স্থানীয়দের ধারণা, যেহেতু দুটি ক্যাম্প থেকেই বিজিপি সরে গেছে ফলে সেখানে এখন নিয়ন্ত্রণে রয়েছে আরাকান আর্মি।
Published : 08 Feb 2024, 11:44 PM
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দেশটির সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহীদের টানা যুদ্ধের পর ‘আপাত শান্ত’ হয়ে এসেছে বান্দরবানের ঘুমধুম সীমান্ত। কিন্তু লোকজনের মধ্যে এক ‘অজানা চাপা আতঙ্ক’ বিরাজ করতে দেখা গেছে। তাদের আশঙ্কা, সীমান্তের ওপারে আবারও বিমান হামলার মধ্য দিয়ে যুদ্ধ শুরু হবে।
বৃহস্পতিবার দিনভর ঘুমধুম, তুমব্রু, পালংখালী, রহমতের বিল এলাকা ঘুরে মানুষের সঙ্গে কথা বললে তারা এই আতঙ্কের কথা জানান।
এর ছাপও রয়েছে সীমান্ত এলাকায়। রাস্তাঘাটে লোকজনের চলাচল বেড়েছে, দোকানপাটও খোলা রয়েছে। কিন্তু যারা নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে কাছে-দূরের আত্মীয়-স্বজনের বাসাবাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন, ‘শান্ত’ পরিস্থিতিতে তারা ফিরতে ভয় পাচ্ছেন বলে জানা গেছে।
যদিও, বাড়ির গবাদি-পশু ও মালসামানা দেখভাল করার জন্য কেউ কেউ ঘরে ফিরছেন। তবে সেই সংখ্যা খু্ব বেশি না।
এদিকে বৃহস্পতিবার আর নতুন করে মিয়ানমার থেকে যুদ্ধ ছেড়ে কেউ পালিয়ে আসেনি। বরং তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পালিয়ে আসা যেসব বিজিপি সদস্যদের রাখা হয়েছিল তাদের টেকনাফের হ্নীলা উপকূল এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
পরে বিকালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, দুই দেশের আলোচনার প্রেক্ষাপটে তাদেরকে কক্সবাজার থেকে গভীর সমুদ্রপথে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।
রাখাইন রাজ্যে দেশটির সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে যুদ্ধে টিকতে না পেরে গত রোববার থেকে বুধবার রাত পর্যন্ত মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর ৩৩০ জন বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে।
বৃহস্পতিবার দিনের বেলায় অনুপ্রবেশ ও গোলাগুলির তথ্য না থাকলেও রাত ৯টার দিকে তুমব্রু সীমান্তের লোকজন জানান, তারা সীমান্তের ওপারে গোলাগুলি শুনেছেন। রাত সাড়ে ৮টার দিকে টেকনাফের হ্নীলা সীমান্তের ওপারেও গোলাগুলির শব্দ শোনা গেছে।
বিকালে ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ের পাশের বাসিন্দা মো. আরিফের সঙ্গে কথা হয়। তার পরিবারে সদস্য সংখ্যা আটজন। তার ঘরের কয়েক গজ দূরে মিয়ানমার সীমান্ত রক্ষা বাহিনীর একটা ক্যাম্প।
আরিফের ভাষ্য, কয়েকদিন আগে সেটি দখল করে নিয়েছে সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি (এএ)। ক্যাম্পটি দখলে নিতে যখন যুদ্ধ চলছিল তখন মুহুর্মুহু গুলি এসে পড়ে ঘরের চালে। লোকজন বাইরে সরে যাওয়ায় কারও ক্ষতি হয়নি।
৩০ বছর বয়সী আরিফের আশঙ্কা, “মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ক্যাম্পটি পুনরায় দখলে নিতে বিদ্রোহী গোষ্ঠীর ওপর বিমান হামলা করে বসে কি-না। তাহলে এর প্রভাব আমাদের ওপরও পড়বে।
“এখনও অনেকে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতেই আছেন। কেউ কেউ ফিরেছেন। বেশিরভাগ মানুষ ফিরেনি। সবার মধ্যে নতুন করে ভয় হচ্ছে। যারা ফিরে আসছে সবারই ঘরে গবাদিপশু, ক্ষেত-খামার রয়েছে। এই চিন্তা থেকে বাধ্য হয়ে কেউ কেউ ঝুঁকি নিয়ে হলেও ফিরছে”, বলেন আরিফ।
এই পরিবারের এক নারী সদস্য বলেন, “আতঙ্কের কারণে আমরা নিরাপদ জায়গায় চলে গিয়েছিলাম। ঘর ফেলে এভাবে কয়দিন থাকব। যত আত্মীয়-স্বজন হোক। এখন এলাকার সবাই বলতেছে, দখল হওয়া ক্যাম্পগুলোতে সরকারি বাহিনী আবার হামলা করে কি-না। তখন আবার কোথাও না কোথাও পালাতে হবে। আমরা তো একেবারে সীমান্তের কয়েক গজের মধ্যেই আছি।”
বুধবারও ঘুমধুম বাজারে এক যুবক আলোচনার সময় দাবি করেছিলেন, “সীমান্তের ওপারে মিয়ানমার সীমান্ত রক্ষা বাহিনী বিজিপির রাইট ক্যাম্প এবং লেফট ক্যাম্প দখল করে নিয়েছে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি।”
বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের খবরেও রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর যে কয়টি ক্যাম্প হাতছাড়া হওয়ার তথ্য জানানো হয়েছে; তার মধ্যে এ দুটি রয়েছে।
স্থানীয়দের ধারণা, যেহেতু দুটি ক্যাম্প থেকেই বিজিপি সরে গেছে ফলে সেখানে এখন নিয়ন্ত্রণে রয়েছে আরাকান আর্মি।
ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের এক সদস্য বলছিলেন, “আমার মনে হয়, বিজিপি সদস্যরা এখানে যারা পালিয়ে আসছে মূলত তাদেরকে সেনাবাহিনী কৌশলে সরিয়ে দিচ্ছে। তাদের সৈন্যরা কেউ না থাকলে তারা নিশ্চিত হয়ে বিমান হামলা চালাতে পারবে।
“কারণ, এপারে আমাদের সীমান্ত এলাকায় স্থলপথ হয়ে গেছে। কিন্তু সীমান্তের ওপারে চারদিকে এখনও জঙ্গল। স্থলপথ খুব কম। রাস্তা থাকলেও এলাকায় এলাকায় আরাকান আর্মি দখল করে নিয়েছে।”
ইউপি সদস্যের ভাষ্য, “ক্যাম্প পুনর্দখল কিংবা আরাকান আর্মির ওপর আক্রমণ করার জন্য স্থলপথে এখানে আসার সুযোগ নেই মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর। একমাত্র বিমান হামলা চালাতে পারবে তারা।
“সেই কারণে বিমান হামলার আতঙ্ক পেয়ে বসছে সবার মধ্যে। মিয়ানমারের সরকারি বাহিনী হয়ত চুপচাপ থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। তাদের কত কৌশল থাকতে পারে। এত সহজে ছাড় দেবে বলে মনে হয় না।”
একই আতঙ্কের কথা জানান টেকনাফ উপজেলার উত্তর হোয়াইক্যং এলাকার বাসিন্দা মো. শাহাজাহান। তিনি বলেন, “আমাদের সীমান্তের এপারে বেড়িবাঁধ আছে। চারপাশে অনেক ঘনবসতি, ঘরবাড়ি। সবার ভয় বিমান হামলা নিয়ে। এটা নিয়ে সবাই বলাবলি করতেছে।”
তিনি বলেন, “ওপারেও সব ক্যাম্প আরাকান আর্মি দখল করে নিয়েছে। যতই হোক, তারাও একটা সরকারি বাহিনী। কোন সময় প্রতিশোধ নিয়ে বসে! যদিও বিমান হামলা হলে ওইদিকে হবে। কিন্তু এপারে এসেও লাগবে। তখন কী পরিস্থিতি তৈরি হয় কেউ ধারণা করতে পারবে না।”
৫৮ বছর বয়সী রশিদ আহম্মদ নামে একজন বাসিন্দা বলেন, “৩০ বছর ধরে নাফ নদীতে মাছ ধরে বিক্রি করি। এরকম ঝামেলা কোনোদিন হয়নি। হলেও এত বড় আকারে হয়নি। ছোটখাট ঝামেলা হলেও কয়েক দিন পর পরিস্থিতি শান্ত হয়।
“এখন দেখি পরিস্থিতি অন্যরকম। সীমান্তের ওপারে কত দল, বাহিনীর কথা শুনি। সীমান্তে বিমান হামলার ভয়ের কথা সবাই বলাবলি করে।”
টানা কয়েক দিন ধরে গোলাগুলির পর পরিস্থিতি এখন শান্ত রয়েছে, মানুষ ঘর ছেড়ে বের হওয়া শুরু করেছে বলে জানান ঘুমধুম এলাকার বাসিন্দা শহীদুল ইসলাম।
তিনি বলেন, “এখন সবার নতুন করে ভয় হচ্ছে, দখল হওয়া ক্যাম্পগুলো পুনর্দখল করার জন্য মিয়ানমার আবার কখন কী করে বসে।”
ঘুমধুমের বেতবুনিয়া বাজার এলাকার বাসিন্দা মো. ইউনুছ বলেন, “আগে তুমব্রুর দিকে গণ্ডগোল ছিল। ঘুমধুমের বাসিন্দারা একটু নিরাপদে থাকবে মনে করা হয়েছিল। পরে দেখি এখানেও একই অবস্থা। এখন সবার মধ্যে নতুন করে চাপা আতঙ্ক ক্যাম্পগুলোতে কোনো বিমান হামলা হয় কি-না।”
আরও পড়ুন: