ইউপি সদস্য বলেন, “তুমব্রু এলাকার কেউ কেউ নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাচ্ছেন।”
Published : 05 Feb 2024, 07:17 PM
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের ওপারে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে হেলিকপ্টার থেকে গুলি বর্ষণের পর দেশটির সীমান্ত রক্ষা বাহিনীর একটি ক্যাম্পে আগুন জ্বলতে দেখেছেন এপারের বাসিন্দারা।
সোমবার সকালে পরিস্থিতি একটু শান্ত থাকলেও দুপুরে মিয়ানমার থেকে আসা গোলার আঘাতে ঘুমধুম ইউনিয়নের জলপাইতলী এলাকায় নারীসহ দুজন নিহতের পর তুমব্রু সীমান্তের বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
ঘুমধুম ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো. শফিক বলেন, “তুমব্রু এলাকায় কয়েকদিন ধরে থেমে থেমে গোলাগুলি চললেও সোমবার সকালে তীব্রতা একটু কমে আসে। কিন্তু ঘুমধুম এলাকার দিক থেকে প্রচণ্ড গোলাগুলি শব্দ আসে।
“দুপুরে তুমব্রু হয়ে ঘুমধুমের এলাকার দিকে মিয়ানমারের একটি হেলিকপ্টার উড়ে যেতে দেখা গেছে। তখন কিছুক্ষণ পর ঘুমধুম এলাকায় ওপারে মিয়ানমারে ঢেঁকিবুনিয়া বিজিপি ক্যাম্পে আগুন জ্বলতেও দেখা যায়।”
ইউপি সদস্য বলেন, “তুমব্রু এলাকায় কেউ কেউ নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাচ্ছেন। আবার পরিস্থিতি একটু ভাল হলে কেউ কেউ চলে আসছেন। কারণ সবার ঘরে গবাদিপশু রয়েছে। এগুলো দেখভাল করতে হয়। এখন ভয়-আতঙ্ক নিয়ে দিন পার করতে হচ্ছে সীমান্তের লোকজনদের।”
বিকালে ঘুমধুম সীমান্তের কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলেছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম; যাদের বাসস্থান একেবারে মিয়ানমার সংলগ্ন এলাকায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাদের একজন দাবি করেন, “ঢেঁকিবুনিয়ার পাশে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপির ‘রাইট ক্যাম্প’ হিসেবে পরিচিত ক্যাম্পটি বিদ্রোহীরা দখল করে নেয়। সেখানে বিজিপির কয়েকশ সদস্য ছিল। তারা পালিয়ে গেছেন। ওই ক্যাম্প পুনর্দখলে নেওয়ার জন্যই মূলত মিয়ানমার সেনাবাহিনী হেলিকপ্টার থেকে মুহুর্মহু গুলি করে।”
আরেকজন বাসিন্দা বলেন, “রাইট ক্যাম্পের কয়েক কিলোমিটার দূরে ঘুমধুম সীমান্তে বিজিপির আরেকটি ক্যাম্প রয়েছে; যেটিকে ‘লেফট ক্যাম্প’ বলা হয়। সেখানেও ১০০ জনের কাছাকাছি বিজিপি সদস্য রয়েছে। তবে সে ক্যাম্পটি এখনও অক্ষত আছে।”
ঘরবাড়ি ছেড়ে যাওয়া সাময়িক বিষয়: র্যাব
এদিকে সোমবার দুপুরে সীমান্ত এলাকা পরিদর্শন করেন কক্সবাজার র্যাব-১৫ ব্যাটালিয়নের জ্যেষ্ঠ সহকারী পরিচালক ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবু ছালাম চৌধুরী।
পরিদর্শন শেষে পরিস্থিতি তুলে ধরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “সীমান্তবর্তী এলাকায় কয়েক দিন ধরে যে উত্তেজনা শুরু হয়েছে সেটা এখনও চলমান রয়েছে। সেখানে বিজিবি কাজ করছে। তার পাশাপাশি র্যাব-পুলিশ বসে নেই।
“এই পরিস্থতির মধ্যে উৎসুক জনতা এই সমস্ত ঘটনা দেখার জন্য ঘর ছেড়ে রাস্তায় চলে আসে। এটা তাদের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করি। এর মধ্যে শিশুরাও রয়েছে। এর মধ্যে মিয়ানমার থেকে গুলি এখানে এসে পড়ে। এরই মধ্যে পড়েছেও। এজন্য তাদেরকে সতর্কীকরণ করা হচ্ছে যাতে তারা নিরাপদ জায়গায় থাকেন।”
স্থানীয়দের ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার বিষয়ে র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, “ঘরবাড়ি ছেড়ে যাচ্ছে এটা সাময়িক একটা বিষয়। যখন একটা উত্তেজনা শুরু হয় তখন তারা অনেকে ভয়ে বিহ্বাল হয়ে আরও বেশি ক্ষতি হবে কি-না এই আশঙ্কায় ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে। নিরাপত্তার ব্যাপারে স্থানীয় পুলিশ রয়েছে; পাশপাপাশি বিজিবি ও র্যাব আছে। সব পক্ষ থেকে নিরাপত্তা জোরদার করে যাচ্ছে।”
আবু ছালাম চৌধুরী বলেন, “আরেকটা বিষয় হল, তারা বিভিন্নভাবে (বিজিপি ও বিদ্রোহী গোষ্ঠী) মেইন রোডে আমাদের মুভমেন্ট অবলোকন করছে। তবে তারা অবলোকন করল কী করল না- আমরা এটা আমলে নিই না।
“কিন্তু আমরা আমাদের দিক থেকে অত্যন্ত সবল আছি। তারা ইচ্ছে করলে এখানে চলে আসতে পারবে না। চলে এলেও আমরা যাতে ব্যবস্থা নিতে পারি সেভাবে সতর্ক আছি।”
ছয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ
এই অবস্থার মধ্যে ঘুমধুম ইউনিয়নের সীমান্তের ওপারে সীমান্তঘেঁষা ছয়টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালে জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
সীমান্তঘেঁষা এসব স্কুলে কয়েক দিন ধরে আতঙ্কে কোনো শিক্ষার্থী না এলেও বন্ধ ঘোষণা করা হয়নি। শিক্ষকদের উপস্থিতিতে খোলাই ছিল। তবে এবার সীমান্ত পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকায় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
স্কুলগুলো হল- উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের সীমান্তঘেঁষা এলাকার বাইশফাঁড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ভাজাবনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পশ্চিমকুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দক্ষিণ ঘুমধুম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ঘুমধুম মিশকাতন্নবী দাখিল মাদ্রাসা।
এ বিষয়ে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা লামা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শান্তনু কুমার দাশ বলেন, “একেবারে সীমান্তঘেঁষা হওয়ায় পাঁচটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি মাদরাসা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ঘুমধুম উচ্চ বিদ্যালয়ও প্রয়োজনে পরিস্থিতি অনুযায়ী বন্ধ হতে পারে। এ বিষয়ে প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে আলোচনা করা হবে।”
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ত্রিরতন চাকমা বলেন, “কর্তৃপক্ষের নির্দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্কুলগুলো বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত বন্ধ থাকবে। এলাকাটি বিজিবি ঘিরে রেখেছে। ওই এলাকায় আপাতত কাউকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। যানবাহন যাতায়াতও বন্ধ রয়েছে। কারণ রোববার মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা তাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ৫০ জনকে একটা স্কুলে রাখা হয়েছে।”
পশ্চিমকূল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হেলাল উদ্দিন বলেন, “গোলাগুলির আতঙ্কে কয়েকদিন ধরে এসব স্কুল শিক্ষার্থীশূন্য ছিল। এখন দিন দিন পরিস্থিতি খারাপও হওয়ায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে। শিক্ষার্থীরা না এলেও শিক্ষকরা নিয়মিত উপস্থিত ছিল। পরিস্থিতির কারণে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”
‘অনুপ্রবেশ ঠেকাতে কঠোর বিজিবি’
এদিকে সোমবার সীমান্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন বিজিবির কক্সবাজার রিজিয়ন কমান্ডার বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মোর্শেদ আলম।
পরে তিনি সাংবাদিকদের কাছে রোববার বিজিপি সদস্যদের অনুপ্রবেশ বিষয়ে বলেন, “রোববার বিজিপি যখন কোনোভাবেই বিদ্রোহী বাহিনীর সঙ্গে পেরে উঠছিল না তখন তারা আমাদের সীমান্তে অনুপ্রবেশ করতে চায়। তখন আমরা কর্তৃপক্ষকে জানাই এবং কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আমরা তাদের সেইফ প্যাসেজ দেই।
“তারা অস্ত্র ছেড়ে আত্মসমর্পণ করে। তাদের নিরাপদে রেখে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করি। তাদের ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে সরকার কাজ করছে। আজ দুজন মর্টারের আঘাতে নিহত হয়েছেন। আমরা তাৎক্ষণিক বিজিপির কাছে এর প্রতিবাদ জানিয়েছি।”
বিজিবি কর্মকর্তা আরও বলেন, “আমাদের সীমান্ত সিল করা আছে। আমরা কোনোভাবেই রোহিঙ্গা বা অন্যদের এখানে অনুপ্রবেশ করতে দেব না। বিজিবি সেখানে কাজ করছে।”
কেন এই যুদ্ধ
২০২১ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে অং সান সু চির নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে মিয়ানমারের ক্ষমতা নেয় দেশটির সেনাবাহিনী। ২০২৩ সালের অক্টোবরের শেষ দিক থেকে মিয়ানমারের তিনটি জাতিগত বিদ্রোহী বাহিনী একজোট হয়ে জান্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে সমন্বিত আক্রমণ শুরু করে।
বাহিনীগুলো হল- তা’আং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি-টিএনএলএ, আরাকান আর্মি-এএ এবং মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স আর্মি-এমএনডিএএ। তারা শান, রাখাইন, চীন ও কেয়াহ রাজ্যে লড়াই চালাচ্ছে। বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ও সেনাপোস্ট দখল করে ইতোমধ্যে তারা সাফল্য দেখিয়েছে।
আরাকান আর্মি (এএ) এ জোটের অন্যতম অংশ। মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য রাখাইনের সংখ্যালঘু নৃগোষ্ঠীর একটি সশস্ত্র বাহিনী এটি। তারা রাখাইনের বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে লড়াই করছে।
রাখাইনে সেনা ও বিদ্রোহীদের মধ্যে লড়াইয়ের প্রভাব পড়ছে সীমান্তের এপারের জনগোষ্ঠীর মধ্যেও। যুদ্ধ শুরুর পর রোববার সবচেয়ে বড় অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটল।
২০২২ সালের অগাস্টের শেষ ও সেপ্টেম্বরের শুরুতে মিয়ানমারের যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার থেকে বাংলাদেশের সীমানার ভেতর গোলাবর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল। অনেক মানুষ আতঙ্কে সীমান্ত ছেড়ে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিয়েছিল। তখন দেশটির রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছে এর প্রতিবাদ, নিন্দা ও উদ্বেগের কথা জানিয়েছিল ঢাকা।
(প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন কক্সবাজার প্রতিনিধি শংকর বড়ুয়া রুমি।)
আরও পড়ুন:
মিয়ানমারে যুদ্ধ: রাখাইনের যে খবর পাচ্ছেন ক্যাম্পের রোহিঙ্গারা
মিয়ানমার থেকে আসা গোলায় বান্দরবানে নিহত ২
মিয়ানমারের যুদ্ধ ছেড়ে সশস্ত্র অনুপ্রবেশ, বাড়ি ছাড়ছেন স্থানীয়রা
বাংলাদেশে ঢুকেছে মিয়ানমারের ৬৮ সীমান্তরক্ষী: বিজিবি
মিয়ানমার থেকে আসা গুলিতে দুজন আহত, শিক্ষার্থীশূন্য স্কুল
মিয়ানমারের ১৪ সীমান্তরক্ষী পালিয়ে বাংলাদেশে
দুদিন পর নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে গোলাগুলি, অটোরিকশায় লাগল গুলি
নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে এসে পড়ল ৩ মর্টার শেল
অভ্যুত্থানের ৩ বছরে প্রথমবার বেকায়দায় মিয়ানমারের জান্তা প্রধান
জান্তা আমলে মিয়ানমারে মানবাধিকার পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে: ভলকার তুর্ক
মিয়ানমারের ওপর আবার যুক্তরাজ্যের নিষেধাজ্ঞা
মিয়ানমার সীমান্তে লাগাতার গোলাগুলি, নাইক্ষ্যংছড়ির ৫ স্কুলে ‘ছুটি’
সীমান্তে ‘সর্বোচ্চ সতর্ক’ থাকার নির্দেশ বিজিবি মহাপরিচালকের
মিয়ানমার সীমান্তের ওপারে ফের গোলাগুলি, এপারে আতঙ্ক
মিয়ানমারের গুলি এসে ভেদ করল টেকনাফের বাড়ির দরজা
মিয়ানমারে যুদ্ধ: রাখাইনের যে খবর পাচ্ছেন ক্যাম্পের রোহিঙ্গারা
তুমব্রু সীমান্তে রাতেও গোলাগুলি, পরিদর্শনে ডিসি-এসপি
জান্তা আমলে মিয়ানমারে মানবাধিকার পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে: ভলকার তুর্ক
বিদ্রোহী জোটের হামলায় বহু এলাকা হাতছাড়া, কোণঠাসা মিয়ানমার জান্তা
মিয়ানমারে পেরে উঠছে না জান্তা বাহিনী, সমর্থন হারাচ্ছেন মিন অং হ্লাইং
ভারতে পালাচ্ছে মিয়ানমারের সেনারা, উদ্বিগ্ন মিজোরাম
প্রত্যাবাসন: রাখাইন ঘুরে ‘উন্নতি’ দেখেছে আরআরআরসি, রোহিঙ্গারা হতাশ
জরুরি অবস্থার প্রস্তুতি নিতে নির্দেশনা মিয়ানমার জান্তা সরকারের
নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে এসে পড়ল ৩ মর্টার শেল
মিয়ানমারে যুদ্ধ: স্থল সীমান্তের পাশাপাশি নৌপথেও নিরাপত্তা জোরদার