‘শান্ত’ ঘুমধুম, ফাঁকা আশ্রয়কেন্দ্র

“ক্যাম্প পুনর্দখল করার জন্য মিয়ানমার সেনাবাহিনী যেকোনো মুহূর্তে বিমান হামলা চালাতে পারে; এই ভয় সবসময় তাড়া করে ফিরে।”

উসিথোয়াই মারমাঘুমধুম সীমান্ত থেকে, বান্দরবান প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Feb 2024, 05:09 PM
Updated : 7 Feb 2024, 05:09 PM

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দেশটির সেনাবাহিনী ও সশস্ত্র বিদ্রোহীদের মধ্যে টানা কয়েকদিন গোলাগুলির পর বুধবার ‘তুলনামূলক শান্ত’ পরিস্থিতি গেছে বলে জানিয়েছেন এপারের সীমান্তের বাসিন্দারা। 

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের জলপাইতলী গ্রামে মিয়ানমার থেকে আসা মর্টার শেলের আঘাতে সোমবার এক নারীসহ দুজনের মৃত্যুর পর ওই সীমান্তজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

এই অবস্থায় মঙ্গলবার আতঙ্কিত মানুষজনকে নিরাপদে সরিয়ে নিতে আশ্রয়কেন্দ্র খোলার সিদ্ধান্ত নেয় জেলা প্রশাসন। লোকজনকে সরিয়ে নিতে এলাকায় মাইকিংও করা হয়।

যদিও মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মির যুদ্ধের মধ্যে আগ থেকেই অধিকাংশ লোকজন বাড়িঘর ছেড়ে আত্মীয়-স্বজনদের কাছে আশ্রয় নিতে শুরু করেছিলেন। গবাদি পশু আর বাড়িঘরের জিনিসপত্রের মায়ার সাহস করে যারা বাড়িতে ছিলেন দুজন নিহতের পর তারাও সোম ও মঙ্গলবার এলাকা ছাড়েন।    

ফলে সরকারঘোষিত আশ্রয়কেন্দ্র উত্তর ঘুমধুম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে খুব বেশি মানুষ আসেননি; যারা এসেছিলেন তারাও রাত্রিযাপনের পর চলে গেছেন বলে জানিয়েছেন জনপ্রতিনিধিরা।

রাখাইনে লড়াইয়ের প্রভাব পড়ছে সীমান্তের এপারের জনগোষ্ঠীর মধ্যেও। মানুষের বাড়িঘরে এসে মর্টার শেল ও গুলি পড়ায় এরই মধ্যে বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। আতঙ্কে এলাকার রাস্তাঘাটে যানবাহন চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। বাজারের অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ।  

এদিকে যুদ্ধে টিকতে না পেরে রোববার থেকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে থাকেন মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষা বাহিনী বিজিপির সদস্যরা। বুধবারও নতুন করে ৬৪ জন অনুপ্রবেশ করে আত্মসমর্পণ করেছে বলে জানিয়েছে বিজিবি। এ নিয়ে গত চারদিনে মোট ৩২৮ বিজিপি সদস্য অনুপ্রবেশ করেছে; যারা বিজিবির হেফাজতে রয়েছে।      

বিকালে ঘুমধুম ইউনিয়নে গিয়ে দেখা যায়, পরিবেশ একটু শান্ত। গোলাগুলির শব্দ তেমন একটা শোনা যায়নি। মানুষজনের চলাচলও একটু বেড়েছে বলে স্থানীয়রা জানান।    

আতঙ্কিত মানুষদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য প্রশাসন ঘোষিত কেন্দ্র উত্তর ঘুমধুম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি ঘুমধুম বাজার থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে। বিদ্যালয়টি একদম রাস্তার পাশে। যাতায়াতের রাস্তাটি সরু হলেও ইজিবাইক, অটোরিকশা ও ছোটখাট গাড়ি অনায়াসে ঢুকতে পারে।

Also Read: চিকিৎসাধীন মিয়ানমারের বিজিপির সদস্যের পাশে বিজিবি প্রধান

সেখানে গিয়ে দেখা যায়, বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে কয়েকজন শিশু খেলাধুলা করছে। স্কুলের কক্ষগুলো তালাবদ্ধ। আশ্রয় নেওয়া লোকজন কেউ নেই। একেবারে খালি পড়ে রয়েছে।

পাশের একটা ছোট্ট চায়ের দোকানে কয়েকজনের সঙ্গে দেখা হয়। তারা সবাই এলাকার ঘুমঘুম ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা।

বাবুল মিঞা নামে একজন বলেন, “গতকাল রাতে স্কুলে ২৮ পরিবার ছিল। তাদের সঙ্গে শিশু-বাচ্চারাও ছিল। তবে পরিবারের সঙ্গে পুরুষ খুব একটা ছিল না। তারা সবাই আজকে সকালে যার যার আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে চলে গেছে। মেম্বারদের নির্দেশে সবাইকে আমি নিজের হাতে রান্না করে খাইয়েছি।

“বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে কেউ আশ্রয়কেন্দ্রে থাকতে চায় না। সবাই আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে গিয়ে থাকতে চায়। যারা ছিল সবাই তুমব্রু এলাকার বাসিন্দা। একেবারে সীমান্তঘেঁষা এলাকার লোকজন। ওপারে কিছু হলে তারা বরাবরই ঝুঁকিতে ছিল।”

রহমত উল্লাহ নামে একজন বলেন, “এই ৭ নম্বর ওয়ার্ড এলাকা নিরাপদ। ঘুমধুম বাজার এলাকা থেকেও একটু দূরে। এজন্য এই এলাকার স্কুলটা আশ্রয়কেন্দ্র করা হয়েছে। তবে গণ্ডগোলের সময় এখন থেকেও গোলাগুলির শব্দ পাওয়া যায়। হেলিকপ্টার উড়তেও দেখা যায়।”

আরও পড়ুন:

অন্য এলাকা থেকে এখানে এসে আশ্রয় নেওয়া একটি বাড়ি দেখিয়ে দেন রহমত উল্লাহ।

উত্তর ঘুমধুম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে কয়েক গজ দূরেই সেই বাড়ি। 

সেখানে গিয়ে দেখা যায়, শিশুসন্তানকে নিয়ে বাড়ির উঠানে বসে আছেন ২২ বছর বয়সী ইসমত আরা। পাশে তিনটি গরু ঘাস খাচ্ছিল। এগুলো ইসমত আরার। তিনি বাড়ি ছাড়ার সময় গবাদি পশুদের নিয়ে এসেছেন।

ইসমত আরা জানান, তিনি ইউনিসেফ পরিচালিত তুমব্রু ক্লাস্টার পাড়া কেন্দ্রের কর্মী। গোলাগুলি বাড়তে থাকায় তিন দিন আগে এখানে ননদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। তার ভাই, ভাবী, শ্বশুর ও শিশু-সন্তানদের নিয়ে এসেছেন। স্বামী অন্যের একটা বাগানে কাজ করেন।

কথাগুলো বলার সময় উঠে দাঁড়াতে পারছিলেন না তিনি। বললেন, এখানে এসে পড়ে গিয়ে পায়ে প্রচণ্ড ব্যাথা পেয়েছিলেন, কোমরেও আঘাত লেগেছে।

তার পরিবারের মত আরও অনেকে এভাবে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন বলেও জানান ইসমত আরা।

ওই এলাকার ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মহিলা সংরক্ষিত আসনের সদস্য ফাতেমা বেগম বলেন, গতকালও তার ঘরে তুমব্রু এলাকার দুই পরিবার আশ্রয় নিয়েছিল। বুধবার সকালে তারা নিজেদের আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে চলে গেছেন।

“স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং এলাকার মানুষ হিসেবে যতটুকু সম্ভব সহযোগিতা করে যাচ্ছি।”

ঘুমধুম ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, “গতকাল বিভিন্ন এলাকা থেকে আতঙ্কে থাকা ২৭ পরিবার আশ্রয় নিয়েছিল। তারাও বুধবার সকালে যার যার আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে ফিরে গেছেন।

“আশ্রয় নেওয়া লোকজন মূলত তুমব্রু সীমান্তের বাসিন্দা। মঙ্গলবার বিচ্ছিন্নভাবে দূরে কোথাও গোলাগুলি হয়ে থাকতে পারে। তবে আজ কোথাও গুলির শব্দ শোনা যায়নি।”

ঘুমধুম বাজার ও আশপাশের এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সীমান্ত সড়ক দিয়ে ঘুমধুম যাওয়ার রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছেন বিজিবি সদস্যরা। ওই রাস্তা দিয়ে কাউকে চলাচল করতে দেওয়া হচ্ছে না।

সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে দায়িত্বরত বিজিবি সদস্য জানান, এই রাস্তার একটু পরেই ওপারে মিয়ানমার বিজিপি ক্যাম্প। সেখান থেকে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। নিরাপত্তার কারণে কাউকে চলাচল করতে দেওয়া হচ্ছে না। রাস্তার মাঝখান বরাবর বাঁশ ফেলে বন্ধ করা হয়েছে।

রাতে ঘুমধুম বাজারে গিয়ে দেখা যায়, মোটামুটি লোকজন রয়েছে। অনেক দোকানও খুলেছে। বিদ্যুতের আলোয় চায়ের দোকানে বসে অনেকে আড্ডাও দিচ্ছেন। 

ঘুমধুম বাজারের লোকজন জানান, কয়েক দিন আগে তুমব্রু সীমান্তে উত্তেজনা ছিল। দিনভর শান্ত থাকলেও আতঙ্ক রয়েছেন তারা।

এর মধ্যে এক যুবক দাবি করেন, “সীমান্তের ওপারে মিয়ানমার সীমান্ত রক্ষা বাহিনী বিজিপির রাইট ক্যাম্প এবং লেফট ক্যাম্প দখল করে নিয়েছে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি। পুনর্দখল করার জন্য মিয়ানমার সেনাবাহিনী যেকোনো মুহূর্তে বিমান হামলা চালাতে পারে। এই ভয় সবসময় তাড়া করে ফিরে।”

কেন এই যুদ্ধ

২০২১ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে অং সান সু চির নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে মিয়ানমারের ক্ষমতা নেয় দেশটির সেনাবাহিনী। ২০২৩ সালের অক্টোবরের শেষ দিক থেকে মিয়ানমারের তিনটি জাতিগত বিদ্রোহী বাহিনী একজোট হয়ে জান্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে সমন্বিত আক্রমণ শুরু করে।

বাহিনীগুলো হল- তা’আং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি-টিএনএলএ, আরাকান আর্মি-এএ এবং মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স আর্মি-এমএনডিএএ। তারা শান, রাখাইন, চীন ও কেয়াহ রাজ্যে লড়াই চালাচ্ছে। বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ও সেনাপোস্ট দখল করে ইতোমধ্যে তারা সাফল্য দেখিয়েছে।

আরাকান আর্মি (এএ) এ জোটের অন্যতম অংশ। মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য রাখাইনের সংখ্যালঘু নৃগোষ্ঠীর একটি সশস্ত্র বাহিনী এটি। তারা রাখাইনের বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে লড়াই করছে।

রাখাইনে সেনা ও বিদ্রোহীদের মধ্যে লড়াইয়ের প্রভাব পড়ছে সীমান্তের এপারের জনগোষ্ঠীর মধ্যেও। যুদ্ধ শুরুর পর রোব ও সোমবার সবচেয়ে বড় অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটল।

২০২২ সালের অগাস্টের শেষ ও সেপ্টেম্বরের শুরুতে মিয়ানমারের যুদ্ধবিমান ও ফাইটিং হেলিকপ্টার থেকে বাংলাদেশের সীমানার ভেতর গোলাবর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল। অনেক মানুষ আতঙ্কে সীমান্ত ছেড়ে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিয়েছিল। তখন দেশটির রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছে এর প্রতিবাদ, নিন্দা ও উদ্বেগের কথা জানিয়েছিল ঢাকা।

·         জান্তা আমলে মিয়ানমারে মানবাধিকার পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে: ভলকার তুর্ক

·         বিদ্রোহী জোটের হামলায় বহু এলাকা হাতছাড়া, কোণঠাসা মিয়ানমার জান্তা

·         মিয়ানমারে পেরে উঠছে না জান্তা বাহিনী, সমর্থন হারাচ্ছেন মিন অং হ্লাইং

·         ভারতে পালাচ্ছে মিয়ানমারের সেনারা, উদ্বিগ্ন মিজোরাম

·         প্রত্যাবাসন: রাখাইন ঘুরে ‘উন্নতি’ দেখেছে আরআরআরসি, রোহিঙ্গারা হতাশ

·         জরুরি অবস্থার প্রস্তুতি নিতে নির্দেশনা মিয়ানমার জান্তা সরকারের

·         নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে এসে পড়ল ৩ মর্টার শেল

·         মিয়ানমারে যুদ্ধ: স্থল সীমান্তের পাশাপাশি নৌপথেও নিরাপত্তা জোরদার

·         ওপারের যুদ্ধে বিরান হচ্ছে এপারের বসতিও