গত কয়েকদিনের তুলনায় বুধবার সীমান্তের ওপারে গুলির শব্দ কম শোনা গেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। অনেকেই বাড়ি ফিরেছেন। বিজিবির পাহারায় ধানক্ষেতে সার, পানি ও কীটনাশক দিতে দেখা গেছে গ্রামের কৃষকদের।
Published : 08 Feb 2024, 12:24 AM
উখিয়ার বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত রেখা ধরে অনেকটা দণ্ডাকৃতির একটি গ্রাম, নাম রহমতের বিল। মিয়ানমারে চলা যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে কয়েকদিন ধরেই আলোচনায় বাংলাদেশের এই গ্রাম।
সীমান্তের ওপারে গোলাগুলির কারণে এই গ্রামের অনেকে ঘর ছেড়েছিলেন। কিন্তু ক্ষেতের ফসল আর গরু-ছাগল রেখে কৃষক পরিবার আর কয়দিনই বা ঘরের বাইরে থাকতে পারে। জীবনের ঝুঁক থাকলেও আবার তারা ফিরে এসেছেন। এ যেন অন্যরকম এক যুদ্ধ’ তাদের জন্য।
বুধবার গ্রামের একটি মাটির বাড়ির টিনের দরজা খোলা দেখে উঠানে গিয়ে ডাক দিতেই বেরিয়ে আসেন পারভীন আক্তার। দরজায় তখনও বস্তাটা রাখা, কেবলই ফিরেছেন থাইংখালির ভাইয়ের বাড়ি থেকে। জানালেন, গোলাগুলির মধ্যেও বাড়িতে ছিলেন। তবে মঙ্গলবার ঘরের ভেতরে গুলি ঢোকার পর আর সাহস হয়নি। চার মাসের মেয়েকে বুকে আর দুই ছেলে-মেয়ের হাত ধরে ঘর ছেড়ে ভাইয়ের বাড়িতে গিয়ে উঠেছিলেন।
মিয়ানমারের রাখাইনে দেশটির সেনা ও বিদ্রোহীদের যুদ্ধের মধ্যে সীমান্তের এপারে আতঙ্কজনক পরিস্থিতি চলছে কয়েকদিন ধরে। সীমান্ত লাগোয়া গ্রামের বাসিন্দারা জীবন বাঁচাতে বাড়িঘর ছেড়ে আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি এবং সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে উঠছেন।
কয়েকদিনের যুদ্ধের মধ্যে সাহস করেও যারা ভিটেমাটি আগলে পড়ে ছিলেন, মঙ্গলবার তারাও বাড়ি ছেড়ে যাওয়ায় গ্রামের পর গ্রাম বিরান হতে শুরু করে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাষ্য, দিনের বেলায় গোলাগুলির আওয়াজ শোনা গেলেও ঘুমধুম সীমান্ত মঙ্গলবার তুলনামূলকভাবে শান্ত ছিল। অন্যদিকে পালংখালীর রহমতের বিল এলাকার পরিস্থিতি ছিল উত্তপ্ত। পরে রাতে ঘুমধুম সীমান্তের ওপারেও বড় ধরনের গোলাগুলির আওয়াজ শোনা যায়।
তবে গত কয়েকদিনের তুলনায় বুধবার সীমান্তের ওপারে গুলির শব্দ কম শোনা গেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। ফলে অনেকেই বাড়িঘরে ফিরেছেন। বিজিবির পাহারায় ধানক্ষেতে সার, পানি ও কীটনাশক দিতে দেখা গেছে গ্রামের কৃষকদের। বাড়িতে পড়া গুলি এখন শিশুদের খেলার সামগ্রী হয়ে উঠেছে।
রহমতের বিল গ্রামে পারভীনের পাশের বাড়িটি আয়েশা বেগমের। পুত্রবধূ রুখসানাকে নিয়ে টিলাসমান উঁচু বাড়ির উঠানে বসে ছিলেন ষাটোর্ধ্ব আয়েশা। তারাও বুধবার ঘরে ফিরেছেন।
দাদি আয়েশার কথায় একটি ‘গুলির দানা’ এনে দেখায় তার ১১ বছর বয়সী নাতনি। শিশুটি আর কারও হাতে গুলি দিতে চায় না, ওটা সে কিছুতেই হাতছাড়া করবে না। তাই তার হাতে রেখেই ছবি তোলা হল।
শিশুটির মা রুখসানা বললেন, গোলাগুলি শুরুর পর তারা ঘরেই ছিলেন। দুদিন আগে ঘরে গুলি এসে পড়ায় চার মেয়েকে নিয়ে আর থাকার সাহস হয়নি। শিশুরা এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করে বেড়ায়, কোথায় কী অঘটন ঘটবে সেই চিন্তায় রুখসানা তাদের নিয়ে বালুখালীতে আত্মীয় বাড়িতে গিয়েছিলেন। বুধবার গোলাগুলি কমায় তারা ঘরে এসে উঠেছেন।
তবে বললেন, ‘বস্তা রেডি আছে’, অর্থাৎ তার ও শিশুদের জিনিসপত্রসহ বস্তা গুছিয়ে রেখেছেন, আবার গোলাগুলি শুরু হলেই ঘর ছাড়বেন।
সবাই বাড়ি ছাড়লেই কোথাও যাননি বয়োজ্যেষ্ঠ আয়েশা বেগম।
তার বাড়ির সামনের রাস্তা ধরে বালতি ভরা সার নিয়ে ক্ষেতের দিকে যাচ্ছিলেন কামালউদ্দীন মিয়াজী।
সাংবাদিক পরিচয় দিতেই বললেন, তিনি রহমতের বিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জমিদাতা ও পর্ষদের সভাপতি। মঙ্গলবার ওই বিদ্যালয় কাম আশ্রয়কেন্দ্রে মিয়ানমার থেকে আসা ১১৮ জন্য বিজিপি সদস্যকে রাখা হয়েছিল। পরে তাদের সরিয়ে নেওয়া হয়।
কামালউদ্দীন বলেন, “গেল বার (২০১৭ সালে) যখন রোহিঙ্গারা স্রোতের মতো ঢুকেছিল সেবছর আর ক্ষেত-খামার করা হয়নি। এ বছরতো একেবারে ‘যুদ্ধে’র মধ্যে পড়ে গেছি। গোলাগুলির মধ্যেও বাড়িতেই ছিলাম, পরিবারের সদস্যদের আত্মীয়বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি।”
দুই দিন ক্ষেতে না গেলেও বুধবার গোলাগুলি একটু কমায় আর বিজিবি সদস্যরা গ্রামের রাস্তায় অবস্থান নেওয়ায় জমিতে সার দিতে যাচ্ছেন বলে জানান কামালউদ্দীন।
সন্ধ্যার আগে আগে রহমতের বিল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে নিজের ধানক্ষেত পরিষ্কার করছিলেন আখতার কামাল।
তিনি বললেন, ইতোমধ্যে জমিতে কিছু টাকা বিনিয়োগ করেছেন, ক্ষেত ঠিকমত দেখাশোনা না করলে চাষে ক্ষতি হয়ে যাবে। তাই গ্রাম ছাড়তে পারেননি।
এই আলাপের মধ্যেই বিজিবির এক সদস্য এসে সন্ধ্যার আগে ঘরে চলে যেতে বললেন আখতারকে। একই সময় ক্ষেতের পাশ থেকে ছাগলের জন্য ঘাস সংগ্রহ করছিলেন আসমা আক্তার। তাকেও টহল থাকতে থাকতে কাজ সারার তাড়া দেন বিজিবি সদস্য।
সরকারের পক্ষ থেকে গোলাগুলির মধ্যে লোকজনকে আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়ার কথা বলা হলেও বুধবার রহমতের বিল প্রাথমিক বিদ্যালয় কাম আশ্রয়কেন্দ্রটি তালাবন্ধ দেখা যায়।
এর আগে দুপুরের পর উখিয়া থেকে রহমতের বিলে যাওয়ার ইট বিছানো রাস্তায় দেখা হয় কয়েকজন বিজিবি সদস্যের সঙ্গে। রাস্তাটি মিয়ানমার সীমান্ত সড়কের অনেকটা সমান্তরাল। এখান থেকে সীমান্ত সড়কটি কিলোমিটার খানেক দূরে। সীমান্ত সড়কের পাশে বিজিবির ওয়াচ টাওয়ার।
বিজিবি সদস্যরা বলছেন, তারাও সঙ্গত কারণে নিরাপদ দূরত্বে থেকে টহল দিচ্ছেন। পোশাকধারী বিজিবি সদস্যদের সঙ্গে সাদা পোশাকের কয়েকজনকেও দেখা গেল। সবার সঙ্গে মোটর সাইকেল রয়েছে। একটি মোটর সাইকেল যাচ্ছে তো আরেকটি আসছে।
তারা কারা?
কিছুদূর এগোতেই রাস্তার পাশে মিয়ানমারের সীমান্তের দিকে তাকিয়ে বসে থাকতে দেখা গেল জনা দশেক আবালবৃদ্ধবনিতাকে। ওই গ্রামের নাম দামানখালি।
কথা হল এখানকার কৃষক আব্দুর রহমানের সঙ্গে। হাতে তার বাঁশের কঞ্চি আর দা; যাচ্ছিলেন ক্ষেতের বেড়া দিতে। লোকজন দেখে এখানে দাঁড়িয়েছেন।
সংঘাতময় পরিস্থিতির মধ্যে এখানে কী করছেন জানতে চাইলে, ভিড়ের মধ্য থেকে এক নারী জানালেন, তারা থাইংখালির বাসিন্দা, পরিস্থিতি দেখতে এসেছেন।
তবে অটোচালক ইসমাইল বললেন, এদের অনেকেই দালাল। রোহিঙ্গারা কেউ ছুটে এপারে আসতে চাইলে তারা তাদের পৃষ্ঠপোষকতা দেয়। বিনিময়ে জনপ্রতি তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা পায়। রোহিঙ্গা ধরতেই তারা ওখানে বসে আছে বলে ভাষ্য ইসমাইলের।
এই পথ দিয়ে যেতেই পাশের রহমতের বিল নামে যে সরু জলের ধারাটি বয়ে গেছে, তার ওপর রোহিঙ্গাদের সাড়ে পাঁচ বছর আগের ঢলের কিছু চিহ্ন এখনো রয়ে গেছে। পড়ে থাকা টুকরো প্লাস্টিক আর জিনিসপত্র দূষণ ঘটিয়েছে বিলের পানিতে। এখন এই গ্রামের মানুষের ঘাড়ে চেপে বসেছে আরেক যুদ্ধ।
শুধু কক্সবাজারের উখিয়ার এই গ্রাম নয়। উখিয়ার সঙ্গে লাগোয়া বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার সীমান্ত এলাকার মানুষও ফিরতে শুরু করেছেন।
বুধবার সকালে নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের বেতবুনিয়া বাজারের কাছে দেখা হয় টিউবওয়েল মিস্ত্রি মো. ইউসুফের সঙ্গে। বেতবুনিয়া বাজারে সকালের চা পানের জায়গা খুঁজছিলেন তিনি। তবে শতাধিক দোকানের এই বাজার একেবারেই বিরান।
ইউসুফ বলেন, “ঘুমধুম হাই স্কুলের পেছনে মঙ্গলবার সকাল ৯টায় মর্টার শেল পড়েছিল, তবে কেউ হতাহত হননি। এখান থেকে কিলোমিটার খানেক দূরে জলপাইতলি গ্রামে মর্টারশেল পড়ে দুজন মারা যান।”
এসব খবরে ভয় পেয়ে স্ত্রী ও সন্তানদের অন্যত্র রেখে এসেছেন। তিনি রয়ে গেছেন গবাদিপশুগুলোর দেখাশোনার জন্য। সকালে ঘরে রান্না হয়নি, তাই বেতবুনিয়া বাজারে এসেছিলেন কিছু খাওয়ার জন্য।
“মানুষই তো নাই, দোকান খুলা রাইক্ক্যে কী করব যে,” বলেন ইউসুফ।
বেতবুনিয়া বাজারের পাশেই ঘুমধুম উচ্চ বিদ্যালয়ে রাখা হয়েছে মিয়ানমার থেকে আসা ২৬৪ জনকে। তাদের মধ্যে মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষী বিজিপি, তাদের দুজনের স্ত্রী ও সন্তানসহ মিয়ানমার ইমিগ্রেশনের কিছু সদস্যও রয়েছেন।
বুধবার এই বিদ্যালয় পরিদর্শন করেন বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফউদ্দীন সিদ্দিকী।
পরিদর্শন শেষে তিনি বলেন, “ঘরের বাইরে থাকা কারও জন্যই সুখকর কিছু নয়। তবে জীবন রক্ষার জন্য যখন এ ধরনের পরিস্থিতি হয়, তখনতো কিছুটা করতেই হবে। এটা সম্পূর্ণই মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ গোলযোগ। আমাদের এখানে যেন কোনো ধরনের ফায়ার না আসে সেজন্য আমরা চেষ্টা করছি।”
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) ইনস্টিটিউট অব টেরোরিজম রিসার্চের প্রধান শাফকাত মুনীর বলেন, সীমান্ত পরিস্থিতি খুবই ঘোলাটে। এর মধ্যেই বাংলাদেশে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।
“মূল বিষয়টা হচ্ছে মিয়ানমার বর্তমানে ভয়ঙ্কর গৃহযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে রাখাইন অঞ্চলে ও চিন প্রদেশে। যেহেতু চিন ও রাখাইন দুটো প্রদেশের সঙ্গেই আমাদের সীমান্ত আছে, আমাদের জরুরিভিত্তিতে একটি উচ্চ পর্যায়ের টাস্কফোর্স গঠনের মাধ্যমে এই পরিস্থিতি মোকাবেলার উদ্যোগ নিতে হবে।”
শাফকাত মুনীর বলেন, “এটা এখন শুধু বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকদের ফিরে যাওয়ার ইস্যু নয়, আমাদের ভাবতে হবে যদি পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়, যদি মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ভেঙে পড়ে, তখন আমরা সেটা কীভাবে মোকাবেলা করব, সেটাও ভাবতে হবে। অবশ্যই আমাদের প্রধান প্রয়োরিটি হবে যাতে কোনো অনুপ্রবেশ সেখান থেকে না ঘটে। তবে এর যে ভূরাজনৈতিক এবং ভূকৌশলগত নিরাপত্তার বিষয়গুলো আছে, সেগুলো আমাদের গভীরভাবে পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”