আমাদের প্রবাসী রমজান

বছর ঘুরে আবার আসছে মুসলমানদের পবিত্রতম মাস- রমজান। সমগ্র পৃথিবীতে ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা এই মাসের অপেক্ষায় থাকেন।

মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান খান, চীনের লুঝৌ থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 May 2017, 06:27 AM
Updated : 21 May 2017, 06:32 AM

রমজানে রোজার মূল বিষয়গুলো ঠিক রেখে বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে পালিত হয়। ইসলামিক দেশে কিংবা মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে রমজানের আবহ ভিন্ন ধর্মাবলম্বী সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষদের দেশ থেকে স্বাভাবিকভাবেই ভিন্ন। এ লেখাটা সম্পূর্ণই আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা, ভিনদেশ, ভিন্ন সংস্কৃতিতে কাটানো রমজানের কিছু কথা নিয়ে। 

১৮ মে সন্ধ্যায় বসে যখন এই লেখা লিখছিলাম, তার কিছুক্ষণ আগে ক্যালেন্ডারের পাতায় চোখ গেল। হিসেব করে দেখলাম রোজার আর মাত্র আট বা নয় দিন বাকি। দেশে থাকতে এমনি সময়েই রমজানের বাজার করার তোড়জোর শুরু হয়ে যায়। আব্বা নিশ্চয়ই তা শুরু করে দিয়েছেন।

ছেলেবেলায় আমরা যে বাড়িটায় থাকতাম, তার পাশে মসজিদে আযানের আগে মাইকে মাদ্রাসার ছাত্ররা রোযা শুরু হওয়ার ২-৩ দিন আগে থেকে গাওয়া শুরু করতো- 

“মাহে রমযান এলো বছর ঘুরে,

মো'মিন মুসলমানের ঘরে ঘরে।”

রমজানের চাঁদ দেখা, তারাবিহ’র নামায, সেহরির সময় ডাকাডাকি, পবিত্র উৎসবে ইফতার- আমাদের দেশে রমযান আসে সবাইকে জানান দিয়ে। কী পবিত্র ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ চারদিকে!

আর আমাদের চৈনিক জীবনে রমজান আসে নিভৃতে, ক্যালেন্ডারে, কিছু মানুষের চাঁদ দেখায়, আর অতি অল্প কিছু মানুষের চেতনায়। গত আট বছরে সাত রমজানই আমার চীনে কাটাতে হয়েছে।

জীবনে প্রথমবার যখন চীনে এলাম, তখন ছিল রমজান মাস। সফরে রোজা না রাখার অনুমোদন আছে জানতাম, কিন্তু সে অবস্থায় কোনোদিন পড়তে হয়নি বলে ভুলেই গিয়েছিলাম। প্লেনে দেখলাম, প্রায় সবাই খাচ্ছে। আমি ঠিক সাহস পেলাম না। রমজান মাসে খাবো! আমিতো তেমন অসুস্থ হয়ে পড়িনি।

আমাদের গন্তব্য ছিল ছাংশা শহর। কিন্তু বেইজিং-এ অবস্থান করতে হয়েছিল একদিন এক রাত। তারপর ট্রেনে ছাংশা। দেশ ছাড়ার পরে প্রায় ষাট ঘণ্টা পরে ছাংশা পৌঁছেছিলাম। এই দীর্ঘ সময়ে সেহরি ইফতারের কোনও ঠিক-ঠিকানা ছিল না। ফল আর পানি দিয়েই কাজ চালাতে হয়েছিল। যেদিন দুপুরে ছাংশায় পৌঁছে বিশ্ববিদ্যালয়ে রেজিস্ট্রেশন করলাম, সেই সময়ে আমার শরীরে সম্ভবত কিছুই আর অবশিষ্ট নেই প্রায়। এক ইয়েমেনি ভাই প্রায় জোর করে ধরে নিয়ে গেলেন খাবার দোকানে। বোঝালেন, একে তুমি লম্বা সফর করে এসেছো, তার উপর অসুস্থ হয়ে পড়েছো। এই মুহূর্তে তোমার রোজা রাখা নিষিদ্ধের পর্যায়ে পড়ে। 

পরদিন থেকে আমাদের আসল চীনা রোজা শুরু হল। সেপ্টেম্বরের গরমে ছাংশায় ১৬-১৭ ঘণ্টা রোজা। সেহরি আর ইফতার- দুই বেলাতেই ভাত, কিছু সবজি কিংবা মাছ চলে। হালাল মাংসের দোকান তখনও চিনে উঠতে পারিনি। সপ্তাহখানেক পরে অবশ্য অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। ইফতারে নানা রকমের ফল যোগ হল, কিন্তু দেশে ফেলে আসা রমজানের ছোলা-মুড়ি, পেঁয়াজু, বেগুনী, আলুর চপের অভাব খুব অনুভব করলাম। ধীরে ধীরে তারও কিছু কিছু বাসায় বানানো শুরু হল। 

আমাদের ছাংশা জীবনে রোজার অন্যতম আনন্দ ছিল, প্রতি সপ্তাহে কোন এক বাংলাদেশি পরিবারের বাসায় সব বাংলাদেশি মিলে ইফতার করা। বাহারী ফল, হালাল পানীয়, কিছু দেশি স্বাদের মসলাদার খাবার, আর সবচেয়ে বেশি ভালো লাগা ছিল একসাথে বসে দোয়া করা, খাওয়া, আর বাংলায় আড্ডা দেওয়া।

এছাড়া আমরা সারা সপ্তাহ ব্যস্ত থাকতাম ক্লাস বা ল্যাবের কাজে। কখনও এমন হতো, ইফতারের সময়ে বোতলে এক চুমুক পানি পান করে ল্যাবের কোণায় নামায সেরে আবার কাজ শুরু। বাসায় এসে খেতে রাত প্রায় ১০টা-১১টা। এও এক রকমের আনন্দ। আল্লাহ্‌র কাছে রোজার পরীক্ষা দিচ্ছি- এই ভেবেই ভালো লাগত। কোনরকম কষ্ট হত না। শুধু ইফতারের সময়ে দেশে ফেলে আসা পরিবারের প্রিয়জনদের মুখ, সেহরির সময়ে মসজিদ থেকে ভেসে আসা ‘সেহরির সময় হয়েছে, উঠুন’ ডাক ইত্যাদির জন্য মন কেমন করতো। 

আমার চীনা অধ্যাপকদের কাছ থেকে কেমন আচরণ পেয়েছি রমজানে, সে কথা একটু বলব। চীনে আসার পরে দ্বিতীয় রমজান। অধ্যাপক চেন সাহেবের ল্যাবে পুরোদমে তখন কাজ শুরু করে দিয়েছি। প্রথম রোজার দিনে ল্যাবে বেশ কিছু কাজ ছিল। উনি দেখলেন, আমি ঘেমে গেছি। 

তার ফ্রিজ থেকে ঠাণ্ডা এক বোতল পানি দিলেন খাওয়ার জন্য।

 আমি বললাম, “এটা আমাদের 'ফাস্টিং মান্থ', কিছু খাওয়া বা পান করা যাবে না।” পানিও খাওয়া যাবে না শুনে উনি অবাক হলেন! রোজার বিষয়েও জানতে চাইলেন। আমি তাকে রোজার গুরুত্ব এবং নিয়ম সম্পর্কে দুই মিনিট বললাম। তিনি চমৎকৃত হলেন। আমাকে বললেন, “আগামী এক মাস তোমার ল্যাবে আসার দরকার নেই, রমজানে বিশ্রাম নাও!”

না, আমি একদিনের জন্যও বিশ্রাম নেইনি। কিন্তু অমুসলিম একজন অধ্যাপকের কাছ থেকে ধর্মীয় ব্যাপারে এইরকম সহযোগিতা আমাকে মুগ্ধ করেছিল। তার ল্যাবে চার বছর ছিলাম। রোজায় বা নামাজের সময়ে কোনদিন সমস্যা হয়নি। ল্যাবের অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রীরাও জানত। তারাও সবসময় সহযোগিতা করেছে।

পরবর্তীতে লুঝৌ শহরে গিয়েছি অধ্যাপক ফু সাহেবের ল্যাবে। দুটো রোজা কাটিয়েছি সেখানে। (মাঝখানে এক বছর বিরতি দিয়ে তৃতীয় রমজান এবার এখানে)। দুই বারই রোজার ঠিক আগে আমাদের নিয়ে একটা বেশ বড়সড় খাওয়া-দাওয়ার পার্টি দিতেন ফু সাহেব, আমরা রোজায় দিনের বেলা খেতে পারব না বলে।  

ছাংশা থেকে লুঝৌ শহরে আসার পরে আমাদের রমজান অন্যরকম হয়ে গেলো। ওখানে তবু বেশ কিছু মুসলিম ছাত্র-ছাত্রী ছিল আমাদের ডরমিটরিতে। সেহরির সময় রান্নাঘরে কিংবা ইফতারের সময় রুমে রুমে দেখা হয়ে যেত। কিন্তু লুঝৌতে আমরা সম্পূর্ণই একা। আশেপাশের ফ্লাটে সবাই চীনা।

 বেশ খানিকটা দূরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে কিছু বাংলাদেশি আর পাকিস্তানি মুসলিম ছাত্র ছিল। তাদের সাথে দুই-তিন বার অবশ্য একসাথে ইফতার করা হয়েছে। তবুও বলা যায়, আমাদের রমজান ছিল সম্পূর্ণই একাকীত্বপূর্ণ। এরকম পরিবেশে রোজা যে শুধু আল্লাহ্‌কে সন্তুষ্ট করার জন্য- এটার অনেক বেশি উপলব্ধি হয়।

তারপরও মসজিদ থেকে ভেসে আসা আযানের সুর, সেহরির ডাক, জামাতে তারাবিহ, বাবা-মা-বোনদের সাথে রকমারী ইফতার- সবকিছু মিলে প্রিয় দেশে প্রিয় মানুষজনের জন্য মন কেমন করে ওঠে মাঝে মধ্যে!

পবিত্র শা'বান এবং রমজানে মহান আল্লাহ্‌পাকের কাছে প্রার্থনা, ভালো থাকুক আমাদের দেশ, আমাদের মানুষজন, তথা সমগ্র পৃথিবীর ভালো মানুষেরা। 

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি।

ইমেইল: asadkhanbmj@yahoo.com

এই লেখকের আরও লেখা

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!