কানাডা অভিবাসনের টুকিটাকি ২৯: স্কলারশিপ পেলেই কি বিদেশে যাবেন!

ভবিষ্যতে কানাডায় অভিবাসন চান, অথচ অন্য কোনও দেশে স্কলারশিপসহ পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছেন। যাওয়া ঠিক হবে? যদি যেতেই চান- তবে কী কী বিষয় বিবেচনায় নেওয়া উচিত?

এম এল গনিএম এল গনি
Published : 31 Oct 2022, 02:44 PM
Updated : 31 Oct 2022, 02:44 PM

জার্মানি থেকে বাংলাদেশি এক যুবক কিছুদিন আগে আমার সাথে কথা বললেন। উদ্দেশ্য, পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট বা পিআর হিসেবে কিভাবে কানাডায় আসা যায়? এ লেখার প্রয়োজনে যুবকের নাম দিলাম, প্রান্ত।

তার আগ্রহ শুনে আমি জানতে চাইলাম, “প্রান্ত, কানাডায় যদি পিআর এর আবেদনই করবেন, তবে জার্মানি গেলেন কেন? ওদেশে পিআর পাওয়া যায় না?”

উত্তরে তিনি বললেন, “কাহিনী একটু দীর্ঘ। চার বছর আগের কথা। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা বিষয়ে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। অনেকদিন ধরেই বিভিন্ন দেশে পড়াশোনার চেষ্টা করছিলাম। হঠাৎ জার্মানি থেকে বৃত্তিসহ ভর্তির সুযোগ পেলাম। সে সুযোগ কাজে লাগাতেই আমার জার্মানি আসা।”

জার্মানির পড়াশোনা শেষ করেছেন কিনা- আমার এ প্রশ্নের উত্তরে প্রান্ত বললেন, “জ্বি, পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করছি বছর দেড়েক হলো।”

- তারপর আপনার পরিকল্পনা কী?

তিনি বললেন, “জার্মানিতে স্থায়ী অভিবাসনের (পিআর স্ট্যাটাস) আবেদনের চিন্তা মাথায়। তবে, তা আমাকে দিয়ে হয়ে উঠবে মনে হয় না।”

সমস্যা কোথায় জানতে চাইলে প্রান্ত বললেন, “মূল সমস্যা ভাষায়। অর্থাৎ, জার্মানিতে পিআর পেতে হলে জার্মান ভাষার পরীক্ষায় যে ফলাফল করতে হয় তা আমাদের ব্যাকগ্রাউন্ডের লোকদের জন্য খুব কঠিন।”

:আপনাদের মতো ব্যাকগ্রাউন্ড বলতে কী বোঝাচ্ছেন”, জানতে চাইলাম।

“মানে, যারা ছোটবেলা হতে জার্মান ভাষার সাথে পরিচিত নন তাদের কথা বলছি। আমরা তো ছোটবেলা থেকে বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষার সাথে পরিচিত, জার্মান ভাষার সাথে নয়”, ওপাশ থেকে উত্তর দিলেন প্রান্ত।

- তাহলে, শুরুতেই আইইএলটিএস পরীক্ষা দিয়ে কেন ইংরেজি ভাষাভাষী দেশে গেলেন না?

 - ঠিক বলেছেন, সেটাই ভালো হতো। প্রথমবারে না পারলেও কয়েকবার আইইএলটিএস দিয়ে একটা ভালোমানের স্কোর তোলা অসম্ভব হতো না। সেভাবে চেষ্টা করলেই পারতাম। কিন্তু, স্কলারশিপসহ জার্মানিতে পড়াশোনার সুযোগ পেয়ে অতো হিসাব-নিকাশ আর করিনি। এখন মনে হচ্ছে বৃত্তির লোভে একটা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম তখন…

এ আলোচনা থেকে কী বোঝা গেল?

আমি যা বুঝেছি তা হলো, স্কলারশিপ পেলেই দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ভোঁ দৌঁড় দেওয়া বোকামো। আপনাকে প্রথমেই ভাবতে হবে, কোথায় যাচ্ছেন, কেন যাচ্ছেন, দীর্ঘমেয়াদে এ বিদেশি পড়াশোনা থেকে আপনার অর্জন কতখানি, বা বিদেশে স্থায়ী হতে চাইলে আপনার এ পড়াশোনা বা সময় ব্যয় কতটা সুফল দেবে, বা আদৌ দেবে কিনা?

প্রান্ত (ছদ্মনাম) নামের এ তরুণের জীবনের প্রায় চার বছর জার্মানিতে কেটেছে। আর, এই বৃত্তির সুযোগ কাজে লাগাতে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার দুটো মূল্যবান বছরও তাকে জলাঞ্জলি দিতে হয়েছে। সব মিলে প্রায় অর্ধযুগ এ অনিশ্চিত যাত্রায় তিনি ব্যয় করেছেন। এর ফলাফল হয়েছে এটুকুই, জার্মানিতে যে সহজে স্থায়ী হওয়া যায় না সে বিষয়টি ভালোভাবে বুঝতে পারা।

এ লেখায় জার্মানির নাম এলেও পৃথিবীর আরো অনেক দেশে আমাদের ভাইবোন বা সন্তানরা পড়াশোনা করতে যায় খুব বেশি চিন্তাভাবনা না করেই। দেশ ছাড়ার আগে এদের অনেকেই পড়াশোনা শেষের পর কী ধরনের বাস্তবতার মুখোমুখি হতে পারেন তা নিয়ে খুব বেশি চিন্তাভাবনা বা পরিকল্পনা করেন না অনেকেই। যে সব প্রার্থীর দেশে ফিরে যাবার বিশেষ আগ্রহ থাকে তাদের ক্ষেত্রে বিদেশে পড়াশোনার পর খুব দীর্ঘ পরিকল্পনা না থাকলেও সমস্যা নেই। কিন্তু যারা চিন্তা করেন পড়াশোনার পর নিজেকে নতুন দেশটিতে প্রতিষ্ঠিত করবেন তাদের ক্ষেত্রে পূর্ব-পরিকল্পনা না হলেই নয়।

নিজেদের একটা দৃষ্টান্ত দেই। আমরা স্বামী-স্ত্রী দুজনই একসময় নেদারল্যান্ডস-এ ছিলাম কিছুদিন। বাংলাদেশ সরকারের চাকরি থেকে সেদেশের সরকারের খরচে পড়াশোনা করতে গিয়েছিলাম। সঙ্গত কারণেই, আমাদের মাথায় ছিল দুজনের সরকারি চাকরি ছেড়ে কোনদিন বিদেশে পাড়ি জমাবো না। কিন্তু, নেদারল্যান্ডস এর আইনশৃঙ্খলা, মানুষের স্বভাবচরিত্র, সরকারি কর্মচারীদের সততা, বাকস্বাধীনতা, নির্মল পরিবেশ, ইত্যাদি দেখে এতোটাই অভিভূত হয়ে পড়ি যে নেদারল্যান্ডস থেকে দেশে ফিরেই আমরা প্রথম বিশ্বের দেশ কানাডায় অভিবাসনের (পিআর স্ট্যাটাস) আবেদন করি। সেই সূত্রেই আমরা আজ একুশ বছর ধরে কানাডায়।

আমাদের ব্যক্তিগত কাহিনী এখানে উল্লেখের কারণ এটা বোঝাতে যে, অপেক্ষাকৃত উন্নত পরিবেশে দীর্ঘসময়ের জন্য বসবাসের সুযোগ হলে অনেকক্ষেত্রে পূর্ব-পরিকল্পনা না থাকা সত্ত্বেও উন্নতদেশে জীবনযাপনের চিন্তা মাথায় চলে আসে। আমাদের আগেও হাজারো বাংলাদেশি এমন ঘটনা ঘটিয়েছেন।

কানাডা অভিবাসন বিষয়ে কিছু কথা বলে এ লেখা শেষ করি।

কানাডায় অভিবাসন নিয়ে যদি থিতু হওয়ার পরিকল্পনা যদি থাকে, তবে অন্যকোনও দেশে পড়াশোনার বৃত্তি পেয়েছেন বলে তড়িঘড়ি পাড়ি না জমানোর পরামর্শই দিবো। তার চেয়ে বরং কয়েকবার আইইএলটিএস পরীক্ষা দিয়ে হলেও কানাডায় কিভাবে প্রবেশ করা যায় সে চেষ্টা করুন।

সাধারণভাবে বলা যায়, কানাডা অভিবাসন আবেদনকারীর সম্মিলিত পয়েন্টের ভিত্তিতে হয়ে থাকে। বয়স, শিক্ষাগত যোগ্যতা, কাজের অভিজ্ঞতা, ভাষার দক্ষতা ইত্যাদি বিভিন্ন ক্যাটাগরি থেকে এই পয়েন্টগুলো হিসাব করা হয়। সঙ্গত কারণেই, কানাডা অভিবাসনে বয়স একটা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর বা উপাদান।

ভিন্ন দেশে পড়াশোনার জন্য কয়েকবছর কাটিয়ে দিলে বয়স বেড়ে যাওয়ায় আপনার পয়েন্ট কমে যাবে। এছাড়া, কানাডায় পড়াশোনা বা, কাজ করলে আপনি যে বাড়তি কিছু পয়েন্ট পেতেন ভিন্ন দেশে পড়াশোনা বা কাজ করে এলে তা পাবেন না। সর্বোপরি, ইংরেজি ভাষাভাষীর দেশ কানাডায় পড়াশোনা বা কাজের সুবাদে কয়েকবছর বসবাস করলে আপনার আইইএলটিএস স্কোরও বেড়ে যাবার উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে।

এভাবে নানা আঙ্গিকে বিবেচনায় কানাডায় যাদের স্থায়ী হবার আগ্রহ তাদের উচিত হবে বৃত্তি পান বা না পান, পড়াশোনার জন্য কানাডাকেই প্রথমে বেছে নেওয়া। তাতেই কানাডা ইমিগ্রেশনের পয়েন্ট বৃদ্ধির অনুকূলে আপনার সময়, অর্থ ও শ্রমের সদ্ব্যবহার হবে।

যাক, এ লেখা আর দীর্ঘ না করি। কানাডায় পড়াশোনা, বা অভিবাসন বিষয়ে কোনও বিশেষ প্রশ্ন থাকলে আমাকে নিচের ইমেইলে জানাতে পারেন। পরের কোনও লেখায় আপনার আগ্রহের প্রতিফলন ঘটানোর প্রয়াস থাকবে।

তবে, বর্তমান পর্বসহ এ সিরিজের অন্য পর্বগুলোতে কানাডা ইমিগ্রেশন বিষয়ে যে সাধারণ আলোচনা করা হয়েছে তা যেন কোনভাবেই আইনি পরামর্শ হিসেবে বিবেচনা করা না হয়। কেননা, সুনির্দিষ্ট আইনি পরামর্শ দেওয়া হয় ব্যক্তিগত সাক্ষাতে, সাধারণ আলোচনায় নয়।

এছাড়া, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম- এ নিয়মিত চোখ রাখুন কানাডা অভিবাসন নিয়ে আমার নতুন নতুন লেখা পড়তে। ভবিষ্যতে আপনাদের সাথে আরো অনেক মূল্যবান তথ্য সহভাগের প্রত্যাশা নিয়ে আজ এখানেই শেষ করি।

[পুনশ্চ: কাউকে জার্মানি যেতে নিরুৎসাহিত করা এ লেখার লক্ষ্য নয়। উদাহরণ হিসেবে জার্মানির নাম এসেছে কেবল।]

লেখক: কানাডীয় ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট, আরসিআইসি।

ইমেইল: info@mlgimmigration.com; / ফেইসবুক: ML Gani

এ লেখকের অন্যান্য লেখা:

কানাডা অভিবাসনের টুকিটাকি- ০১: ইংরেজি ভাষার গুরুত্ব  

কানাডা অভিবাসনের টুকিটাকি-০২: চিকিৎসা বিদ্যার কদর এবং ভর্তির যোগ্যতা  

কানাডা অভিবাসনের টুকিটাকি-০৩: কনসালটেন্ট কতটা জরুরি?  

কানাডা অভিবাসনের টুকিটাকি- ০৪: ‘স্কুলিং ভিসা’য় আপনি নিজেও কি কানাডায় যেতে পারেন?  

কানাডা অভিবাসনের টুকিটাকি- ০৫: বয়স্করা কেন, কিভাবে কানাডায় পড়তে যাবেন?  

কানাডা অভিবাসনের টুকিটাকি- ০৬: আপনার কানাডিয়ান জব অফার ঠিক আছে তো?  

কানাডা অভিবাসনের টুকিটাকি- ০৭: বিয়ে করে কানাডা যেতে চান?  

কানাডা অভিবাসনের টুকিটাকি-০৮: কানাডায় পড়াশোনার সিদ্ধান্ত নিতে কী কী বিবেচনায় রাখবেন?  

কানাডা অভিবাসনের টুকিটাকি ০৯: আপনি কি বাস্তবেই ‘কমন ল' সম্পর্কে আছেন?  

কানাডা অভিবাসনের টুকিটাকি ১০: আপনাকে কানাডায় প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না?  

কানাডা অভিবাসনের টুকিটাকি ১১: একজন কানাডিয়ান কাকে কানাডায় স্পনসর করতে পারেন, কাকে পারেন না?  

কানাডা অভিবাসনের টুকিটাকি ১২: আপনি কি সরাসরি কানাডার সিটিজেন হবার আবেদন দাখিল করতে পারেন?  

কানাডা অভিবাসনের টুকিটাকি ১৩: কানাডার ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে যেটুকু না জানলেই নয়   

কানাডা অভিবাসনের টুকিটাকি ১৪: দ্বৈত অভিপ্রায় নিয়ে কি কানাডায় যাওয়া যায়?  

কানাডা অভিবাসনের টুকিটাকি ১৫: কানাডা ভ্রমণ বা ইমিগ্রেশনে ভুল তথ্য উপস্থাপন কতটা মারাত্মক হতে পারে?  

কানাডা অভিবাসনের টুকিটাকি ১৬: ইমিগ্রেশন কন্সাল্টেন্সির নামে একটি প্রতারণার কাহিনী  

কানাডা অভিবাসনের টুকিটাকি ১৭: স্ত্রীকে নির্যাতনের শেষ ফল কী?  

কানাডা অভিবাসনের টুকিটাকি ১৮: শিক্ষার্থী ভিসা নিয়ে যা জানতে হবে  

কানাডা অভিবাসনের টুকিটাকি ১৯: কানাডার পিআর স্ট্যাটাস কি আসলেই স্থায়ী?  

কানাডা অভিবাসনের টুকিটাকি ২০: শরণার্থী হিসেবে অভিবাসন আবেদনে করণীয়  

কানাডা অভিবাসনের টুকিটাকি ২১: স্টাডি পারমিট বা স্টুডেন্ট ভিসা আবেদন কেন প্রত্যাখ্যাত হয়?  

কানাডা অভিবাসনের টুকিটাকি ২২: কনসালটেন্ট এর এজেন্ট কি ইমিগ্রেশন সেবার চুক্তি করতে পারে?  

কানাডা অভিবাসনের টুকিটাকি ২৩: বড় ডিগ্রি যেভাবে লক্ষ্য অর্জনের পথে বাধা  

কানাডা অভিবাসনের টুকিটাকি ২৪: কত দামের বাড়ি কিনলে কানাডার পিআর পাওয়া যায়?  

কানাডা অভিবাসনের টুকিটাকি ২৫: এলএমআইএ কী এবং কিভাবে পাওয়া যায়?  

কানাডা অভিবাসনের টুকিটাকি ২৬: ইমিগ্রেশন এজেন্টের ভুলে আপনি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন কি?  

কানাডা অভিবাসনের টুকিটাকি ২৭: ‘কনসালটেন্ট’ ভেবে এজেন্টের পাল্লায় পড়েননি তো?

কানাডা অভিবাসনের টুকিটাকি ২৮: 'এক্সপ্রেস এন্ট্রি' মানে কি বর্ধিত ফি'তে এক্সপ্রেস সার্ভিস?