আতঙ্কিত শহীদুল বলেন, "সেদিনের ঘটনার পর থেকে বাড়িতে থাকতে ভয় পাই। একা দোকানে ঘুমাই। ঘরে ছোট ভাই এবং বাবা থাকে।”
Published : 08 Feb 2024, 12:19 PM
প্রতিদিন খুব সকালে উঠলেও মঙ্গলবার বিছানা ছাড়তে একটু দেরি হয়েছিল শহীদুল ইসলামের। মুহুর্মুহু গুলির শব্দে তার ঘুম ভাঙার পর কিছু বুঝার আগেই একটি গুলি জানালা ভেদ করে ঘরে ঢুকে পড়ে। তবে খাটের কাঠটি উঁচু হওয়ায় প্রাণে বেঁচে যান তিনি।
২৫ বছর বয়সী এই যুবক বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত এলাকার ঘুমধুম বেতবুনিয়া বাজার এলাকার বাসিন্দা। তাদের আধা পাকা ও টিনের ছাদের বাড়িটি থেকে আধ কিলোমিটার দূরে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর লেফট ক্যাম্প। মাঝখানে বাংলাদেশের সীমান্ত সড়ক।
বুধবার বিকালে ঘুমধুম বাজারে নিজের চায়ের দোকানে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে নিজের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন তিনি।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে শহীদুল বলেন, “সীমান্ত এলাকা হলেও আমাদের বাড়ি এমন একটি জায়গায় তৈরি; যেখানে কখনও গুলি এসে লাগার কথা না। সীমান্তের ওপারে যতই গন্ডগোল হোক আমরা নিরাপদে থাকব। কিন্তু সেদিনের গুলির আওয়াজ এখনও কানে বাজে।
" আগের দিন তুমব্রু এলাকার দিকে বেশি উত্তেজনা চলছিল। ঘুমধুমের দিকেও গন্ডগোল হয় কিনা এই আশঙ্কায় রাত তিনটা পর্যন্ত জেগে ছিলাম। এজন্য এদিন সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে যায়।
“তখন বাজে সকাল ৮টা ৫০ মিনিট। হঠাৎ করে আমার বাড়িতে বৃষ্টির মত এসে গুলি লাগে। চারপাশে শুধু গুলির আওয়াজ।"
শহীদুল বলেন, “আমি যেখানে শুয়েছিলাম হঠাৎ সেখানে জানালার কাচের গ্লাস ভেঙে খাটের পিছনে অংশে এসে লাগে গুলি। গুলিটি একদম বরাবর আমার দিকেই আসছিল। এই খাট না থাকলে আমি নিশ্চিত মারা যেতাম।
“গুলিটা প্রথমে কাচের জানালায়; পরে খাটের পেছনের অংশে লাগার কারণে একদম নিশ্চিত মৃত্যু থেকে ফিরে আসছি।”
তিনি আরও বলেন, “সেদিন ঘুম থেকে তাড়াতাড়ি উঠলে বরং সমস্যা হত। ঘুম থেকে দেরিতে উঠায় প্রাণে বেঁচে গেছি।”
মিয়ানমারের রাখাইনে দেশটির সেনা ও বিদ্রোহীদের যুদ্ধের মধ্যে সীমান্তের এপারে আতঙ্কজনক পরিস্থিতি চলছে কয়েকদিন ধরে।
এর মধ্যে বুধবার ঘুমধুম ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আনোরুল ইসলামের সঙ্গে সীমান্তের পরিস্থিতি নিয়ে আলাপচারিতায় উঠে আসে শহীদুলের প্রসঙ্গ।
তখন সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে তার বাড়ি দেখাতে নিয়ে যান তিনি। সঙ্গে পিছু নেন আরও কয়েকজন বাসিন্দা।
শহীদুলের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, ঘরের পাকা দেয়ালের একপাশে চার-পাঁচটি গুলির দাগ। দেয়ালের মাঝখানে ঘরের শক্ত লোহার দরজা। পুরু লোহার সেই দরজা ভেদ করে চলে গেছে গুলি। গুলিতে ছিদ্র হয়ে গেছে ছাদের টিনও।
বাড়ির কড়ই, কাঁঠাল, জাম এবং আম গাছগুলো গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে গেছে। তাদের ঘরের পাশেই বেশিরভাগ আমের গাছ। গুলি লেগে এখনও পড়ে রয়েছে সেসব গাছের ডালপালা।
মর্টারশেল এবং গুলি এসে পড়ায় মাটিতে গর্ত তৈরি হয়ে যায়। পরে বিজিবি সদস্যরা এসে সেগুলো উদ্ধার করে নিয়ে যায় বলে জানান বাড়ির বাসিন্দারা।
শহীদুল জানান, সেদিনে তাদের ঘরে তারা দুই ভাই এবং তার বাবাসহ তিনজন ছিলেন। পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকায় পরিবারের বাকী সদস্যদের আগেই কক্সবাজার আত্মীয় বাড়িতে পাঠানো হয়েছে।
“ঘরের শিশুরা থাকলে সেদিন বাইরে খেলাধুলা করত। তখন নিশ্চিত কারও না কারও গায়ে এসে গুলি লাগত।”
শহীদুলের বাবা ৭০ বছর বয়সী সৈয়দ নূর সিকদার জানান, “সেদিনের ঘটনার সময় টয়লেটে ছিলাম আমি। সকাল বেলায় ঘরের উপর বৃষ্টির মত গুলির শব্দ শুনে হতভম্ভ হয়ে পড়ি। ৭১ সালের যুদ্ধের পর এরকম পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।”
সৈয়দ নূর সিকদারের বড় ভাই নুরুল ইসলাম একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য। পাশাপাশি দুটি ঘরে তারা থাকেন।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে নুরুল ইসলাম বলেন, “সেদিন সকালে উঠানে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে রোদ পোহাচ্ছিলাম। সাড়ে ৮টার দিকে একটা বুলেটের আওয়াজ কানে আসে। সঙ্গে সঙ্গে আমি মাটিয়ে শুয়ে পড়ি, পজিশনে চলে যাই।
“তখনি পরিবারে অন্য সদস্যদের ঘরে ঢুকে যেতে বলি। এর মধ্যেই সীমান্তর ওপার থেকে আমাদের দুই ভাইয়ের ঘরের চারদিকে মুহুর্মুহু গুলি এসে পড়ে। প্রায় আধা ঘণ্টা এমন গুলি চলতে থাকে। ”
পরে গুলি কিছুটা কমলে পরিবারের সদস্যরা নিরাপদে সরে পড়েন। কিন্তু সেদিন সারাদিনই থেমে থেমে গুলির শব্দে কেঁপে উঠেছিল শহীদুলদের বাড়িটি।
আতঙ্কিত শহীদুল বলেন, "সেদিনের ঘটনার পর থেকে বাড়িতে থাকতে ভয় পাই। একা দোকানে ঘুমাই। ঘরে ছোট ভাই এবং বাবা থাকে। এখন কিছু শব্দ পেলেই শাই করে গুলির আওয়াজের মত শুনি। সবসময় খারাপ লাগার অনুভূতি কাজ করে।"