চীনের সবুজ চায়ের গল্প

চীনের রাস্তাঘাট, অফিস-ব্যাংক, বিপণিবিতান, বিশ্ববিদ্যালয়- সবখানে মানুষের হাতে সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটা থাকে, তা হলো শক্ত প্লাস্টিক কিংবা কাচের এক বড় মুখের বোতল।

মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান খান, চীনের লুঝৌ থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Sept 2017, 04:39 AM
Updated : 27 Sept 2017, 04:39 AM

ভেতরে হালকা হলুদ-সবুজাভ পানীয়। কিছুক্ষণ পরপরই তারা এখানে চুমুক দেন। ধরা যাক, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুমে কোনো শিক্ষক ঢুকেছেন। তার এক হাতে ব্যাগ, আরেক হাতে ওই পানীয়। ব্যাগ রেখে কম্পিউটার খুলে ক্লাস শুরু করলেন।

পড়াতে পড়াতে প্রতি পাঁচ-দশ মিনিট পর পাশে রাখা পানীয়ের বোতলে চুমুক দিচ্ছেন। হালকা রঙের সে পানীয়ের নিচে সবসময়ই পাতা ধরনের কিছু একটা তলানীতে পড়ে থাকতে দেখা যায়। 

এগুলো সবুজ চা। দুনিয়াব্যাপী যার খ্যাতি। চীনে বিভিন্ন ধরনের সবুজ চা পাওয়া যায়। দেখতে বিভিন্ন ধরনের, আবার স্বাদেও ভিন্ন। কখনও পাতাকে বিশেষভাবে প্রক্রিয়াজাত করে কালো চা বানানো হয়।

পাতা ছাড়াও অনেক রকম ফুল চা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বায়োমেডিক্যাল সাইন্সের ছাত্র হিসেবে সবুজ চায়ের গুণাগুণ অজানা ছিলো না, কিন্তু এরকম ব্যাপক হারে গণমানুষের হাতে চা দেখে প্রথম প্রথম বেশ অবাক হতাম!

এইসব সবুজ চায়ের গুণাগুণ অল্প-বিস্তর সবারই জানা। বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত, নিয়মিত সবুজ চা পানে ক্যান্সার, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস ইত্যাদি প্রাণঘাতী রোগের ঝুঁকি কমায়।

পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মানুষের গড় আয়ু অনেক বেশি এবং বৃদ্ধাবস্থায়ও তারা অনেক সতেজ ও কর্মক্ষম থাকেন। এটার পেছনেও সবুজ চায়ের ভূমিকা আছে বলে অনেকে মনে করেন। 

চীনারা এই চা খুব ঘন করে পান করে না। বড় এক চায়ের বোতলের নিচে একটু চায়ের পাতা পড়ে থাকে, আর তার উপরে গরম পানি ঢালা হয়। পানি শেষ হয়ে গেলে কিংবা ঠাণ্ডা হয়ে গেলে আবার গরম পানি। এভাবেই সকাল থেকে সন্ধ্যা চলতে থাকে।

হালকা তিতকুটে স্বাদ, আর মৃদু ঘ্রাণ আছে এই চায়ের। বিভিন্ন ফুলের চায়ের ঘ্রাণ ওই ফুলের মতোই, স্বাদেরও হেরফের হয়। যারা অভ্যস্ত নন, তাদের ভালো লাগবে না। আমার অবশ্য মন্দ লাগে না। দিনে দুই-একবারে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি।

চীনাদের কাছে এই চা ঠিক কী, তা বোঝানো একটু দুষ্কর। একটা উদাহরণ দেই। আমার এক গবেষণা-গুরু কথায় কথায় বলেছিলেন, গত ২২ বছরে (এখনকার হিসেবে ২৭ হবে) কখনও শুধু পানি পান করেননি। কারণ দিন-রাত এই চায়ের পাতা ভেজানো পানি সঙ্গেই থাকে এদের। অধিকাংশ রেস্টুরেন্টেই খেতে গেলে তাদের বাইরে থেকে পানি কিনে নিয়ে যেতে হয়। কারণ রেস্টুরেন্টে অনেক সময়েই পানি থাকে না। হালকা চা শুরুতে দেওয়া হয়, আবার পরে যেকোনো সময়ে নেওয়া যায়। এছাড়া স্যুপ থাকে।  

চীন থেকে সবচেয়ে বেশি যেটা উপহার হিসেবে অন্যদেশে যায়, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি যায় ‘সবুজ চা’ আর ‘জিনসেং’ (প্রাচীনকাল থেকে ব্যবহৃত চীনা ঔষধ)। আমি চীন থেকে প্রথমবার যখন দেশে যাই, অতি সুদৃশ্য প্যাকেটে অনেকের জন্য উপহার হিসেবে নিয়ে গিয়েছিলাম এই চা। সেগুলোর মূল্যমান নেহায়েত কম ছিলো না। তবে মাত্র দুই-তিনজন পছন্দ করেছেন।

কেউ কেউ বিরক্ত হয়ে ফেলে রেখেছেন, কেউ কেউ আমাকে এই জিনিস টেনে নেওয়ার জন্য বকাঝকাও করেছেন। একজন বলছিলেন, “এইডা কী আনছোস? মনে হইতাছে মেন্দি পাতা ভিজাইয়া পানি খাইতাছি!” বুঝতে পেরেছিলাম, সব উপহার সবার জন্য না।  

সবুজ চায়ে অভ্যস্ত চীনাদের অনেককেই আমি বাসায় দাওয়াত করে দুধ-চা পান করিয়েছি। দুই-একজন শখ করে পছন্দ করেছে, কিন্তু বেশিরভাগই পছন্দ করেনি। আমাদের দেশে দুধ-চিনি ছাড়া অনেকে যেমন লাল-চা পছন্দ করেন, সেটা ওরাও পছন্দ করেছে। এটার স্বাদ অনেকটা এদের কালো-চাযের মতো। কিন্তু দুধ-চায়ে এদের সমস্যা হল দুধ আর চিনি! অথচ ও দুটো ছাড়া আমরা চায়ের কথা ভাবতেই পারি না। 

চায়ের কথা উঠলেই বাংলাদেশে চায়ের স্মৃতি মনে পড়ে। সকালে-সন্ধ্যায় নাস্তার পরে ঘরের সবাই মিলে চায়ের পাত্র নিয়ে বসা, গল্প করা খুবই নিয়মিত ব্যাপার ছিলো। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ছোট চায়ের দোকানে বসে বন্ধুদের সাথে এক কাপ চা নিয়ে আড্ডা দিয়ে কাটিয়ে দিয়েছি কত বেলা! বিশ্ববিদ্যালয়ের হল-জীবনে আমাদের বন্ধুদের রুমের আড্ডাগুলো কখনও চা ছাড়া কল্পনা করাই যেত না। আহারে!

কতদিন রাস্তার পাশের জীর্ণ টং দোকানে আধাময়লা সস্তা কাপে দুধ-চিনি মেশানো ঘন চায়ে চুমুক দিয়ে আড্ডা দেওয়া হয় না প্রিয় মানুষদের সাথে! কত সাধারণ, অথচ কি মধুর স্মৃতি! 

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি।

ইমেইলঃ  asadkhanbmj@yahoo.com

এই লেখকের আরও লেখা

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!