ফুলের রাজ্যে আর পরীদের পাহাড়ে

সিচুয়ানের আনাচে-কানাচে এত চমৎকার সুন্দর সব জায়গা আছে, তা স্থানীয়রা ছাড়া খুব কম মানুষজনই জানে। লুঝৌ শহরে না’সি অন্যতম ‘ডিস্ট্রিক্ট’।

মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান খান, চীনের লুঝৌ শহর থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 March 2017, 10:44 AM
Updated : 17 March 2017, 12:28 PM
এই না’সিতে বেশ কিছু জায়গা আছে, যেগুলো প্রকৃতিপ্রেমিক পর্যটকদের কাছে খুব আকর্ষণীয় হতে পারে। অথচ খোদ লুঝৌয়ের অনেক মানুষই এগুলোর খবর জানে না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশি ছাত্র দিদার খুঁজে ফিরে এসব জায়গার সন্ধান পায়। সে মাঝে মাঝেই না’সি যায়। কারণ জানতে চাইলে মিটিমিটি হাসে। নিশ্চয়ই কোন রহস্য আছে! তবে একটা বিষয় খুব সত্য- না’সির প্রকৃতি বেশ সুন্দর।

সারা সপ্তাহ কাজের মাঝে নাক-মুখ-মাথা ডুবিয়ে রেখে ছুটির দিনে কোথাও না বেড়িয়ে এলে কেমন যেন ভালো লাগে না। তো এরকম দু’টো সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বাংলাদেশি ছাত্রদের তিন-চারজন নিয়ে ঘুরে এলাম মনোমুগ্ধকর দু’টো জায়গা থেকে। তাদের পরিচিত করিয়ে দিতেই এই সামান্য লেখাটুকুর অবতারণা। 

জানুয়ারির প্রচণ্ড শীতের মধ্যে গিয়েছিলাম ‘হুয়া থিয়ান জিউ দি’। না’সির কেন্দ্র থেকে ইবিনের দিকে যেতে বাস রাস্তায় ৩০ মিনিট লাগে। ঢোকার মুখেই বেশ সুন্দর একটা ঝরনা দৃষ্টি কাড়ে। চারদিকে পাহাড় ঘেরা এলাকা। পাহাড়ের গায়ে থরে থরে সাজানো সুদৃশ্য বাড়ি-ঘর। মাঝখানে উপত্যকা, হ্রদ। উপত্যকার মাঝে ফুলের বাগান করার জন্য ‘বেড’ তৈরি করে রাখা আছে। প্রচণ্ড শীতে মানুষের আনাগোনা নেই বললেই চলে। আমরা ক’জন ঘুরে এসেছিলাম কিছু বিরক্তি নিয়ে। সম্ভবত এটা ভুল সময়।

দিন কতক আগে একজন জানালো, না’সিতে এখন ফুল ফুটেছে। গেলাম গত সপ্তাহান্তে। গিয়ে দেখি জানুয়ারির সেই চেহারা আর নেই। যদিও এখানে এখনও বেশ শীত এবং বসন্ত আসতে আরও মাসখানেক দেরি। ‘হুয়া থিয়ান জিউ দি’র প্রকৃতি কিন্তু তা বলে না। বসন্তকে বরণ করে নেওয়ার জন্যই বোধহয় এখানকার শীত রঙের পসরা সাজিয়ে বসেছে। এ যেন এক ফুলের রাজ্য!

সমস্ত উপত্যকা জুড়ে ফুল ফুটেছে। হাজারও রকমের, হরেক রঙের। ফুল দেখতে খুব ভালো লাগে, কিন্তু শনাক্ত করতে পারি না বললেই চলে। তবুও কয়েক রকমের গোলাপ, গাঁদা আর টিউলিপ চিনতে পারলাম। 

উপত্যকার উপরের দিকে রাস্তার দুই ধারে চোখ ধাঁধানো শুভ্রতার মেলা সাজিয়ে দাঁড়িয়ে আছে চেরি ফুলের গাছ। ছোট ছোট বালক-বালিকারা মহা উৎসবে ছোটাছুটি করছে, খেলছে। তাদের সাথে আসা বাবা-মা কিংবা দাদা-দাদীরাও যেন সব শিশু হয়ে গেছেন। কত বিচিত্র ভঙ্গিমায় তারা ছবি তুলে নিচ্ছে! আর তরুণ-তরুণী জোড়াদের জন্য এ যেন এক ‘স্বর্গোদ্যান’।

এসব জায়গায় এত মানুষের ভীড়ে মাঝে মাঝে আমাদের একটু অসুবিধায় পড়তে হয়। একসাথে অনেকে ছেঁকে ধরে তাদের সাথে ছবি তোলার জন্য। কী আর করা! আবদার মেটাতে হয়। আমাদের ছেলেগুলোর চোখের দিকে তাকালে তখন ‘সেলিব্রেটি’ হওয়ার আনন্দ খুঁজে পাওয়া যায়।

ফুল খুব সুন্দর জিনিস। চোখ দিয়ে তার সৌন্দর্য উপভোগ করতে হয়। বর্ণনা দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। তার চেয়ে ভালো ফুলে সাজানো ‘হুয়া থিয়ান জিউ দি’ উপত্যকার কিছু ছবি দিয়ে দেই পাঠকদের জন্য। আর আমি বরং চলে যাই পরীদের পাহাড়ের কথায়। 

‘পরীদের পাহাড়’! সে আবার কী জিনিস? এ প্রশ্নটাই মাথায় আসল। চীনা নাম ‘থিয়ান সিয়ান দং’ ইংরেজিতে লেখা আছে ‘ফেয়ারি কেইভ’। না’সি থেকে ইবিনের উলটো দিকে বাস রাস্তায় ঘণ্টাখানেকের পথ পেরিয়ে এই পরীদের গুহা সম্বলিত পাহাড়ে যাওয়া যায়।

স্থানীয় কিংবদন্তী অনুসারে এই পাহাড়ে পরীরা এসে নাচত, গাইত। বিশেষ ধরনের অসংখ্য গুহা আছে পাহাড়ের গায়ে, সেগুলো নাকি পরীদের বানানো। পাহাড়ের উপরে ‘ফেয়ারি টেম্পল’ বা ‘পরী মন্দির’-এর দেখা পেলেও পরীদের দেখা পাইনি। অবশ্য জ্যান্তপরী কখনও দেখিনি, তাই দেখলেও চিনতাম কিনা সন্দেহ আছে। শুনেছি তারা খুব সুন্দর, আর তাদের পিঠে ডানা থাকে। ফুটফুটে চীনা বাচ্চামেয়েরা পেছনে ডানাওয়ালা ফ্রক পরে যখন ঘুরে বেড়ায়, তখন পরীদের কথাই আমার মনে হয়। 

‘থিয়ান সিয়ান’ পাহাড় বেশি বড় নয়। কিন্তু লাল পাথরের দেয়াল কেটে করা সরু রাস্তা ধরে হেঁটে যেতে যেতে কী এক ভালোলাগার অনুভুতি হয়! কখনও সরু সিঁড়ি বেয়ে উঁচুতে, কখনও নিচুতে নামতে হয় এগোতে গেলে। অদ্ভুত নিস্তব্ধ চারদিক!

আমাদের পরীদের আসল গুহাগুলোয় ঢোকা হল না। ভেতরে মেরামতের কাজ চলছে। তাতে কী, আমরা পাহাড়ি সরু পথ ধরে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। অসংখ্য গুহা, বেশ কয়েকটি ঝরনা (অবশ্য শীতের এই সময়ে সব ফোটাফোটা পানি পড়ছে) দেখতে দেখতে দিন কেটে গেল। মাঝখানে খাওয়া-দাওয়া হয় পাহাড়ের উপরে আধা-ঝুলন্ত এক রেস্তোরাঁয়। ‘হাইকিং’-এর পরে ক্ষুধার মাঝে ঐতিহ্যবাহী চীনা খাবার, তাও আবার এরকম মনোমুগ্ধকর পরিবেশে- বেশ লাগল। 

শিল্পী মান্নাদে’র কণ্ঠে একটা গান শুনতে বেশ ভাল লাগে।

‘ফুল পাখি বন্ধু আমার ছিল,

আর মেঘ নদী বন্ধু আমার ছিল

চাঁদ তারা বন্ধু আমার ছিল,

আর ঝরনা-পাহাড় বন্ধু আমার ছিল।

তারা কোথায় গেল, কোথায় হারিয়ে গেল।’

আমাদের জীবন থেকে প্রকৃতি হারিয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। হায়, এত বিচিত্র আর রঙিন প্রকৃতি আমাদের বেশিরভাগকে আর এখন টানে না! মাঝে মাঝে এদিক-ওদিক সামান্য একটু ঘোরাঘুরি করে প্রকৃতির কোলে কাটানো সময়টুকুকে তাই জীবনের একেকটা মূল্যবান খণ্ড বলেই আমার মনে হয়। 

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি।

ইমেইল: asadkhanbmj@yahoo.com 

এই লেখকের আরও লেখা

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash.bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!