শিমুল সাহেব কানাডায় বসবাস করেন আজ অনেকদিন। সিটিজেনও হয়েছেন বহু আগেই। বাবা-মায়ের জন্য কানাডার সুপার-ভিসার আবেদন করেছেন। আবেদন প্রত্যাখ্যাত হবার পর্যায়ে চলে গেছে।
Published : 21 Nov 2020, 07:51 AM
মানে, ভিসা অফিস থেকে ইস্যু করা হয়েছে পিএফএল বা, প্রসিডিউরাল ফেয়ারনেস লেটার। সংক্ষেপে পিএফএল লেটার হলো, সর্বশেষ ব্যাখ্যা দেওয়ার বা কারণ দর্শানোর সুযোগ। কানাডার সুপার-ভিসা কী তা নিয়ে দুই লাইন লিখলে বিষয়টা বুঝতে সুবিধা হবে।
সুপার-ভিসা হলো দশ বছরের মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসা, যে ভিসায় একনাগাড়ে দুই বছর পর্যন্ত কানাডায় অবস্থান করা যায়। সাধারণ মাল্টিপল ভিসায় একাধারে ছয় মাসের বেশি থাকা যায় না।
শিমুল সাহেবের সুপার-ভিসার আবেদন প্রত্যাখ্যান হওয়ার পর্যায়ে চলে এলো কেন? কারণ হলো, মেডিকেল ইনএডমিজিবিলিটি, যার বাংলা অনুবাদ হতে পারে, ডাক্তারি বিবেচনায় অগ্রহণযোগ্যতা। ঘটনাটা এরকম, তার মা অসুস্থ, একজন ক্যান্সার সার্ভাইভার। বর্তমানে তাকে নিয়মিত ক্যান্সারের ওষুধ খেতে হয়, বা চিকিৎসা নিতে হয়।
কানাডার ইমিগ্রেশন অফিস হিসেবে করে দেখেছে, তাঁর চিকিৎসায় যে খরচটা হবে তা অনেক বেশি। কানাডায় গড়ে মানুষের চিকিৎসার জন্য যে অর্থ বরাদ্দ থাকে তার চেয়ে এ খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। মূলত এ কারণে তার মা কানাডায় মেডিকেলি প্রবেশযোগ্য বা এডমিজিবল নন। মায়ের কারণে শিমুল সাহেবের বাবাও কানাডায় প্রবেশাধিকার হারিয়েছেন। পরিবারের একজনের দোষ অপরজনকে বাধাগ্রস্ত করার বিষয়টি আপাতদৃষ্টিতে অযৌক্তিক হলেও কানাডার ইমিগ্রেশন অফিস বিষয়টা সেভাবেই বিবেচনা করে। পরিবারের কোনও এক সদস্য কোনও কারণে কানাডায় অপ্রবেশযোগ্য হয়ে পড়লে অন্য সদস্যরাও একই কারণে অপ্রবেশযোগ্য হয়ে পড়েন।
শিমুল সাহেব থাকেন কানাডার অটোয়ায়, আর, আমি থাকি এডমন্টন। কয়েক ঘণ্টার উড়োজাহাজ-দূরত্ব আমাদের। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম-এ লেখা পড়েই আমার খোঁজ পেয়েছেন। সেভাবেই ইমেইল করে আমার সাথে যোগাযোগ করলেন।
সমস্যা শুনে তাকে কাগজপত্র পাঠাতে বললাম; সাথে কানাডার ইমিগ্রেশন অফিস হতে পাওয়া পিএফএল চিঠিও। সামান্য ফি (২৫০ডলার) নিয়ে কাগজগুলো ভালোমতো রিভিউ করলাম। সুপার ভিসার মূল আবেদনপত্র, মায়ের মেডিকেল রিপোর্ট, ইত্যাদি দেখে বুঝলাম, এ কেইসে আমার সাথে সিনিয়র কোনও কনসাল্টটেন্টকেও যুক্ত করলে ক্লাইয়েন্ট আরও ভালো সার্ভিস পেতে পারেন। সে হিসেবে, প্রায় বিশ বছরের অভিজ্ঞ এক সিনিয়রকে তাৎক্ষণিক ফোন দিয়ে বিষয়টা আলাপ করলাম।
সব শুনে তিনি একজন ডাক্তারকেও আমাদের সাথে যোগ করতে বললেন। স্বাভাবিকভাবেই, সব মিলিয়ে আমাদের কনসালটেশন ফি একটু বেড়ে গেল। ক্লাইয়েন্ট আপত্তি করায় আমি আমার নিজের ফি প্রায় অর্ধেকে নামিয়ে এনে কাজটা নিলাম। মাস দুয়েক আগে আমাদের কোম্পানি, এমএলজি কানাডা ইমিগ্রেশন, সহযোগিদের সাথে নিয়ে ওই পিএফএল লেটারের দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়েছে। কানাডার ইমিগ্রেশন অফিস এবার আর না করতে পারেনি, তবে, তারা আরও কিছু সহায়ক কাগজপত্র চেয়েছেন কয়েকদিন আগে। সার্বিক বিবেচনায় বিষয়টি ইতিবাচকই মনে হচ্ছে। কারণ, নাকচ করলে তারা বেশি সময় না নিয়ে দ্রুতই না করে দেয়।
কানাডা প্রবেশে ইনএডমিজিবিলিটি অন্যান্য কারণেও হতে পারে। যেমন, সিকিউরিটি গ্রাউন্ড, ক্রিমিনাল গ্রাউন্ড, ফাইনান্সিয়াল গ্রাউন্ড, মিসরিপ্রেজেন্টেশন, নন-কমপ্লাইয়েন্স, ইত্যাদি। সবকিছু নিয়ে আলোচনা করলে এ লেখা অনেক দীর্ঘ হয়ে যাবে।
তাই, কেবল আরেকটি, মানে- ফাইনান্সিয়াল গ্রাউন্ড নিয়ে দু'চারটি কথা বলছি। ধরুন, আপনি কানাডা বেড়াতে আসতে চাইছেন। কিন্তু, ফাইনান্সিয়াল গ্রাউন্ডে আপনার কানাডায় প্রবেশ ‘না’ করা হলো। আপনি বুঝতেই পারলেন না কেন এমন হলো? এমন কেইস আমি বেশ কয়েকটি মোকাবেলা করেছি। এসব ক্ষেত্রে বেশিরভাগ আবেদনকারিই তাদের আর্থিক সক্ষমতার বিস্তারিত চিত্র কানাডা ইমিগ্রেশন অফিসারের সামনে ফুটিয়ে তুলতে ব্যর্থ হন। আমার অভিজ্ঞতায় তাই দেখেছি।
তবে, ফাইন্যান্সিয়াল সক্ষমতার ক্ষেত্রে আপনার চলতি আয়ের উৎসও শক্তভাবে উপস্থাপন করতে হবে। অর্থাৎ, আপনি চাকরি বা ব্যবসা যাই করুন, তা যে আপনার প্রাত্যহিক খরচের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি তা আপনাকে ফুটিয়ে তুলতে হবে।
অন্যথায়, ইমিগ্রেশন অফিসার মনে করতে পারেন আপনি কানাডা গিয়ে সেখানে আয়-উপার্জনের ভালো সুযোগ পেলে নিজ দেশে নাও ফিরতে পারেন।
ধরা যাক, আপনার বিবেচনায় সন্তোষজনক জবাব দিয়েও আপনাকে কানাডায় ঢুকতে দেওয়া হলো না। তারমানে, সারা জীবনের জন্য আপনি কি কানাডা যেতে পারবেন না? না, ঠিক তা নয়। অতি জরুরি প্রয়োজনে এরপরও আপনি কানাডা যেতে পারবেন।
তবে, সেক্ষেত্রে আপনাকে টিআরপি বা টেম্পোরারি রেসিডেন্ট পারমিট এর জন্য আবেদন করতে হবে। টিআরপি আবেদন সর্বোচ্চ তিন বছরের জন্য অনুমোদন করা হয়।
উল্লেখ্য, এটি কিন্তু সাধারণভাবে পরিচিত ভিজিটর ভিসা বা, টিআরভি নয়। কারন, টিআরপি আবেদনে ইমিগ্রেশনের অ্যাক্ট ও রেগুলেশনের খুঁটিনাটি মাথায় রেখে যথেষ্ট জোরালো যুক্তি তুলে ধরতে হয়।
এ ধরনের আবেদনে ইমিগ্রেশন অফিসার মূলত কানাডা ভিজিটের প্রয়োজনীয়তা (নীড) এর সাথে ঝুঁকি (রিস্ক) এর তুলনা করে থাকেন। টিআরপি আবেদনে বেশ কিছু আইনি বিষয় বিবেচনায় রাখতে হয় বলে এসব ক্ষেত্রে একজন অভিজ্ঞ কনসালটেন্ট (আরসিআইসি)- এর পরামর্শ নেওয়া ভালো মনে করি। আমি কিন্তু বলছি না যে, ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট আপনাকে নিয়োগ দিতেই হবে। আপনি যেমন আদালতে যেকোনও মামলা উপস্থাপনের সময় উকিল না দিয়ে নিজেও নিজেকে উপস্থাপন করতে পারেন, ইমিগ্রেশনের বিষয়গুলো তেমনই। তারপরও মানুষ প্রফেশনালের শরণাপন্ন হন।
আরেকটি আশার কথা হলো, আপনাকে কানাডা হতে রিমুভাল অর্ডারের মাধ্যমে বিতাড়িত করা হলেও কিন্তু আপনি প্রয়োজনে কানাডা আসতে পারেন। সেক্ষেত্রে দরকার হয় এআরসি বা, অথোরাইজেশন টু রিটার্ন টু কানাডা। তবে, এআরসি আবেদন দাখিলের আগে আপনাকে একটা নির্দিষ্ট সময় কানাডার বাইরে অবস্থান করতে হয়। ঠিক কতটা সময় কানাডার বাইরে থাকতে হবে তা নির্ভর করছে কী কারণে আপনাকে কানাডা হতে ‘রিমুভ’ করা হয়েছে তার উপর। কারণভেদে এটি সংক্ষিপ্ত বা দীর্ঘ হতে পারে।
যাক, এ পর্ব আর দীর্ঘ না করি। কানাডায় পড়াশোনা, স্পন্সরশিপ বা অভিবাসন বিষয়ে কোনও বিশেষ প্রশ্ন থাকলে আমার নিচের ইমেইল ঠিকানায় জানাতে পারেন। পরের কোনও লেখায় আপনার আগ্রহের প্রতিফলন ঘটানোর প্রয়াস থাকবে। এছাড়া, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এ নিয়মিত চোখ রাখুন কানাডা অভিবাসন নিয়ে আমার সিরিজ লেখা পড়তে।
ভবিষ্যতে আপনাদের সাথে আরো অনেক মূল্যবান তথ্য সহভাগের আগ্রহ নিয়ে আজ এখানেই শেষ করি।
লেখক: কানাডীয় ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট, আরসিআইসি।
ইমেইল: [email protected]
এ সিরিজের বাকি লেখার লিংক:
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা [email protected]। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |