নারীদের সংরক্ষিত আসনেও সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নির্বাচন করার সুপারিশও এসেছে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত এ কমিশনের তরফে।
Published : 19 Apr 2025, 08:20 PM
প্রতিটি সংসদীয় এলাকার জন্য একটি সাধারণ আসনের পাশাপাশি নারীদের জন্য একটি সংরক্ষিত আসন রেখে সংসদে মোট ৬০০ আসন করার সুপারিশ করেছে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন।
উভয় ক্ষেত্রে সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নির্বাচন করার সুপারিশও এসেছে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত এ কমিশনের তরফে।
কমিশন মনে করছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদে এ সুপারিশ বাস্তবায়ন সম্ভব।
শনিবার প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর সংবাদ সম্মেলনে কমিশনের প্রধান শিরীন পারভীন হক তাদের সুপারিশ তুলে ধরতে গিয়ে এসব কথা বলেন।
এ প্রতিবেদন হাতে পেয়ে প্রধান উপদেষ্টা এ কমিশনের যেসব সুপারিশ ‘তাৎক্ষণিকভাবে’ বাস্তবায়ন সম্ভব, সেগুলো দ্রুত কার্যকর করতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে নির্দেশ দেন।
কমিশন মোটা দাগে সংবিধান, আইন ও নারীর অধিকার–এ তিন বিষয়ে সুপারিশ করেছে, যেখানে সমতা ও সুরক্ষার ভিত্তি জোরালো করার কথা বলা হয়েছে। নারীর অগ্রগতির জন্য আছে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও জাতীয় সংস্থাগুলোর দক্ষতা বাড়ানোর সুপারিশও।
গত ১৮ নভেম্বর ‘নারীপক্ষ’র প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শিরীন পারভীন হককে প্রধান করে এ কমিশন গঠন করে।
এদিন প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন তুলে দেওয়ার পরে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলনে সুপারিশগুলো তুলে ধরার সময় ৬০০ আসনের প্রস্তাব করার ব্যাখ্যা তুলে ধরেন শিরীন পারভীন।
তিনি বলেন, "অনেকেই যখন শুনেছে আমরা ৬০০ আসনের প্রস্তাব করছি, অনেকেই বলেছেন বর্তমান সংসদ ভবনের মূল কক্ষ সেখানে নাকি ৬০০টি চেয়ার বসানো যাবে না। আমরা মনে করি সেটা কোনো কারণ না। জনসংখ্যার কথা যদি আমরা ভাবি, এই জনসংখ্যার জন্য এখন আর ৩০০ আসন মোটেই পর্যাপ্ত না। সুতরাং ৬০০ আসনের যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে।
“দরকার হলে ফোল্ডিং চেয়ার বসানো হবে। কিন্তু ৬০০ আসনের ব্যাপারটা আমাদের কাছে উদ্ভট না। কিন্তু অনেকে বলেছে, আপনাদের এটা উদ্ভট।
“আলোচনা হোক বিতর্ক হোক, দেখা যাক কী কী যুক্তি আসে। আমাদের যুক্তি হল, এই জনসংখ্যায় ৬০০ আসন খুব বেশি না। আমরা যদি সত্যি সত্যি চাই নারীরা আইনসভায় বসুক, আইন প্রণয়ন করুক তাহলে আমাদেরকে এটা মেনে নিতে হবে। আমরা মনে করি এটা একটা সুষ্ঠু ও ভালো প্রক্রিয়া তৈরি করবে রাজনীতির ক্ষেত্রে।”
সংবাদ সম্মেলনে কমিশন প্রধান শিরীন পারভীন বলেন, ৪৩টি সভা করে ৪৩৩টি সুপারিশ করা হয়েছে।
উল্লেখযোগ্য সুপারিশের মধ্যে আছে- জনপরিষদ ও পারিবারিক আইনে সকল বৈষম্য বিলুপ্ত করা; সংবিধানে মৌলিক অধিকার হিসেবে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা স্বাস্থ্য ও কর্মের স্বীকৃতি দেওয়া; নারীদের অধিকার লঙ্ঘন পর্যবেক্ষণ, তদারকি এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করতে স্বতন্ত্র স্থায়ী নারী বিষয়ক কমিশন প্রতিষ্ঠা করা; জাতিসংঘের 'নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ' সনদের ওপর অবশিষ্ট দুইটি সংরক্ষণ প্রত্যাহার এবং আইএলও সনদ সি১৮৯ ও সি১৯০ অনুস্বাক্ষর ও পূর্ণ বাস্তবায়ন করা।
এছাড়া ধর্ম, জাতি, শ্রেণি নির্বিশেষে সব নারী পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করতে অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রবর্তন করার সুপারিশ করেছে কমিশন, যা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ থেকে ঐচ্ছিকভাবে প্রযোজ্য করার সুপারিশ করা হয়েছে।
কমিশনের সুপারিশের মধ্যে রয়েছে- নারী উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সমন্বয় ও বাস্তবায়নের ভূমিকা শক্তিশালীকরণে নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং এর অধীন সংস্থাগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক পুনর্গঠন করা ও সব কর্মসূচি সুসংহত করা; প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের কর্মপরিধিতে নারী উন্নয়ন ও সমতা প্রতিষ্ঠায় দ্বায়িত্ব অন্তর্ভুক্ত করা, বার্ষিক কর্ম সম্পাদন চুক্তিতে জবাবদিহির ব্যবস্থা নেওয়া ও নারীপুরুষ সমতা বিষয়ক ইউনিট বা সেল প্রতিষ্ঠা করা; জেন্ডার সংবেদনশীল পরিকল্পনা প্রকল্প প্রণয়ন নির্দেশিকায় অন্তর্ভুক্ত করা এবং জেন্ডার বাজেটের ব্যয় পরিবীক্ষণ নিশ্চিত করা।
জাতীয় নির্বাচনের আগেই স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজনেরও সুপারিশ করেছে কমিশন। আর রাজনৈতিক ভিত্তিক স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচন রহিত করার জন্য পালিত করা হয়েছে।
স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে অন্তত এক তৃতীয়াংশ নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। পাহাড় ও সমতলের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রথাগত শাসনব্যবস্থা বলবৎ রাখা এবং হেডম্যান বা কারবারীদের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশও করা হয়েছে কমিশনের পক্ষ থেকে।
প্রতিটি জেলায় আক্রান্ত নারী সহায়তা কেন্দ্র (ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার), নারী সহায়তা ও তদন্ত বিভাগ, কাউন্সেলিং ব্যবস্থা, সাইবার অপরাধের ভুক্তভোগী সহায়তা এবং সব ভুক্তভোগীর জন্য পুনর্বাসন ব্যবস্থা চালু করা, আর্থিক ক্ষতিপূরণ ও প্রয়োজনীয় আশ্রয় নিশ্চিত করার সুপারিশ করেছে কমিশন।
কমিশন মনে করে, পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের মেয়াদে এ সুপারিশ বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।
নারী শিক্ষা নিয়ে একগুচ্ছ সুপারিশ করেছে কমিশন। এগুলোর মধ্যে আছে, শ্রম বাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং জীবনমুখী আধুনিক শিক্ষা প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করা এবং তাতে নারীর অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা; বাল্যবিবাহের শিকার মেয়েদের জন্য বিশেষ বিবেচনায় উপবৃত্তি বহাল রাখা ও যথাযথ কর্মসূচির মাধ্যমে তাদেরকে শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসা; ঝরে পড়া শিশুদের শিক্ষার আওতায় ফিরিয়ে আনা; সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বয়সের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ সমন্বিত যৌন শিক্ষা প্রদান নিশ্চিত করা; ঝুঁকিপূর্ণ ও দুর্গম এলাকার শিশুদের শিক্ষায় অংশগ্রহণ বৃদ্ধি ও ঝরে পড়া প্রতিরোধে শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসন ব্যবস্থা করা; সকল ধর্ম, জাতিসত্ত্বা ও বিভিন্ন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, জীবনধারা ও মূল্যবোধ সম্পর্কিত বিষয় পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা এবং বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য যথোপযুক্ত শিক্ষার ব্যবস্থা করা ও তাদের শিক্ষার মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত করা।
নারীদের সুস্বাস্থ্যের জন্য কমিশন মেয়েদের বিয়ের বয়স সর্বনিম্ন ১৮ বছর নিশ্চিত করে কৈশোরকালীন, অনাকাঙ্ক্ষিত ও ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভধারণ থেকে বিরত রাখার সুপারিশ করেছে।
এছাড়া অপ্রয়োজনে সিজারিয়ান অপারেশন নিয়ন্ত্রণে ২০২৩ সালের উচ্চ আদালতে নির্দেশনা কার্যকর করার সুপারিশ করা হয়েছে কমিশনের পক্ষ থেকে।
স্বতন্ত্র ও স্বাধীন নারী কমিশন গঠন কমিশনের অন্যতম প্রধান সুপারিশ হিসেবে তুলে ধরে কমিশন প্রধান শিরীন পারভীন হক বলেন, "আইন বা অধ্যাদেশ দ্বারা একটি স্বাধীন, স্বতন্ত্র ও স্থায়ী নারী কমিশন গঠন হবে। নারী-পুরুষ সমতা বিষয়ক নীতি ও কর্মসূচির পর্যালোচনা করে এ কমিশন প্রতিকার প্রস্তাব করবে। আর নারী অধিকার লঙ্ঘন ও অভিযোগের প্রতিকারমূলক প্রক্রিয়াগুলোর কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণ করবে। আর বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সাথে সংলাপ ও সংযোগ স্থাপন করবে।
অন্তর্বর্তী সরকার ২০২৪ সালের নভেম্বরে এ কমিশন গঠন করে। ডিসেম্বর থেকে কমিশন কাজ শুরু করে। কমিশনের মেয়াদ আছে আগামী ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত।
নারী কমিশনের 'কিছু' সুপারিশ দ্রুত কার্যকরের নির্দেশ প্রধান উপদেষ্টার