“যে অবস্থা, তা আমার ৬০-৬৫ বছরের জীবনে দেখি নাই। অথচ সারাজীবনই সীমান্তে কাটিয়েছি। এখন তো থাকার অবস্থায় নাই,” বলেন এক বাসিন্দা।
Published : 06 Feb 2024, 12:29 AM
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে মিয়ানমার থেকে আসা গোলার আঘাতে দুজনের মৃত্যুর পর গ্রামের বাসিন্দারা ভয় আর আতঙ্কের মধ্যে এলাকা ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে চলে যাচ্ছেন।
কয়েকদিন ধরেই ওপারে যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে তুমব্রু সীমান্তের মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত ছিলেন। রাস্তাঘাটে যানবাহনের পাশাপাশি লোকজনের চলাচলও ছিল সীমিত। এলাকার দোকানপাট ও স্কুলগুলো ছিল প্রায় বন্ধ।
এ পরিস্থিতিতে এলাকায় মর্টার শেল ও গুলি এসে কয়েকজন আহত হওয়ার ঘটনার মধ্যে সোমবার দুজনের মৃত্যু হয়। এরপর মানুষজন সীমান্তবর্তী বাড়িঘরকে আর নিরাপদ ভাবছেন না; নিজ বাসভূমি ছেড়ে যেতে বাধ্য হচ্ছেন।
স্থানীয়রা বলছেন, এখনও তারা গোলাগুলি ও মর্টার শেলের আওয়াজ শুনতে পারছেন। সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার থেকে গুলি হচ্ছে; আবার বিদ্রোহীরাও পাল্টা গুলি চালাচ্ছে।
রাখাইনে সেনা ও সশস্ত্র বিদ্রোহী আরাকান আর্মির মধ্যে লড়াইয়ের প্রভাব পড়ছে সীমান্তের এপারের জনগোষ্ঠীর মধ্যেও। সোমবার দুপুরে মিয়ানমার থেকে আসা গোলার আঘাতে ঘুমধুম ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের জলপাইতলী এলাকায় নারীসহ দুজন নিহত হন।
তারা হলেন- জলপাইতলীর মসজিদ মোড় এলাকার বাসিন্দা বাদশা মিয়ার স্ত্রী হোসনে আরা (৪৫) এবং উখিয়া উপজেলার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ৮/ইস্ট, ৭৩ নম্বর ব্লকের বাসিন্দা নবী হোসেন (৬৫)। নবী হোসেনের এফসিএন নম্বর- ১৩০৬৩৪।
সারাদিন তাদের মরদেহ ঘটনাস্থলে থাকলেও রাতে ময়নাতদন্তের জন্য কক্সবাজার সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়। মরদেহের সঙ্গে হোসনে আরার বড় ভাই ও জলপাইতলীর বাসিন্দা নুরুল আলম এবং নবী হোসেনের জামাতা আব্দুস শুক্কুর এসেছিলেন। শুক্কুর রোহিঙ্গা ক্যাম্পেই বসবাস করেন বলে জানান।
নবী হোসেন দীর্ঘদিন ধরেই হোসনে আরার বাড়িতে দিনমজুরের কাজ করে আসছিলেন জানিয়ে নুরুল আলম বলেন, “যখন ঘটনা ঘটে তখন হোসনে আরা রোহিঙ্গা নবী হোসেনকে রান্নাঘরে দুপুরের খাবার দিচ্ছিলেন। এ সময় হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া একটি মর্টার শেল এসে রান্নাঘরে ভেতর পড়ে। এতে হোসনে আরার পেটের নাড়িভূঁড়ি বের হয়ে যায়।
“আর নবী হোসেনের শরীর ও মাথায় আঘাত করে। এতে ঘটনাস্থলে দুজনই মারা যান। নবী হোসেন দিনমজুর হিসেবে কয়েকদিন ধরেই বাড়িতে ছিলেন।”
নুরুল আলম সারাদিন এলাকাতেই ছিলেন। রাতে শহরে এসেছেন।
তিনি বলেন, “আগে অনেকেই বাড়িঘর ছেড়ে গেছিল; আবার আসতও। বাড়িতে গরু-বাছুর আছে। কিন্তু আজকে দুজনের মৃত্যুর পর এলাকায় মানুষের মধ্যে ভয় ঢুকে গেছে। তাদের মধ্যে আতঙ্ক আরও বেড়েছে। আগে যারা বাড়িতে ছিল তারা এখন কাছে-দূরের আত্মীয়-স্বজনদের কাছে চলে যাচ্ছে।”
সীমান্তের পরিস্থিতির ব্যাপারে জানতে চাইলে এই বৃদ্ধ বলেন, “এখনও মিয়ানমার থেকে গোলাগুলির শব্দ আসছে। মাঝে মাঝে হেলিকপ্টার থেকে গুলি ও মর্টার শেল ছোড়া হচ্ছে। আবার নিচ থেকে তাদের প্রতিপক্ষ আরাকান আর্মিও হেলিকপ্টার লক্ষ্য করে গুলি করছে।”
নুরুল আলম বলছিলেন, “যে অবস্থা, তা আমার ৬০-৬৫ বছরের জীবনে দেখি নাই। অথচ সারাজীবনই সীমান্তে কাটিয়েছি। এখন তো থাকার অবস্থায় নাই।”
এদিকে নবী হোসেনের জামাতা আব্দুস শুক্কুর বলেন, তার শ্বশুর রোহিঙ্গা ক্যাম্পেই বসবাস করতেন। কয়েক বছর ধরে মাঝে মাঝে কাজের প্রয়োজনে বাদশা মিয়ার বাড়িতে আসতেন। গত এক সপ্তাহ ধরে তিনি জলপাইতলীতে ছিলেন।
“দুপুরের খাবার সময় মর্টার শেল এসে আমার শ্বশুর ও বাড়ির মালিক মারা গেছেন- এটা শুনে আমি ক্যাম্প থেকে আসছি। এখানে মরদেহ নেওয়ার জন্য আসছি।”
এদিকে সোমবার সীমান্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন বিজিবির কক্সবাজার রিজিয়ন কমান্ডার বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মোর্শেদ আলম। তখন তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “আজ দুজন মর্টারের আঘাতে নিহত হয়েছেন। আমরা তাৎক্ষণিক বিজিপির কাছে এর প্রতিবাদ জানিয়েছি।”
২০২২ সালের অগাস্টের শেষ ও সেপ্টেম্বরের শুরুতে মিয়ানমারের যুদ্ধবিমান ও ফাইটিং হেলিকপ্টার থেকে বাংলাদেশের সীমানার ভেতর গোলাবর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল। অনেক মানুষ আতঙ্কে সীমান্ত ছেড়ে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিয়েছিল। তখন দেশটির রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছে এর প্রতিবাদ, নিন্দা ও উদ্বেগের কথা জানিয়েছিল ঢাকা।
কেন এই যুদ্ধ
২০২১ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে অং সান সু চির নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে মিয়ানমারের ক্ষমতা নেয় দেশটির সেনাবাহিনী। ২০২৩ সালের অক্টোবরের শেষ দিক থেকে মিয়ানমারের তিনটি জাতিগত বিদ্রোহী বাহিনী একজোট হয়ে জান্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে সমন্বিত আক্রমণ শুরু করে।
বাহিনীগুলো হল- তা’আং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি-টিএনএলএ, আরাকান আর্মি-এএ এবং মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স আর্মি-এমএনডিএএ। তারা শান, রাখাইন, চীন ও কেয়াহ রাজ্যে লড়াই চালাচ্ছে। বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ও সেনাপোস্ট দখল করে ইতোমধ্যে তারা সাফল্য দেখিয়েছে।
আরাকান আর্মি (এএ) এ জোটের অন্যতম অংশ। মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য রাখাইনের সংখ্যালঘু নৃগোষ্ঠীর একটি সশস্ত্র বাহিনী এটি। তারা রাখাইনের বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে লড়াই করছে।
রাখাইনে সেনা ও বিদ্রোহীদের মধ্যে লড়াইয়ের প্রভাব পড়ছে সীমান্তের এপারের জনগোষ্ঠীর মধ্যেও। যুদ্ধ শুরুর পর রোব ও সোমবার সবচেয়ে বড় অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটল।
আরও পড়ুন:
মিয়ানমারের হেলিকপ্টার থেকে গুলি, বিজিপি ক্যাম্পে আগুন
মিয়ানমারে যুদ্ধ: রাখাইনের যে খবর পাচ্ছেন ক্যাম্পের রোহিঙ্গারা
মিয়ানমার থেকে আসা গোলায় বান্দরবানে নিহত ২
মিয়ানমারের যুদ্ধ ছেড়ে সশস্ত্র অনুপ্রবেশ, বাড়ি ছাড়ছেন স্থানীয়রা
বাংলাদেশে ঢুকেছে মিয়ানমারের ৬৮ সীমান্তরক্ষী: বিজিবি
মিয়ানমার থেকে আসা গুলিতে দুজন আহত, শিক্ষার্থীশূন্য স্কুল
মিয়ানমারের ১৪ সীমান্তরক্ষী পালিয়ে বাংলাদেশে
দুদিন পর নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে গোলাগুলি, অটোরিকশায় লাগল গুলি
নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে এসে পড়ল ৩ মর্টার শেল
অভ্যুত্থানের ৩ বছরে প্রথমবার বেকায়দায় মিয়ানমারের জান্তা প্রধান
জান্তা আমলে মিয়ানমারে মানবাধিকার পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে: ভলকার তুর্ক
মিয়ানমারের ওপর আবার যুক্তরাজ্যের নিষেধাজ্ঞা
মিয়ানমার সীমান্তে লাগাতার গোলাগুলি, নাইক্ষ্যংছড়ির ৫ স্কুলে ‘ছুটি’
মিয়ানমার সীমান্তের ওপারে ফের গোলাগুলি, এপারে আতঙ্ক
মিয়ানমারের গুলি এসে ভেদ করল টেকনাফের বাড়ির দরজা
মিয়ানমারে যুদ্ধ: রাখাইনের যে খবর পাচ্ছেন ক্যাম্পের রোহিঙ্গারা
তুমব্রু সীমান্তে রাতেও গোলাগুলি, পরিদর্শনে ডিসি-এসপি
জান্তা আমলে মিয়ানমারে মানবাধিকার পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে: ভলকার তুর্ক
বিদ্রোহী জোটের হামলায় বহু এলাকা হাতছাড়া, কোণঠাসা মিয়ানমার জান্তা
মিয়ানমারে পেরে উঠছে না জান্তা বাহিনী, সমর্থন হারাচ্ছেন মিন অং হ্লাইং
ভারতে পালাচ্ছে মিয়ানমারের সেনারা, উদ্বিগ্ন মিজোরাম
প্রত্যাবাসন: রাখাইন ঘুরে ‘উন্নতি’ দেখেছে আরআরআরসি, রোহিঙ্গারা হতাশ
জরুরি অবস্থার প্রস্তুতি নিতে নির্দেশনা মিয়ানমার জান্তা সরকারের
নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে এসে পড়ল ৩ মর্টার শেল
মিয়ানমারে যুদ্ধ: স্থল সীমান্তের পাশাপাশি নৌপথেও নিরাপত্তা জোরদার