শূন্যের কোটায়। বিজ্ঞানের ছাত্র। বৈচিত্র্যময় জীবনের নানা বাঁকের ছোট ছোট টুকরো কিছু ঘটনা মাঝে মাঝে দিনপঞ্জিতে লিখি, এই আর কি। পড়াশোনা এবং জীবিকার তাগিদে বেশ কিছুদিন ধরেই প্রবাসে। এই মুহূর্তে আছি ভিয়েতনামের হো চি মিনে। তবে চীনে ছিলাম এর আগে বেশ কিছুদিন। আমার অতি সাধারণ প্রবাস জীবনের সাধারণ কিছু টুকরো অভিজ্ঞতা, সাধারণ কিছু কথা বলার জন্যই এখানে লেখা।