হাজিয়াংয়ের নাম না জানা পর্বতে বুনো অভিজ্ঞতা

সাপ্তাহিক ছুটির দুদিনের পরের দিন মে দিবস। টানা তিন দিন ছুটি পাওয়া আমাদের মত প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য কম আনন্দের ব্যাপার নয়। কিন্তু ছুটি কাটানোর উপায় তো বের করা দরকার।

মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান খান, চীনের লুঝৌ থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 May 2017, 11:22 AM
Updated : 2 May 2017, 01:47 PM

এক চীনা বন্ধুপ্রতিম পরিবারের আমন্ত্রণ পাওয়া গেল হাইকিং এবং ক্যাম্পিংয়ের। লুঝৌ শহরের পাশে হাজিয়াং কাউন্টির ফোবাও পার্বত্য এলাকা। আমন্ত্রণকারী বন্ধুদের পূর্বপুরুষের বাস এরকম কোনও এক পার্বত্য এলাকায়। তাদের দাদার এক বোন এখনো সেখানে থাকেন। উদ্দেশ্য সেখানে যাওয়া, উৎসবমুখর পরিবেশে দুইদিন থাকা, আর পাশের কোন এক পর্বতে আরোহন।

এপ্রিলের শেষ দিনে খুব ভোরে হাজিয়াং থেকে বন্ধুমহোদয় এসে হাজির। তার নাম স্যামুয়েল। আসল চীনা নাম কী, বলে নি। সে আমাদের পোস্টডক গবেষক সাবেরের বন্ধু। এটা আসলে তাদের পারিবারিক প্রোগ্রাম। আমরা তিনজন নিমন্ত্রিত। আমি, সাবের আর আরেক সহকর্মী মেই জিছিয়াং।

আমরা বলেছিলাম, ট্যাক্সি নিয়ে চলে যাবো, কিন্তু তিনি চলে এলেন আমাদের নিয়ে যেতে। হাজিয়াং লুঝৌ থেকে ঘণ্টা খানেকের পথ। ওখানে স্যামুয়েল আর তার স্ত্রী মিলে একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল চালায়। প্রথমে গেলাম স্কুলে। ছোটছোট বাচ্চাদের সাথে কিছুক্ষণ খেলে কাটালাম। বিদেশি কাউকে পাওয়া ওদের জন্য উৎসবের মত। দুপুরের খাওয়ার পরে আমরা ছুটলাম ফোবাও অভিমুখে।

ঘণ্টাখানেক পরে আমরা পৌঁছলাম প্রাচীন এক শহরে। প্রায় চার বছর আগে আমি এখানে একবার এসেছিলাম। এই শহর প্রাচীন যোগাযোগ ব্যবস্থার অন্যতম কেন্দ্র ছিল।

বলা হয়, চীনের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল থেকে পশ্চিম দিকে যাতায়তের সময়ে নৌ এবং পথযাত্রীরা এখানে বিশ্রাম নিতেন। প্রাচীন সেই নদীর ছাপ এখনো রয়েছে, শহর ঘেঁষে। খুব চওড়া না হলেও বেশ স্রোতস্বিনী। শহরের বাড়িঘরে সেই প্রাচীন কাঠামোই ধরে রাখা আছে। এ ব্যাপারটা বেশ লাগে। চীনের আনাচেকানাচে এরকম প্রচুর প্রাচীন শহর রয়েছে।

আধুনিকায়ন হলেও প্রাচীন অবকাঠামো ধরে রাখা হয় এখানে। কাঠের সব ঘরবাড়িতে টালির ছাদ। কী নেই এখানে! হোটেল, রেস্টুরেন্ট, বাজার, এমন কি সিচুয়ান অপেরার ছোট এক নাট্যশালাও দেখা গেল। গাইড বলল, এটাতে সংস্কারের হাত দেয়া হয়নি। একেবারেই প্রাচীন।

এখান থেকে বেড়িয়ে আমরা পার্বত্য পথে গভীরে যেতে লাগলাম। অবশ্য যাতায়াত ব্যবস্থায় সমস্যা নেই। আমরা যে বাড়ির সামনে থামলাম, সেখানেই গাড়ির রাস্তা শেষ। প্রায় শতবর্ষী দুই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা আমাদের আমাদের অভিবাদন জানালেন। পথের ক্লান্তি মেটালাম ঝর্ণার পানি দিয়ে। পাশের ঝর্ণার পানি পাইপ দিয়ে টেনে আনা হয়েছে। এটাই তাদের খাবার পানির উৎস।

বিকেল সন্ধ্যা গড়িয়ে গেল খাওয়াদাওয়া, আর গল্পগুজবে। সামনের পুকুর থেকে মাছ ধরা হল। কিশোরেরা বসে বারবিকিউ তৈরি করল।  এধরনের পরিবেশে আমি সাধারণত একা হয়ে যাই। সিমের বিচি সেদ্ধ, তো'ফু আর মাছ সেদ্ধ দিয়ে কোনও রকমে খাওয়া সারলাম। প্রায় সবাই যখন আঙ্গিনায় বারবিকিউয়ের মাংস আর পানীয় নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল, আমি এক কোনায় পুকুর ধারে চেয়ার পেতে বসে পড়লাম।

পশ্চিম আকাশে একফালি চাঁদ, ঠিক নিচে বিশাল পর্বতের কালো অবয়ব, মৃদু দখিনা বাতাস, নাম না জানা পাখিদের ডাক, আর সামনের পুকুর, ডোবা থেকে ভেসে আসা একটানা ব্যাঙের ডাক। বেশ অনেকক্ষণের জন্য ভুলে গেলাম পাশের কোলাহল। প্রকৃতির বিচিত্র এই শব্দের সমাহার আর পাহাড়ি রাতের সৌন্দর্য এক অপরূপ রূপে ধরা দিল।

সমস্যা বাঁধলো টয়লেট নিয়ে। তারা 'প্রাচীন' মানুষ। তাদের বাড়িঘর, জীবনাচার সবই প্রাচীন ধরনের। টয়লেটও সেই প্রাচীন ধরনের। ঘরের এক কোনায় তিন ফিট উচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা জায়গায় গর্ত খুঁড়ে বাশের ঢাকনা দিয়ে বানানো হয়েছে সে জিনিস। যেমন গন্ধ তেমন লজ্জাকর ব্যাপার;

এতো মানুষের সামনে সেখানে যাওয়া দুরূহ ব্যাপার। কোনওমতে চেপে গেলাম। ভাবলাম, ভোরের দিকে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে একটু দূরে গিয়ে পাহাড়ের ধারে প্রাকৃতিক পরিবেশে কোথাও প্রাকৃতিক কর্ম সম্পাদন করে আসবো।

বাড়ির আঙ্গিনায় আমরা তাবু গাড়লাম। আমার এর আগে তাবু গেড়ে 'ক্যাম্পিং' করা হয়নি। তাই তাবুও নেই, 'স্লিপিং ব্যাগ'ও নেই। এগিয়ে এলেন মেই সাহেব। বললেন, আমি জানি তোমার নেই, তাই  'স্লিপিং ব্যাগ'  আর বালিশ দুটো করে নিয়ে এসেছি। এক তাবুতে দুজন থাকা যাবে। রাতে খুব বৃষ্টি হল। তাবুর ভেতরে খুব সমস্যা হয়নি, তবে কাপড়চোপড়ের কিছু অংশ ভিজে গেছে।

সকালে আবার আবহাওয়া ঠিক। ফজরের নামাজের পরে অন্যদের তুললাম তাবু থেকে। সূর্যোদয়ের সামান্য পরে নুডলস দিয়ে নাস্তা সেরে আমরা বেড়িয়ে পড়লাম। পাহাড়ি পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে দেখছিলাম দুইধারের প্রকৃতি।

সিচুয়ানের দক্ষিণদিকের অন্য অনেক পাহাড় পর্বতের মত এ জায়গাও বাঁশে ঢাকা।দূরে নিচের দিকে দেখা গেল ধীরেধীরে মেঘগুলো মিলিয়ে যাচ্ছে সুর্যের আলো প্রকট হয়ে ওঠার সাথে সাথে। রাতের বৃষ্টি বেশ ঝামেলায় ফেলে দিয়েছে।

হাঁটাপথ বেশ কর্দমাক্ত হয়ে পড়েছে। এক সময়ে হাঁটাপথ শেষ হয়ে এলো। আমরা ঢালু বাশের জঙ্গল দিয়ে একটু নিচে নেমে গেলাম। চারজন স্থানীয় লোক এসেছেন আমাদের গাইড হয়ে। এছাড়া আমাদের দলে একজন বছর দশেকের কিশোর, বছর চারেকের শিশু, পাঁচজন মহিলাসহ তেরজন। ছোটছোট ঝোপঝাড় পরিষ্কার করে বাশ ধরে ধরে আমরা এগোতে থাকলাম।

মিনিট তিরিশেক পরে আমরা বেশ বড়সড় এক ঝর্ণার কাছে চলে এলাম। এটা নেমে গেছে ৭০-৮০ মিটার নিচে। বহুদুর থেকে এর শোঁ শোঁ শব্দ শোনা যাচ্ছিল। ঝর্ণা পেরিয়ে আমরা আবার সামনের দিকে ওপরে ওঠা শুরু করলাম। বেশ খানিকটা পথ পেরিয়ে বেশ বড়সড় একটা হ্রদের সন্ধান পাওয়া গেল।

আরও উঁচুতে কোন ঝর্না থেকে হয়ত এর সৃষ্টি। পথে যেতে যেতে দেখা যাচ্ছিল, বেশ খানিকটা দূরে (২-৩ মাইল পরে পরে) দুয়েকটা ঘর বাড়ি। পথে অনেকগুলো ছোটবড় ঝর্ণার দেখা মিলল। জঙ্গল, পাহাড়, কখনো পাখিদের ডাক, কখনো ঝর্নার শোঁশোঁ শব্দ, আবার কখনো একেবারে নিস্তব্ধতা- সব মিলিয়ে এক চমৎকার মনমুগ্ধকর পরিবেশ। 

প্রায় ঘণ্টা দুই পরে আমরা একেবারে চুড়ায় চলে এলাম। এখানে ইটের তৈরি প্রাচীন এক কাঠামো পাওয়া গেল। গাইড জানালেন। এটা গুইঝৌ থেকে সিচুয়ানের প্রবেশ পথ। এই পর্বতের একদিকে সিচুয়ান অন্যদিকে গুইঝৌ।

এবারে ফেরার পালা। এখানেই বিপত্তি শুরু। গাইড সাহেবরা পথ হারিয়ে ফেললেন। তিন তিনবার বেশ খানিকটা সামনে এগিয়ে আর এগোবার পথ বের করতে না পেরে ফিরে আসতে হল। ঘন জঙ্গল, পিচ্ছিল পাথুরে পথ, গরমে বারবার পানি পান করতে করতে বোতলের পানি প্রায় শেষ করে ফেলা- আমরা বেশ ঘাবড়ে গেলাম।

এদিকে মুঠোফোনের নেটওয়ার্ক নেই। জীবনে এই প্রথম একেবারে বুনো অভিজ্ঞতা। বারোটা বেজে গেছে। আমাদের পরিকল্পনা ছিলো সাড়ে এগারোটার মধ্যে ফিরে দুপুরের খাওয়াদাওয়া করব। ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ভয় সব মিলিয়ে আমাদের অবস্থা বেশ শোচনীয়। বেশ কয়বার খাড়া ঢাল বেয়ে আমাদের নামতে হয়েছে আবার উঠতে হয়ছে। কখনো কখনো মনে হয়েছে জীবন-মৃত্যুর মাঝে হয়ত একটু পা হড়কানোর তফাত। অজস্র বাঁশের সারি অবশ্য আমাদের চলতে সাহায্য করেছে। খুব ভয়ে ছিলাম, এই বুঝি কোনো সাপ কিংবা অন্য কোন পাহাড়ি জঙলি প্রাণী বা বিষাক্ত পোকা বেরিয়ে আসে। আল্লাহর রহমতে সেরকম কোন বিপদ হয়নি। ব্যাপারটা আমাদের বেশ অবাকই করল। জঙ্গলের মাঝে এক পানির প্রবাহ পেয়ে আমাদের আনন্দ কে দেখে!

দূর থেকে নেমে আসা কোনও এক ঝর্ণার ধারার শীতল পানি আমাদের তৃষ্ণা নিবারণ করল, আবার সেই সাথে সাহস আর শক্তিও যোগালো। একসময় দূরে এক গ্রাম দেখা গেল। গাইডদের একজন চিনতে পারলেন। এই গ্রামের চিহ্ন ধরে তারা আবার নতুন পথে কীভাবে এগোবেন সে ছক কষলেন।

আমরা আবার জঙ্গল, পানি পেরিয়ে, পাহাড় বেয়ে ওঠানামা করে এগোতে থাকলাম। এক সময়ে নিচের দিকে বেশ সুন্দর একটা হ্রদ দেখা গেল। এর পানি স্বচ্ছ কিন্তু সবুজাভ। ঘন্টাদেড়েক হেঁটে ঘুরে নেমে আমরা একসময়ে সেই হ্রদের পাড়ে এসে বিশ্রাম নিলাম।

আরো এক ঘণ্টা পরে পৌঁছলাম যেখানে আমাদের দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। খুব বিরক্ত হয়েছিলাম গাইডদের প্রতি। আমরা কেউই নিয়মিত পর্বতারোহী নই। কেনো আমাদের এমন পথ দিয়ে নিয়ে যাওয়া হল। ঝেড়ে দিলাম ২-১ টা বাংলা গালি। তারাও অত্যন্ত দুঃখিত হলেন আমাদের কষ্ট করানোর জন্য। এই পর্বত অনেকটাই বুনো। মানুষের যাওয়া আসা খুবই কম। তারাও নিয়মিত যায় না। তাই পথ ভুল হয়েছে।

যাইহোক দুপুরের খাওয়া বিকেলে শেষ করে আমরা আবার ফেরার পথ ধরলাম। সবাই প্রচণ্ড ক্লান্ত। দু-তিনজন বাদে প্রায় সবাই আহত। কারো কারো শরীরের বিভিন্ন জায়গা ছড়ে গেছে। প্রায় সবারই পোশাক-আশাকে আছাড় খেয়ে পরার চিহ্ন বর্তমান। হাজিয়াং হয়ে লুঝৌ ফিরে গোসল খাওয়াদাওয়া সেরে ভাবতে বসলাম।

কী ভয়ানক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলাম। কোনোভাবে কেউ যদি কায়দামত আহত হত, উদ্ধার করার কেউ ছিলোনা। ছিলোনা মোবাইল নেটওয়ার্ক। আল্লাহর অশেষ রহমতে বড় ধরনের সমস্যা ছাড়াই ফিরে আসতে পেরেছি।

এর আগে আমি আরো উঁচু পর্বতে গিয়েছি। তবে সেগুলো ছিল অনেকটাই 'লাক্সারি ট্যুর'। সেখানে গাড়ির রাস্তা আছে, কিংবা চমৎকার হাঁটাপথ, উপরে ওঠানামার জন্য সিঁড়ি, আছে 'কেবল কার'। কিন্তু একেবারে বুনো পাহাড়ে এরকম আদিম পরিবেশে অভিজ্ঞতা এই প্রথম। আমি নিশ্চিত, এই দুদিন এক রাতের বিচিত্র অভিজ্ঞতা বহুদিন মনে থাকবে। পাহাড়ি প্রাচীন মানুষজন, তাদের আতিথেয়তা, 'ক্যাম্পিং', বুনো পর্বতে 'হাইকিং'- কোন কিছুই ভোলার নয়।

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি।

ইমেইল: asadkhanbmj@yahoo.com

এই লেখকের আরও লেখা

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!