সামরিক বাহিনী তাদের যুদ্ধ কৌশলে ধারাবাহিকভাবে বেসামরিক মানুষদের শাস্তি দেওয়ার উপরই অধিক মনোযোগ দিয়ে রেখেছে।
Published : 31 Jan 2024, 06:43 PM
মিয়ানমারে মানবাধিকার পরিস্থিতি আগে থেকেই খারাপ হচ্ছিল। জান্তা শাসনামলের তিন বছরে তা আরো অনেক বেশি খারাপ হয়ে লাগামহীন অবস্থায় চলে গেছে বলে মনে করেন জাতিসংঘে মানবাধিকার বিষয় হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক।
২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত অং সান সু চির দলকে উৎখাত করে মিয়ানমারের ক্ষমতা দখল করে মিন অং হ্লাইং নেতৃত্বাধীন সামরিক বাহিনী। যে অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে দেশটিতে গণবিক্ষোভ গড়ে উঠেছিল এবং জান্তা বাহিনীর দমনপীড়নে বহু বিক্ষোভকারী নিহত হয়। সু চির দলের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে আন্তর্জাতিক চাপও ছিল। কিন্তু সব চাপ উপেক্ষা করে দেশ শাসন করে যাচ্ছে জান্তা বাহিনী।
একদিন পরই ওই অভ্যুত্থানের তৃতীয় বার্ষিকী। মিয়ানমারের অভ্যুত্থান নিয়ে সোমবার জাতিসংঘের ওয়েব সাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ভলকার তুর্ক বলেন, “বিশ্ব জুড়ে অনেক অনেক সংকটের মধ্যে কাউকে ভুলে না যাওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। মিয়ানমারের জনগণ অনেক অনেক দিন ধরে ভুগছেন। গত বছর অক্টোবরের শেষ থেকে পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে। কারণ, সেনাবাহিনী জনগণকে টার্গেট বানাতে তাদের দীর্ঘদিনের কৌশলই অবলম্বন করে যাচ্ছে।
“সামরিক বাহিনী এবং সশস্ত্র বিরোধী দলগুলির মধ্যে তুমুল যুদ্ধের ফলে গণহারে মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। যুদ্ধে বেসামরিক লোকজন হতাহতও হয়েছে৷ এখন সামরিক বাহিনী যেহেতু যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতিরোধ এবং বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে, তাই তারা নির্বিচারে বিমান হামলা চালাচ্ছে এবং ঝাঁকে ঝাঁকে কামানের গোলা ছুঁড়ছে।”
জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বলা হয়, গত অক্টোবর থেকে মিয়ানমারে সাড়ে পাঁচশ’র বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। আর ২০২৩ সালে সামরিক বাহিনীর হামলায় সব মিলিয়ে প্রাণ হারিয়েছে ১৬শর বেশি বেসামরিক মানুষ। তার আগের বছরের চেয়ে যা প্রায় ৩০০ জন বেশি।
বিশ্বস্ত সূত্রের বরাত দিয়ে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, গত ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত মিয়ানমারে প্রায় ২৬ হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ১৯ হাজার ৯৭৩ জন এখনো বন্দি আছেন। তাদের কেউ কেউ নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছেন বলেও জানা গেছে। ন্যায় বিচারের আশা তো তারা করতেই পারছেন না।
গত তিন বছরে জান্তা প্রশাসনের হাতে আটক হওয়ার পর প্রায় ১,৫৭৬ জন মারা গেছেন।
মিয়ানমার জান্তার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের
তুর্ক বলেন, “সামরিক বাহিনী তাদের যুদ্ধ কৌশলে ধারাবাহিকভাবে বেসামরিক মানুষদের শাস্তি দেওয়ার উপরই অধিক মনোযোগ দিয়ে রেখেছে। তাদের বিশ্বাস, বেসামরিক লোকজন সেনাবাহিনীর শত্রু পক্ষদের সহায়তা করে।
“যার ফলে তারা নিয়মিত বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে এবং আন্তর্জাতিক আইন দ্বারা সুরক্ষিত চিকিৎসা কেন্দ্র ও স্কুলের মত স্থাপনায় হামলা চালায়।”
মিয়ানমারের প্রায় ৭৪টি শহরে যোগাযোগ ও ইন্টারনেট পরিষেবা আংশিক, অনিয়মিত বা পুরোপুরি বন্ধ রাখা হয়েছে। যার মধ্যে ১৭টি শহর পশ্চিমের রাখাইন রাজ্যে। গত বছর নভেম্বরে দেশটিতে পুনরায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিশেষ করে রাখাইন রাজ্যে সংঘাত মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। রাখাইনে রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে সামরিক বাহিনীর গোলা বর্ষণে অনেক রোহিঙ্গা হতাহত হওয়ার খবরও পাওয়া গেছে। সামরিক অভ্যুত্থানের আগে থেকেই রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে সেনাবাহিনীর অভিযান চলেছে।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার হপন নিও লেইক গ্রামে আরাকান আর্মি এবং মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে অন্তত ১২ বেসামরিক রোহিঙ্গা নিহত এবং আরো ৩০ জন আহত হয়েছেন। সেখানকার বাসিন্দারা দুই পক্ষের গোলাগুলির মধ্যে পড়ে যান।
সেনাবাহিনী আক্রমণ করতে পারে এমন ধারণা থেকে আরাকান আর্মি ওই রোহিঙ্গা গ্রামের ভেতর ও তার আশেপাশে নিজেদের যোদ্ধা মোতায়েন করেছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। সেনাবাহিনী বিরতিহীনভাবে ওই গ্রামে গোলা বর্ষণ করে এবং নানা অবকাঠামো ধ্বংস করে দেয়।
মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার বলেন, “সশস্ত্র সংঘাতে সব পক্ষগুলিকে অবশ্যই বেসামরিক লোকজন এবং বেসামরিক স্থাপনা রক্ষায় ক্রমাগত চেষ্টা করে যেতে হবে। সেই সঙ্গে সামরিক অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে সব পক্ষকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকার বেসামরিক জনগণকে প্রতিপক্ষের আক্রমণ থেকে রক্ষার সম্ভাব্য সব ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।”