কানাডা অভিবাসনের টুকিটাকি ২১: স্টাডি পারমিট বা স্টুডেন্ট ভিসা আবেদন কেন প্রত্যাখ্যাত হয়?

ছোট্ট একটি কাহিনী দিয়ে লেখা শুরু করি। দেশ থেকে এক ভদ্রলোক ফোন করলেন তার মেয়ের রিফিউজ্ড বা প্রত্যাখ্যাত স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে সহায়তা দিতে পারবো কিনা জানার জন্য। স্বভাবতই জানতে চাইলাম, প্রথম আবেদন সে নিজে করেছে না কোন কনসালটেন্টের মাধ্যমে করেছে?

এম এল গনি, কানাডা থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 July 2021, 04:48 PM
Updated : 11 July 2021, 04:48 PM

'নিজে করেছে।' - ভদ্রলোক উত্তের দিলেন।

'প্রত্যাখ্যানের কারণ জানিয়ে কানাডা থেকে কোন চিঠি পেয়েছেন?'

'জি, পেয়েছি।'

'ওখানে কারণ কী লেখা আছে?' 

'বেশ কয়েকটা, সব মনে নেই।'

'ঠিক আছে, প্রথমেই কনসালটেন্টের শরণাপন্ন হলেন না কেন জানতে পারি? প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় এখন তো কাজ অনেক বেড়ে গেল।'- তার কাছে জানতে চাইলাম।

'ভাই, কী আর বলবো! এর পেছনে আরেকটা কারণ আছে। ওর এক ক্লাসমেট নিজে নিজে আবেদন করে ভিসা পেয়ে গেছে। তার সাথে পরামর্শ করে আমার মেয়ে আবেদন করেছে। কিন্তু, তারটা হলো না। পরে অবশ্য জানতে পেরেছি ওর বান্ধবী আসলে কনসালটেন্টের মাধ্যমে আবেদন করেছিল। কিন্তু, আমার মেয়েকে সে সত্য কথা বলেনি।'

'ওহ তাই? দুঃখজনক বটে! যাই হোক, ওর প্রথমবারে দাখিল করা আবেদনের একটা কপি আর প্রত্যাখানের চিঠিটা আমাকে ইমেইল করেন। আগে একটু দেখি পুনরায় আবেদনে আপনার লাভ হবে কিনা। '

অন্যকে মিসগাউড বা ভুলপথে পরিচালিত করার ঘটনা কিন্তু আমাদের দেশে এই প্রথম নয়; মাঝেমাঝেই এমন কাহিনী শোনা যায়। সম্ভবত এ কারণেই অন্যের সফলতায় ঈর্ষান্বিত হওয়া বা, অন্যকে বিপদে ফেলে আনন্দ পাবার মতো একটা বাজে স্বভাব আমাদের বাঙালি সমাজের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলে জনশ্রুতি রয়েছে। পরিতাপের বিষয়, আমাদের বড়োদের দেখাদেখি স্কুলবয়সী শিশুরা পর্যন্ত এ ধরনের কুচর্চায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে।

এবার বর্তমান লেখার বক্ষমূলে চলে যাই। কী কী কারণে ভিসা অফিসার একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর স্টাডি পারমিটের আবেদন প্রত্যাখ্যান করে থাকেন? এ প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট কোন উত্তর না থাকলেও ইমিগ্রেশন পরামর্শক হিসেবে অভিজ্ঞতালব্ধ কিছু বিষয় বা পর্যবেক্ষণ পাঠকের সাথে সহভাগ করতে চাই যাতে এ বিষয়ে মোটামুটি একটা ধারণা পাওয়া যায়।  এতে আপনি নিজে আবেদন করুন, বা কনসালটেন্ট দিয়ে করুন, সার্বিক বিষয়টা বুঝতে সুবিধা হবে।

ধরলাম, আপনার দায়ের করা আবেদনটি এমন যে এটি খানিক নমনীয়ভাবে বিবেচনা করলে অনুমোদন দেওয়া যায়, আবার একটু ক্রিটিক্যাল হলে প্রত্যাখ্যানও করা যায়। এমনক্ষেত্রে, কেমন ধরনের ভিসা অফিসারের হাতে আপনার আবেদনটি পড়েছে তার ওপরই আপনার ভাগ্য ঝুলে থাকছে। তারমানে, সিদ্ধান্ত দুদিকেই যেতে পারে। প্রত্যাখ্যাত আবেদনের ফাইল দ্বিতীয় একজন ভিসা অফিসারের হাতে যায় সিদ্ধান্ত কনফার্ম বা নিশ্চিত করার জন্য। বড়ো ধরনের হেরফের না দেখলে দ্বিতীয় অফিসার সাধারণত প্রথম অফিসারের সাথে মতৈক্য পোষণ করেন। তাহলে বোঝা গেল, বিশেষ অবস্থার কিছু ফাইল অনুমোদন হবে কি হবে না তা একান্তই ভিসা অফিসারের মর্জির ওপর। বলার অপেক্ষা রাখে না, স্টাডি পারমিটের আবেদনে আপনার উপযুক্ততা যথাযথভাবে ফুটিয়ে তুলে আপনি এক্ষেত্রে ভিসা অফিসারের বাড়তি নজর পাবার প্রচেষ্টা চালাতে পারেন।

কানাডায় প্রতিবছর কয়েক লাখ বিদেশি ছাত্র-ছাত্রী পড়াশোনা করতে আসে। এতো বিপুল সংখ্যক আবেদন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখা ভিসা অফিসারদের জন্য সত্যিই কষ্টের। তাই, তারা এক্ষেত্রে এআই, বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ব্যাপক ব্যবহার করেন বলে আমরা শুনেছি। এআই কিভাবে কাজ করে? এটা একটা কম্পিউটার প্রোগ্রাম যা নির্দিষ্ট অ্যালগরিদমের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়।

এ প্রোগ্রাম কিছু 'কী ওয়ার্ড' বিবেচনায় রেখে আবেদনে দাখিলকৃত বিভিন্ন কাগজপত্র সার্চ করে বিভিন্ন শর্ত ও ইমিগ্রেশন বিষয়ক নিয়মাবলীর সাথে তা তুলনা করে একটা সিদ্ধান্ত ভিসা অফিসারের সামনে তুলে ধরে। ভিসা অফিসার তার কাজের চাপ বিবেচনায় এনে কয়েক সেকেন্ড বা মিনিট ফাইলে চোখ বুলিয়ে একটা সিদ্ধান্ত লিখে স্বাক্ষর করে দেন। এবার বুঝুন, আপনার আবেদনের মূল্যায়ন কতখানি মানবিক ও গ্রহণযোগ্য হয়েছে বা হয়নি? এলগরিদম যতই উন্নতমানের হোক কম্পিউটার প্রোগ্রাম কি মানুষের মগজের প্রতিস্থাপক হতে পারে? অবশ্যই না। কিন্তু, আধুনিক বিশ্বে এআই ব্যবস্থাপনার উপর নির্ভর না করে উপায়ও বা কি? কাজে গতি আনতে এর বিকল্প নেই।

আমরা এও শুনেছি, প্রতিটি দেশ বা মহাদেশের জন্য একটা কোটা থাকে। কারণ, কানাডা চায় সেদেশের মাল্টিকালচারাল রূপটা ধরে রাখতে। ধরা যাক, কানাডা সামনের বছর বাংলাদেশ থেকে সর্বোচ্চ তিন হাজার শিক্ষার্থীকে কানাডায় পড়ার সুযোগ দেবে। আবেদনকারী তো অসংখ্য!

অনুমোদিত আবেদনের সংখ্যার হিসেব ডাটাবেইজে রেকর্ড হতে থাকে। তাই, তিন হাজারের কাছাকছি হয়ে গেলে তারা ফাইল খুব কড়াকড়িভাবে দেখেন। কারণ, তখন মূল উদ্দেশ্যই থাকে আবেদন প্রত্যাখ্যান করা। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম, ধরুন এক শিক্ষার্থী অংকে আটাশ নম্বর পেয়েছে যেখানে পাশ নম্বর তেত্রিশ। এক্ষেত্রে পরীক্ষক উপায় খুঁজতে থাকেন কিভাবে আর পাঁচটা নম্বর যোগ করে তাকে পাশ করিয়ে দেওয়া যায়। অপরদিকে, কোন ছাত্র যখন একশ-তে একশই পেয়ে যায় তখন পরীক্ষক ভালোমতো পরীক্ষা করেন যেন তাকে কোনভাবে দুটো নম্বর কমিয়ে দেয়া যায়। কারণ, অনেক শিক্ষক মনে করেন শতভাগ নম্বর অর্জন করে নিজেকে শতভাগ জ্ঞানী মনে করে এই শিক্ষার্থী অতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে ভবিষ্যতে পড়ালেখায় অমনোযোগী হয়ে পড়তে পারে। মানুষের মন বলে কথা!

এমনও শুনেছি, কিছু ভিসা অফিসার প্রথমবার প্রত্যাখ্যান করে দেখতে চান, আবেদনকারী কানাডায় পড়াশোনার ব্যাপারে আসলে কতটা সিরিয়াস বা আগ্রহী? তারা মনে করেন, খুব বেশি আগ্রহী হলে এ শিক্ষার্থী নিশ্চয়ই আরেকবার আবেদন করতে পিছপা হবে না। অবিশ্বাস্য হলেও এ যুক্তি কিন্তু ভিত্তিহীন বলা চলে না। আমরা নিজেরাও দেখেছি, কোন কোন ছাত্র কানাডায় পড়াশোনার জন্য আবেদন দাখিল করলেও কানাডায় পড়াশোনার ব্যাপারে যে নাছোড়বান্দা তা কিন্তু নয়। এ বিবেচনায় প্রথমবার প্রত্যাখ্যাত হলে বেশি দেরি না করে আরো অন্তত এক বা দুইবার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া উচিত। এ চেষ্টা হতে পারে দুইভাবে।

এক. রিসাবমিশন বা পুনঃ আবেদন।

দুই. জুডিশিয়াল রিভিউ'র আবেদন।

কোন পদ্ধতিতে আপনি আগাবেন তা নির্ভর করছে প্রথম আবেদনটা আপনি কিভাবে দাখিল করেছেন সেটির উপর।

রিসাবমিশনের ক্ষেত্রে আপনি নতুন ডকুমেন্ট বা নতুন কোন তথ্য থাকলে তা যোগ করে আপনার আবেদন সমৃদ্ধ করতে পারেন। একইসাথে, পূর্বের প্রত্যাখ্যানের কারণগুলোর যথাযথ উত্তরও দিতে পারেন।

অপরদিকে, জুডিশিয়াল রিভিউ এর ক্ষেত্রে নতুন কোন তথ্য দেওয়া যায় না, কেবল, ভিসা অফিসার কর্তৃক পূর্বের প্রত্যাখ্যানের কারণগুলো যুক্তি-তর্ক দিয়ে কানাডার ফেডারেল কোর্টে ভিসা অফিসারের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করা যায়। রিসাবমিশন বা জুডিশিয়াল রিভিউ'র ক্ষেত্রে যুক্তি তর্কের সাথে আগের বিভিন্ন কেইস ল বা, ফেডারেল কোর্ট কেইসের রেফারেন্স যোগ করলে আবেদন অনেক শক্তসমর্থ হয়। আপনি নিজেও একাজটি করতে পারেন, তবে, এসবক্ষেত্রে একজন ইমিগ্রেশন প্রফেশনাল অনেক বেশি পারদর্শিতার সাথে কাজটি করতে পারবে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। আমাদের কোম্পানি, 'এমএলজি ইমিগ্রেশন' ইতোমধ্যেই এ ধরনের কয়েকটি রিফিউজাল সম্পর্কিত কাজ সফলতার সাথে সম্পন্ন করেছে।

আমাদের জানামতে, বাংলাদেশের স্টুডেন্ট ভিসার আবেদন অনুমোদনের হার সম্প্রতি গড়ে চল্লিশ শতাংশের কাছাকাছি। অর্থাৎ, ধরে নিতে পারেন, গড়ে প্রতি পাঁচটি আবেদনে দুইটি অনুমোদন পায়। ভালোমানের রিসাবমিশন বা জুডিশিয়াল রিভিউতে গেলে অনুমোদনের  এ হার আশি শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। অন্তত আমাদের অভিজ্ঞতা তাই বলে। কোন অবস্থাতেই শতভাগ অনুমোদনের নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না।

উপরের আলোচনা হতে আশা করি বুঝেছেন স্টাডি পারমিটের আবেদন অনুমোদনের সিদ্ধান্ত যে সদাসর্বদা বস্তুনিষ্ঠ হয় তা হলফ করে বলা যায় না। এ কারণেই, একই ধরনের ফাইল এক অফিসারের হাতে প্রত্যাখ্যাত কিন্তু অন্য আরেকজনের হাতে অনুমোদন পেয়ে যায়।

পুনঃআবেদন বা, জুডিশিয়াল রিভিউতে আপনার অতিরিক্ত কিছু অর্থ খরচ হতে পারে। তারপরও, কানাডার পাবলিক রেজিস্টারে নাম অন্তর্ভুক্ত আছে তেমন কোন পরামর্শক (লিংক: https://secure.iccrc-crcic.ca/search-new/EN) আপনার কাগজপত্র দেখে পুনঃআবেদনের পরামর্শ দিলে সে পরামর্শ আপনার গ্রহণ করাই উচিত। কারণ, আবেদনকারী শিক্ষার্থী হিসেবে একবার কানাডায় প্রবেশ করতে পারলে তার সামনে কানাডা ইমিগ্রেশনে সফল হবার অনেকগুলো দ্বার খুলে যায়। জানেন তো, অনেকে বিজনেস ক্যাটাগরিতে লাখে লাখে ডলার খরচ করে হলেও কানাডার পিআর স্ট্যাটাস পেতে মরিয়া। তারচেয়ে বরং স্বল্প খরচে শিক্ষার্থী হিসেবে প্রবেশ করা কি উত্তম নয়?

বর্তমান লেখা বা, কানাডায় পড়াশোনা, বা অভিবাসন বিষয়ে কোনও বিশেষ প্রশ্ন থাকলে আমাকে নিচের ইমেইল ঠিকানায় জানাতে পারেন। পরের কোনও লেখায় আপনার আগ্রহের প্রতিফলন ঘটানোর প্রয়াস থাকবে। তবে, বর্তমান পর্বসহ এ সিরিজের আগের পর্বগুলোতে কানাডা ইমিগ্রেশন বিষয়ে যে সাধারণ আলোচনা করা হয়েছে, তা যেন কোনওভাবেই আইনি পরামর্শ হিসেবে বিবেচনা করা না হয়। কারণ, সুনির্দিষ্ট আইনি পরামর্শ দেওয়া হয় ব্যক্তিগত সাক্ষাতে, সাধারণ আলোচনায় নয়।

এছাড়া, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এ নিয়মিত চোখ রাখুন কানাডা ইমিগ্রেশন নিয়ে আমার নতুন নতুন লেখা পড়তে। ভবিষ্যতে আপনাদের সাথে আরো অনেক মূল্যবান তথ্য সহভাগের প্রত্যাশা নিয়ে আজ এখানেই শেষ করি।

লেখক: কানাডীয় ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট, আরসিআইসি।

ইমেইল: info@mlgimmigration.com; / ফেইসবুক: ML Gani

এ সিরিজের বাকি লেখা: