কুমিল্লার রাজনীতি বিশ্লেষক আহসানুল কবির এক কথায় বলছেন, “এই নির্বাচনে ভোটটি হচ্ছে এমপি বাহারের পক্ষে এবং বাহারের বিপক্ষে।”
Published : 08 Mar 2024, 11:06 PM
দুই ‘দলের’ প্রার্থীদের চতুর্মুখী লড়াই হতে যাচ্ছে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে মেয়র পদের উপনির্বাচনে; দলীয় প্রতীকবিহীন এই নির্বাচনে পাল্টে গেছে অতীতের সব হিসাব-নিকাশ।
সব প্রার্থীই বিজয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী হলেও, ভোটাররা এখনও নিশ্চিত না, শনিবার কে হচ্ছেন নগরীর প্রধান।
ভোটের হিসাব বলছে, দুই ‘দলের’ চার প্রার্থীর ভোট ‘কাটাকুটির’ নির্বাচন হতে যাচ্ছে কুমিল্লায়। উপনির্বাচন এখানে একেবারেই জমে ওঠেছে। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
ভোটের মাঠের তিন প্রার্থীই অভিযোগের আঙুল তুলেছেন কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আ ক ম বাহাউদ্দীন বাহারের বিরুদ্ধে; ভোটের লড়াইয়ে এবারই প্রথম নেমেছেন তার মেয়ে তাহসিন বাহার সূচনা।
বাস প্রতীকের এই প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন দুইবারের সাবেক মেয়র মনিরুল হক সাক্কু; দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে ২০২২ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপির পদ খোয়াতে হয়েছিল তাকে।
তাদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন কুমিল্লা মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি নিজাম উদ্দিন কায়সার এবং বাহারের নেতৃত্বাধীন কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটির উপদেষ্টা নূর-উর রহমান মাহমুদ তানিম।
২০২২ সালের ১৫ জুনের নির্বাচনে প্রথমবারের মতো নেমে ২৯ হাজারের বেশি ভোট পেয়ে সাড়া ফেলেছিলেন কায়সার। সেই নির্বাচনে জেতা আরফানুল হক রিফাতের মৃত্যুতে শূন্য হওয়া পদে শনিবার ভোট দেবে কুমিল্লা নগরবাসী।
রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, দুই রাজনৈতিক শিবিরের দুজন করে প্রার্থী হলেও ভোটের হিসাব-নিকাশে সূচনার বিরুদ্ধে কোনো না কোনোভাবে ‘এক’ হয়েছেন সবাই।
বিএনপি দলীয়ভাবে নেই, কিন্তু তাদের দুই প্রার্থী আছেন; আওয়ামী লীগের একই কমিটিরই দুই নেতা আছেন ভোটে। ভোট টানার ক্ষেত্রে এককভাবে কোনো প্রার্থীকে বিশেষভাবে দেখা যাচ্ছে না।
এমন পরিস্থিতিকে কুমিল্লার রাজনীতি বিশ্লেষক আহসানুল কবির এক কথায় বলছেন, “এই নির্বাচনে ভোটটি হচ্ছে এমপি বাহারের পক্ষে এবং বাহারের বিপক্ষে।”
মেয়র পদের উপনির্বাচনে সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত নগরীর ২৭টি ওয়ার্ডের ১০৫টি কেন্দ্রে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোটগ্রহণ করা হবে।
এবার মোট ভোটার সংখ্যা ২ লাখ ৪২ হাজার ৪৫৮। এর মধ্যে নারী ভোটার ১ লাখ ২৪ হাজার ২৭৪ ও পুরুষ ভোটার ১ লাখ ১৮ হাজার ১৮২ জন। তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার রয়েছেন দুইজন।
২৭টি ওয়ার্ডে ১০৫টি কেন্দ্র এবং ৬৪০টি ভোটকক্ষে দায়িত্ব পালন করবেন ১০৫ প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, ৬৪০ জন সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, এক হাজার ২৮০ জন পোলিং এজেন্ট।
আচরণবিধি প্রতিপালনে ২৭ জন ম্যাজিস্ট্রেট মাঠে থাকবেন, প্রতি তিন ওয়ার্ডে থাকবেন একজন করে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট। ১০৫ কেন্দ্রের নিরাপত্তায় ১২ প্লাটুনে ৪৫০ জন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।
র্যাব ২৭টি টিমে ৯৩৯ জন, পুলিশের ২৭ মোবাইল টিমে ১ হাজার ৩৩৯ জন এবং প্রতি তিন ওয়ার্ডে একটি করে পুলিশের মোট নয়টি স্ট্রাইকিং ফোর্স মাঠে থাকবে। এ ছাড়া দুটি থানার দুটি টিম রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে থাকবে।
মেয়ের প্রার্থিতার মধ্যে সংসদ সদস্য বাহারের কর্মী-সমর্থকরা ভোটকেন্দ্রে না যেতে হুমকি-ধামকি দিচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন প্রার্থীরা; কেন্দ্রে যাওয়া নিয়ে শঙ্কা ও দ্বিধা আছে ভোটারদেরও।
ভোটের যাওয়া নিয়ে শঙ্কার কথা জানিয়ে এর আগে ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটার হেনা বেগম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “ভোটকেন্দ্রে যাব কি-না, এ নিয়ে শঙ্কায় আছি। আমাদেরকে বিভিন্নভাবে বলা হচ্ছে যেখানেই ভোট দেন- পাস করবে একজনই।
“এ ছাড়া আরও বিভিন্ন হুমকি আছে। তবে আশা আছে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার। বাকিটা ভোটের দিনের পরিবেশের উপর নির্ভর করছে।”
ভোটের ঠিক আগ মুহূর্তে ঘরে ঘরে গিয়ে ভোটারদের ‘হুমকি’ দেওয়া হচ্ছে এমন অভিযোগ পেয়ে বিষয়টি ‘দেখার’ কথা জানিয়েছে নির্বাচন কমিশনও।
ভোটের একদিন আগে শুক্রবার উপনির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. ফরহাদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, “ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি দেওয়ার কিছু অভিযোগ এসেছে। আমরা এগুলো নিয়ে কাজ করছি। ভোটাররা যেন নির্বিঘ্নে কেন্দ্রে যেতে পারে সেই ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে।”
তবে কারা এই হুমকি দিচ্ছে এবং কেন দিচ্ছে এসব ব্যাপারে কিছু উল্লেখ না করে রিটার্নিং কর্মকর্তা বলেন, ভোট নিয়ে কোনো শঙ্কা নেই।
ভোটাদের মধ্যে আগ্রহ থাকলেও শঙ্কা রয়েছে মন্তব্য করে গবেষক আহসানুল কবির বলেন, “জাতীয় নির্বাচনের তুলনায় ভোটের মানুষের আগ্রহ ও ঔৎসুক্য আমরা লক্ষ্য করছি। তবে, জনগণের মধ্যে ভোট প্রদানের আগ্রহ এবং শঙ্কা দুটোই সমানভাবে কাজ করছে।”
ভোটের প্রচারের পুরো সময়ের মতো শেষদিনেও প্রার্থীরা একে অপরের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ আর পাল্টা অভিযোগ করেছেন।
ভোটারদের হুমকি-ধমকি দেওয়ার ক্ষেত্রে অভিযোগের তীর বেশি বাস প্রতীকের কর্মী-সমর্থক এবং প্রার্থীর বাবা সংসদ সদস্য বাহারের দিকে। তার বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘন এবং প্রভাব বিস্তারের পৃথক অভিযোগ গেছে নির্বাচন কমিশনেও।
এর মধ্যে আচরণবিধি লঙ্ঘন করে মেয়ের পক্ষে ভোট না চাইতে সংসদ সদস্য বাহারকে একবার চিঠি দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। প্রভাব-বিস্তারের অভিযোগটি খতিয়ে দেখার কথা বলেছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা।
মাঠে নেমে ভোট চাওয়ার ক্ষেত্রে ইসির নির্দেশনা মেনে চললেও ভোটের প্রচারের মধ্যে বেশ কয়েকটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন সংসদ সদস্য বাহার। চতুর্থবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ায় তাকে এসব সংবর্ধনা দেয় বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন।
তবে অন্য প্রার্থীদের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বাস প্রতীকের প্রার্থী তাহসীন বাহার সূচনা বলছেন, নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশকে ‘বিতর্কিত’ করার জন্য এসব অভিযোগ করা হচ্ছে।
‘কাটাকুটির’ ভোট
মাত্র দেড় বছর আগে এই সিটি করপোরেশনের তৃতীয় নির্বাচনের মেয়র পদের জয়-পরাজয়ের ফয়সালা হয়েছিল মাত্র ৩৪৩ ভোটের ব্যবধানে।
প্রার্থিতার বিবেচনায় সব পক্ষই মাঠে আছে। এবার বিশেষত্ব হচ্ছে, আওয়ামী লীগের দুই নেতা মাঠে আছেন। গত নির্বাচনের নৌকার ভোট ভাগ হবে বলে মনে করছেন ভোটাররা।
আর গত নির্বাচনে বিএনপি নেতারা আড়ালে-আবডালে থেকে নির্বাচনে সমর্থন যুগিয়েছিলেন; এবার শত শত নেতাকর্মী দলটির বহিষ্কৃত দুই নেতাকে জেতাতে মরিয়া হয়ে ওঠেছেন।
বিএনপির ভোট আগে থেকেই ভাগ হয়ে আছে। ২০২২ সালের নির্বাচনে দুইবারের সাবেক মেয়র মনিরুল হক সাক্কু আওয়ামী লীগ নেতা আরফানুল হকের কাছে শতিনেক ভোটে হেরেছিলেন। সেই নির্বাচনে প্রথমবার এসেই নিজাম উদ্দিন কায়সার ২৯ হাজারের বেশি ভোট পেয়েছিলেন। বিএনপিপন্থি এই দুই নেতার ভোট বিজয়ী আওয়ামী লীগ নেতার ভোটের চাইতে ২৮ হাজারের বেশি ছিল। এবার ভোট কোনদিকে ঝুঁকবে- সেই অংক কষছেন সাক্কু ও কায়সার।
তানিম ২০১২ সালের প্রথম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট করেছিলেন। তখন তিনি বাহার পক্ষের লোক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি মোট ভোট পেয়েছিলেন আট হাজারের বেশি।
সেই নির্বাচনে বেশ বড় ব্যবধানেই হেরেছিলেন কুমিল্লা আওয়ামী লীগের আরেক প্রভাবশালী নেতা অধ্যক্ষ আফজল খান। জিতেছিলেন বিএনপি নেতা মনিরুল হক সাক্কু। নির্বাচনের পরে পরাজয়ের জন্য আফজল খান তার দলীয় প্রতিপক্ষ বাহারের বিরোধিতাকে দায়ী করেছিলেন।
আফজল খান আর বাহাউদ্দিন বাহারের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব কুমিল্লার রাজনীতিতে বহুল চর্চিত বিষয়। এই দুই নেতার দ্বন্দ্বের সুবিধা নির্বাচনে সবসময় বিরোধী পক্ষ পেয়েছে।
পরের নির্বাচনেও নৌকা নিয়ে হেরে যান আফজল খানের মেয়ে আঞ্জুম সুলতানা সীমা। তখনও বাহারের অনুসারীদের বিরোধিতাকে পরাজয়ের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন সীমা।
পরে অবশ্য তিনি সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। বিগত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সীমা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীকের বাহারের বিরুদ্ধে নির্বাচন করে পরাজিত হন।
ছেলে মাসুদ পারভেজ ইমরান মারা যাওয়ার পর প্রয়াত আফজল খানের অনুসারীরা বেশ খানিকটা কোণঠাসা। কুমিল্লা মহানগরীর সবচেয়ে গুরুত্বূপর্ণ একটি নির্বাচনে এই পরিবারের অনুসারীদের নিরব থাকতেই দেখা গেছে। কিন্তু তারা তো ভোট দিতে যাবেন! তাদের ভোট কোনদিকে যাবে?
কুমিল্লার রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, আফজল অনুসারীরা বাহারের মেয়ে বাস প্রতীকের প্রার্থী তাহসীন বাহার সূচনাকে ভোট দেবেন না। তবে, তার বাইরে যেই প্রার্থীর জেতার সম্ভাবনা বেশি তাকেই সমর্থন দেবেন ওই পরিবারের নেতারা।
বিগত নির্বাচনে কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক হাজী আমিন উর রশিদ ইয়াছিলেন শ্যালক নাজিম উদ্দিন কায়সার ২৯ হাজার ভোট পেয়েছিলেন। অনেকে বলার চেষ্টা করেন, এর মধ্যে আফজল খানের অনুসারীদের ভোটও আছে। যদিও কায়সার সবসসয় সেটা নাকচ করে দিয়েছেন।
এবার ঘোড়া প্রতীকের প্রার্থী কায়সারের পক্ষে প্রচুর বিএনপি নেতাকর্মীদের নামতে দেখা গেছে। তিনি বলছেন, তিনি নিজেই বিএনপি-সমর্থকদের প্রার্থী। তিনি বিএনপির ভোট কাটতে যাবেন কেন? তিনিই বিএনপি, সাক্কু সাবেক।
কায়সারের ভোট বাড়বাড়ন্ত হলে সাক্কুর কুমিল্লা পুনরুদ্ধার কঠিন এক বাস্তবতার মধ্যে পড়বে। যেটা গত নির্বাচনে বেশ বোঝা গেছে। যদিও কায়সারের অনুসারীরা শতভাগ নিশ্চিত তারাই কুমিল্লা জয় করবেন। সেটা হলেও সাক্কু কায়সারের সামনে বিরাট এক প্রতিপক্ষ।
আরও পড়ুন: