ভারতের আসাম থেকে বানের পানিতে ভেসে আসা বুনো হাতিটি থামানো গিয়েছিল বহু চেষ্টার পর, নাম দেওয়া হয়েছিল বঙ্গবাহাদুর; কিন্তু লোকালয় থেকে সরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যেই মারা গেছে প্রাণীটি।
Published : 16 Aug 2016, 08:59 AM
হাতি উদ্ধারকারী দলের সদস্য ঢাকার বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিদর্শক অসীম মল্লিক জানান, মঙ্গলবার সকাল ৭টায় সরিষাবাড়ি উপজেলার কয়রা গ্রামের বাদা বিলে বঙ্গবাহাদুর মারা যায়।
এক মাসের বেশি সময় ধরে পিছু পিছু ঘোরার পর গত ১১ অগাস্ট ট্রাঙ্কুলাইজার দিয়ে অচেতন করে ডাঙ্গায় তোলা হয় হাতিটিকে। পায়ে শিকল ও রশি দিয়ে একটি আমগাছের সঙ্গে বেঁধে রেখে শুরু হয় সরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া।
পরিকল্পনা ছিল, সাফারি পার্কে ছেড়ে দেওয়া হবে তাকে। কিন্তু কীভাবে তা করা হবে, তা নিয়ে চিন্তায় ছিলেন বন বিভাগের কর্মকর্তারা।
এরই মধ্যে রোববার সকালে হাতিটি পায়ের শেকল ছিঁড়ে ছুট দিলে আবারও ট্রাঙ্কুলাইজার দিয়ে অচেতন করা হয়। কয়েক ঘণ্টা পর হুঁশ ফিরলেও অবস্থা খারাপের দিকে যেতে থাকে।
সোমবার কড়া রোদের মধ্যে অসুস্থ বঙ্গবাহাদুর বাইদ্যা বিলের কাদাপানিতে পড়ে যায়। সন্ধ্যা পর্যন্ত ১২টি স্যালাইন দেওয়া হয়, হাতিটি সুস্থ করে তুলতে চলে চিকিৎসা, সেবা। শ্যালো ইঞ্জিন দিয়ে হাতির গায়ে পানি ছিটানোরও ব্যবস্থা হয়।
উদ্ধারকারী দলের সহকারী পশু চিকিৎসক মোস্তাফিজুর রহমান সোমবারও বলেছিলেন, অসুস্থ হয়ে পড়লেও তারা বঙ্গবাহাদুরে জীবনশঙ্কা করছেন না। দেড়মাসের বেশি সময় ধরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রায় এক হাজার আটশ কিলোমিটার পথ হাতিটি অতিক্রম করেছে। পর্যাপ্ত খাবার, ঘুম ও সঙ্গীহীন হয়ে পড়ায় হাতিটির দুর্বল হয়ে পড়া স্বাভাবিক।
যত্ন চললেও উদ্ধারকারী দলের বড় দুশ্চিন্তা ছিল বুনো হাতিটিকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া। পাঁচ টন ওজনের এই পুরুষ হাতিকে সরিয়ে নিতে ট্রাক ও ক্রেন ব্যবহারের কথা ভাবা হলেও কয়রা গ্রামের এক কিলোমিটারের মধ্যে রাস্তা না থাকায় তা সম্ভব ছিল না।
বঙ্গবাহাদুরকে হাঁটিয়ে সড়ক পর্যন্ত নিতে তাকে বশ মানানোর জন্যে আনা হায় মাহুত। সেই কৌশল কাজে লাগাতে গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক থেকে একটি ও চট্টগ্রাম থেকে ব্যক্তি মালিকানাধীন তিনটি হাতি আনার উদ্যোগ নেওয়ার কথাও জানিয়েছিলেন উদ্ধারকারী দলের প্রধান তপন কুমার দে।
তবে তাদের সব উদ্যোগ ব্যর্থ করে দিয়ে মঙ্গলবার সকালে মারা যায় হাতিটি।
ধরা পড়ার পর এই পাঁচদিন হাতিটিকে সুস্থ করে তুলতে উদ্ধারকারীদের সব ধরনের সহযোগিতা দিয়ে গেছে কয়রা গ্রামের মানুষ। বঙ্গবাহাদুরের এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না তারা।
কয়রা গ্রামের কৃষক মো. আলমগীর হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সোমবার বেলা ১১টা থেকে বেহুঁশ হয়ে এক ফুট পানির মধ্যে পড়ে ছিল হাতিটা। পানির মধ্যেও তার গা পুড়ে যাচ্ছিল। সন্ধ্যায় টেনেহিঁচড়ে তুলে কাদার মধ্যে ফেলে রাখা হল। বেহুঁশ অবস্থাতেই মারা গেল অত বড় প্রাণীটা।”
একই গ্রামের গৃহিণী ছাহেরা বেগমের অভিযোগ, হাতিটিকে ঠিকমতো খাবার দেওয়া হয়নি।
“কয়েকটা করে আখ দেওয়া হত। দুই-একটা কলাগাছ। এই খেয়ে কি অত বড় হাতির জান বাঁচে? বন বিভাগের লোকজনের অবহেলায় হাতিটা মরে গেল।”
হাজি মো. বরকত উল্লাহ নামে গ্রামের এক কৃষক বলেন, তার দুই বিঘা জমির ফসল হাতির কারণে নষ্ট হয়েছে, কিন্তু তাতে তার দুঃখ নেই। সরকারি লোকজন এসেও হাতিটাকে বাঁচাতে পারল না- এটা তিনি মানতে পারছেন না।
“গাফিলতির কারণেই হাতিটা মারা গেছে। মৃত্যুর কারণ নির্ণয় করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।”
উদ্ধারকারী দলের সদস্যন অসীম মল্লিক বলেন, “ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আসছেন। তারা আসার পর পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”
বানের জলে ভেসে গত ২৬ জুন ভারতের আসাম হয়ে বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম সীমান্তে আসার পর বার বার স্থান বদলে নিয়মিত সংবাদের শিরোনামে এসেছে এই বুনো হাতি।
কুড়িগ্রামের রৌমারীতে হাতিটি ছিল ৯ জুলাই পর্যন্ত। ১০ থেকে ১৩ জুলাই গাইবান্ধায়, ১৪-১৬ জুলাই জামালপুরে, ১৭-১৮ জুলাই বগুড়ায়, ১৯-৩০ জুলাই সিরাজগঞ্জে এবং তারপর ৩১ জুলাই থেকে আবার জামালপুরে চষে বেড়ায় সে। এই পুরো সময় হাতির পেছনে ছিল উৎসুক জনতার ভিড়।
দেড় মাসের বেশি সময় ধরে নদী ও স্থলপথ মিলিয়ে চার জেলার দেড় হাজারের বেশি কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়ে হাতিটি। ৩ অগাস্ট ভারতীয় একটি দল এসে উদ্ধার কাজে হাত লাগালেও ব্যর্থ হয়ে ভারতে ফিরে যায় তারা।
খাবারের প্রলোভনে সাড়া না দেওয়ায় বুনো হাতিটিকে বশে আনতে পোষা একটি মাদী হাতিও আনা হয়েছিল। কিন্তু উল্টো পোষা হাতিটিকে তাড়িয়ে দেয় বঙ্গবাহাদুর।
১১ অগাস্ট প্রথমে ‘প্লাস্টিক ডার্ট’ ছুড়লে তা হাতির গায়ে লেগে বেঁকে যায়। এরপর সরিষাবাড়ীর কয়রা গ্রামে ‘মেটাল ডার্ট’ ছুড়ে হাতিটি অচেতন করা হয়।
বঙ্গবাহাদুরের দীর্ঘ সফর