'গুইঝৌ'র আকাশের কাছাকাছি

গুইঝৌ প্রদেশের লিউপানসুই শহরে গিয়েছিলাম এক চীনা মুসলিম পরিবারের আমন্ত্রণে।

মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান খান, চীনের লুঝৌ থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Feb 2017, 11:49 AM
Updated : 24 Feb 2017, 11:59 AM

বন্ধু ঝাং ছাইদং (যার ইসলামিক নাম নুরুল ইসলাম) দায়িত্ব নিল আমাদের ঘুরে দেখানোর। সময় বেশি নিয়ে যাইনি। একটা পুরো দিন শুধু পেলাম কোথাও ঘুরে আসার।

আমরা ঠিক করলাম, ‘জিউছাইপিং’ যাবো। দুই হাজার নয়শ' মিটার উচ্চতা নিয়ে এটা ‘গুইঝৌ’র সবচেয়ে উঁচু পর্বত।

আগের দিন বিকেলে কিছু ঘোরাঘুরি আর সন্ধ্যায় নুরুল ইসলামের পরিবারের সাথে জম্পেশ খাওয়া-দাওয়ার পরে হোটেলে ফিরে বেশ ক্লান্ত ছিলাম। রাতে তাই ঘুম ভালই হল। সকালে ফজরের নামাজের পরে আরেক প্রস্থ ঘুম দিয়ে উঠলাম আমাদের চীনা বন্ধুর ডাকে। সকাল আর দুপুরের খাওয়া একসাথে সেরে নিলাম।
শৈলশহর লিউপানসুইএ মানুষ খুব কম মনে হল। রাস্তায় গাড়ির সংখ্যাও খুব কম মনে হল। শহর ছাড়িয়ে আমরা একটা বাঁক নিয়ে 'মেই-হুয়া শান' যেটাকে ইংরেজিতে বলে 'প্লাম ব্লসাম মাউনটেইন' এর মধ্যে ঢুকে পরলাম।

পর্বতের গায়ে আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে গাড়ি ক্রমশ উপরে উঠে চলল। এর আগে বেশ কয়েকটি পর্বতে আমার ঘোরার অভিজ্ঞতা হলেও আমার সফরসঙ্গী মুজাহিদ, রাজু আর সাদের জন্য উঁচু পর্বতে ঘোরা সম্ভবত এই প্রথম। একেকটা বাঁক নিয়ে আমরা যখন উপরে উঠছিলেম উল্টো দিকের দূরের এবং অদূরের পর্বতচূড়াগুলো আর তাদের মাঝের খাদসমূহ, কিংবা দূরের নদী আর উপত্যকাগুলো আমাদের চোখে অদ্ভুত এক সৌন্দর্য নিয়ে ধরা দিচ্ছিল।

শহরের মধ্যে যেসব পাহাড় আমাদের কাছে অনেক উঁচু মনে হয়েছিল, সেগুলোকে এখন অনেক ওপর থেকে দেখতে 'পর্বতের বাচ্চা' বলে মনে হচ্ছিল। আমরা মেই-হুয়া পর্বতের গায়ের পথ ধরে এগিয়ে চললাম। পর্বতের উপরে অগণিত 'উইন্ডমিল'। আমার সফরসঙ্গীরা অবাক- এত ওপরে এই 'উইন্ডমিল', 'বৈদ্যুতিক টাওয়ার', এত চমৎকার রাস্তা কীভাবে কতদিনে এরা তৈরি করেছে!
আমরা এক জায়গায় থামলাম। মেটে আলুর 'বারবিকিউ' করে বিক্রি করছেন এক বৃদ্ধ দম্পতি এখানে। চারদিক অদ্ভুত সুন্দর। পেছনে পর্বতের গা, সামনে বিশাল খাদ। তার পরে ছোট ছোট পাহাড়সারি। বহুদূরে উপত্যকা মাঝে ছোট শহর।  গতকাল আবহাওয়ার পূর্বাভাসে দেখেছিলাম, আজ বৃষ্টির সম্ভাবনা। স্বভাবতই একটু শঙ্কিত ছিলাম। কিন্তু উপরওয়ালা আমাদের নিরাশ করলেন না। চমৎকার রোদ ঝলমলে দিন। মেঘও নেই। পর্বতের গায়ের গাছের সারির মধ্য থেকে ঝুপঝুপ করে রাতের জমে থাকা বরফ ঝরে পড়ছে।
আমরা আবার চলতে শুরু করলাম। একসময়ে নেমে এলাম মেই-হুয়া পর্বত থেকে। উপত্যকা মাঝে এক শহর পার হয়ে আমাদের বাহন ছুটে চলল যেদিক পানে, সেদিকে বহুদূরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আরেক পর্বত শ্রেণি। পাহাড়ি পথে ভ্রমণক্লান্তিতে সবাই প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছে। আমিও বোধ হয় একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিলাম। একসময়ে লক্ষ্য করলাম বেশ সুন্দর ছোট ছিমছাম এক শহর পাশ কাটিয়ে আমরা আবার অনেক উপরে উঠে যাচ্ছি।

আমাদের গাড়ি এসে যেখানে থামল, সেখানকার উচ্চতা দুই হাজার ছ'শো মিটার। আরও তিনশ' মিটার উঁচুতে ওই যে সমান উঁচু দুটো চূড়া দেখা যায়! সফরসঙ্গীদের মধ্যে দুজন একটু অসুস্থ হয়ে গেল।

সম্ভবত প্রচণ্ড ঠাণ্ডা বাতাস আর উচ্চতার তারতম্যের কারণে একটু সমস্যা হচ্ছিল নিঃশ্বাসে। পর্বতচূড়ায় ওঠার জন্য কয়েক জায়গা দিয়ে কাঠের সিঁড়ি দেখা গেল। সেদিকে না গিয়ে নরম ঘাস আর অসংখ্য বোল্ডারে (মাঝারি আকারের পাহাড়ি পাথর) ঢাকা ঢাল বেয়ে উঠতে লাগলাম।

বেশ খানিকটা উঠে এক বোল্ডারের উপরে বসলাম বিশ্রামের জন্য। চারদিকে তাকিয়ে মন এবং শরীরের সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। অন্য অনেক পর্বতের মতো ‘জিউছাইপিং’ এর চূড়ার দিকটা খাড়া নয়।

বিস্তীর্ণ ঢাল (মনে হয় হেলে পড়া সমভূমি)। বসন্তকালে এই পর্বতচূড়া আরও সুন্দর লাগে। তখন সমস্ত পর্বতের ঢালু গায়ে ফোটা 'গারলিক সিভস' ফুল নয়নাভিরাম দৃশ্যের অবতারণা করে। আবার মেঘময় বর্ষাকালে এখানে 'ক্লাউড সি' দেখা যায়। আমরা এলাম রোদ ঝলমলে শীতের দিনে। সেদিন অবশ্য বরফ ছিল না।

বেশিদূর এগোলাম না ঢাল বেয়ে। পর্বতের গা, পাথর- কী জানি কেন যেন র‍্যাটল সাপের কথা মনে হল। অবশ্য এখানে র‍্যাটল সাপ থাকার প্রশ্ন আসে না, তবে অন্য সাপ থাকতে পারে।

খানিক সামনে এগিয়ে কাঠের 'ট্রেইলে'র সন্ধান পেলাম। সামনেই দেখি সফরসঙ্গীরা বসে বিশ্রাম নিচ্ছে। একটু এগিয়ে পুরোনো হয়ে যাওয়া ছোট এক ঝরনার সন্ধান পাওয়া গেল। শীতের শুষ্কতায় চুইয়ে চুইয়ে পানি পড়ছে। দু'কোশ পানি দিয়ে তৃষ্ণা মেটালাম। অসুস্থ হয়ে যাওয়া সফরসঙ্গীরা আর উঠতে চাইল না। কিন্তু এত কাছে এসেও চলে যাবো? আস্তে আস্তে উঠতে শুরু করলাম।

বেশ কয়বার বিশ্রাম নিয়ে এক সময়ে পৌঁছেও গেলাম চূড়ায়। কী অসম্ভব সুন্দর, নিস্তব্ধ চারদিক। ছেলেবেলায় বইয়ে পড়েছি, তিব্বতের পামির মালভূমি পৃথিবীর সর্বোচ্চ সমভূমি; তাই একে 'পৃথিবীর ছাদ' বলা হয়ে থাকে। সে হিসেবে আমি এখন চীনের গুইঝৌ প্রদেশের ছাদে।

আমাদের মধ্যে সাদ মোটাসোটা মানুষ। আমি ভেবেছিলাম সে মনে হয় গাড়িতে বসে ঝিমাবে, উপরে উঠবে না। নাহ! ব্যাটার সাহস আছে। বেশ খানিক পরে হেলতে দুলতে সেও উপরে উঠে এলো! কিছুক্ষণ পরে আমরা নেমে ফেরার পথ ধরলাম। আসার পথে বন্ধু ঝাং ছাইদং (নুরুল ইসলাম) আমাদের মেই-হুয়া পর্বতের ভিতরের দিকে নিয়ে গেল। আসার সময়ে এই পর্বতের গা'য়ের পথ ধরেই এসেছিলাম। এই পর্বতের মাঝে আছে বিশাল এক 'স্কি রিসোর্ট'।
যেদিন বরফে পর্বত ছেয়ে যায়, সেদিন অনেকেই স্কি করতে আসে। বছরে দুইবার 'ইন্টারন্যাশনাল স্কি ফেস্টিভাল' হয় এখানে। পর্বতের মাঝে বেশ সুন্দর একটা মসজিদ চোখে পরল। মেই-হুয়া পর্বতের একটা চূড়ায় বিশাল এক 'ওয়াচ টাওয়ার' আছে। তার নিচে তৈরি হচ্ছে ভারি সুন্দর কাঠের বাংলো আর 'ইগলু' আকৃতির ছোট ছোট ঘর। অদূর ভবিষ্যতে হয়ত এই মেই-হুয়া পর্বত আর জিউছাইপিং পর্বত চীনের অন্যতম পর্যটন এলাকা হয়ে উঠবে।
লিউপানসুইতে আমাদের ভ্রমণ ছিল স্বল্প সময়ের জন্য। এক বিকেল, এক সকাল আর মাঝখানে দু রাত এক দিন। বন্ধু ঝাং ছাইদং (নুরুল ইসলাম) পরিবারের আতিথেয়তা আর মেই-হুয়া পর্বত এবং জিউছাইপিং পর্বতের সৌন্দর্য দর্শন এই স্বল্প সময়টুকুকে আমাদের স্মৃতিতে অম্লান এক অধ্যায় হিসেবেই হয়তো রাখবে।

ছবি কৃতজ্ঞতা: লেখক, মুজাহিদ, সাদ, রাজু।

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি

এই লেখকের আরও লেখা 

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ, আড্ডা, আনন্দ বেদনার গল্প, ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!