কানাডা অভিবাসনের টুকিটাকি- ০৫: বয়স্করা কেন, কিভাবে কানাডায় পড়তে যাবেন?

কানাডায় রেজিস্টার্ড ইমিগ্রেশন কন্সাল্টেন্টদের একটা প্রফেশনাল ফোরাম আছে যার নাম কেপিক (CAPIC), যেখানে হাজারেরও বেশি কনসালটেন্ট যুক্ত আছেন। কানাডীয় ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট (আরসিআইসি) হিসেবে ওই ফোরামের আমিও একজন সদস্য।

এম এল গনি, কানাডা থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 August 2020, 05:03 PM
Updated : 29 August 2020, 05:37 PM

কানাডা ইমিগ্রেশন একটি বিশাল কর্মক্ষেত্র, যেখানে আছে কানাডা ইমিগ্রেশনের প্রায় ৮০টিরও বেশি প্রোগ্রাম। তাছাড়া বিভিন্ন উপায়ে যারা ইতোমধ্যে অস্থায়ী ভিসা, যেমন ভিজিটর, স্টুডেন্ট, ইত্যাদি নিয়ে কানাডা পারি জমিয়েছেন তাদের অনেকেও সেখানে স্থায়ী হতে গিয়ে নানাপ্রকার আইনি ঝামেলা মোকাবেলা করছেন। তাদেরকেও নিজ নিজ প্রয়োজনে নিয়মিতই কানাডার ইমিগ্রেশন কন্সাল্টেন্টদের পরামর্শ নিতে হয়।

সঙ্গতকারণেই ডাক্তারি, প্রকৌশলবিদ্যা ইত্যাদিতে যেমন নানা শাখা উপশাখা বা স্পেশালাইজেশন রয়েছে, একইভাবে কানাডা ইমিগ্রেশনেও রয়েছে বিভিন্ন শাখা। যেমন, কোন কনসালটেন্ট কাজ করেন রিফিউজি বা উদ্বাস্তু বিষয়ে, কেউ অস্থায়ী ইমিগ্রেশন যেমন- শিক্ষা, ভিজিট ইত্যাদি নিয়ে, কেউবা স্থায়ী অভিবাসন বা পিআর, ইমিগ্রেশন আপিল ইত্যাদি নিয়ে। মোটকথা, একজন ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট কোনভাবেই নিজেকে সব ধরনের কাজের বিশেষজ্ঞ দাবি করতে পারেন না। এ কারণেই কন্সাল্টেন্টদের মধ্যে নলেজ শেয়ারিং বা জ্ঞানের সহভাগ একান্ত অপরিহার্য হয়ে পরে। ইমিগ্রেশন প্রফেশনালদের এ ফোরাম জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা সহভাগের কাজটি অনেক সহজ করে দিয়েছে।

কয়েকদিন আগে 'কেপিক' গ্রুপে এক ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট তার এক সফলতার কাহিনী শেয়ার করলেন। তা হলো, ৫৬ বছর বয়সী এক ভদ্রলোক (তার ক্লাইয়েন্ট) কানাডায় স্টাডি পারমিট পেয়েছেন। ক্লাইয়েন্টের মাস্টার্স ডিগ্রি আছে আগে থেকেই। বর্তমানে তিনি একটি দুই বছরের ডিপ্লোমা প্রোগ্রামে কানাডায় স্টাডি পারমিট পেয়েছেন। সাধারণভাবে এতো বেশি বয়সে কানাডার স্টাডি পারমিট পাবার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে আসে বলেই আমাদের এই কনসালটেন্টের এ সফলতা ফোরামের সবার প্রশংসা কুড়িয়েছে।

প্রশ্ন হলো, এতো বেশি বয়সে কেন ওই ভদ্রলোক কানাডায় পড়াশোনা করতে আসছেন? এর উত্তর হতে পারে দুইটি:

এক. তিনি ওই বিষয়ে কানাডা হতে পড়াশোনা করে তাঁর দেশে ফিরে গিয়ে অর্জিত জ্ঞান বৃহত্তর পরিসরে কাজে লাগাবেন;

দুই. তিনি এই ডিপ্লোমা অর্জন করে নিজের কানাডা ইমিগ্রেশনের পথ সুগম করবেন।

ভদ্রলোকের সাথে আমাদের ব্যক্তিগত আলাপ হয়নি বলে আমরা ঠিক জানিনা আসলে কী কারণে তিনি এতো বেশি বয়সে কানাডায় পড়াশোনা করতে আসছেন? তবে যে কারণেই তিনি পড়াশোনা করতে কানাডা আসুন না কেন, ভিসা অফিসারকে এ মর্মে সন্তুষ্ট করতে হয়েছে যে কানাডায় শিক্ষালাভের ফলে অর্জিত জ্ঞান তিনি তার দেশে ফিরে গিয়ে যথাযথ কাজে লাগাবেন। কারণ, ভিসা অফিসার কোনভাবেই শুনতে চান না যে একজন বিদেশি নাগরিক কানাডায় পড়াশোনা শেষ করে নিজ দেশে ফিরে না গিয়ে কানাডায় স্থায়ীভাবে থেকে যাবার পরিকল্পনা করছেন। সে ধরনের সন্দেহ মনে জাগলে ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ স্টাডি পারমিট ইস্যু করা হতে বিরত থাকেন।

কানাডায় স্থায়ীভাবে বসবাস করতে চাইলে স্থায়ী ইমিগ্রেশন (পিআর) বা অভিবাসনের জন্য আবেদন করার বিভিন্ন পথ খোলা রয়েছে। সাধারণভাবে শিক্ষা, বয়স, কাজের অভিজ্ঞতা, ইংরেজি ভাষার দক্ষতা ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্র হতে পয়েন্ট গণনা করেই কানাডা ইমিগ্রেশনের আবেদনের উপযুক্ততা নির্ধারণ করা হয়।

শিক্ষার ক্ষেত্রে আবার কানাডার বাইরের শিক্ষা ও কানাডার ভেতরের শিক্ষার আলাদা পয়েন্ট আছে। কানাডীয় কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হতে যারা ডিপ্লোমা বা ডিগ্রি লাভ করবেন তারা বেশ কিছু বাড়তি পয়েন্ট পেয়ে যান। ওদিকে, বয়স বাড়ার সাথে সাথে বয়সের দিক থেকে পয়েন্ট কমে আসে। তাই, যারা কিছুটা বয়স্ক, অর্থাৎ চল্লিশ বা তার বেশি যাদের বয়স হয়ে গেছে, তাদের ক্ষেত্রে কানাডার একটা ডিপ্লোমা বা ডিগ্রি সার্বিক পয়েন্ট গণনায় অনেক সহায়ক হতে পারে। হয়তোবা উপরে বর্ণিত ৫৬ বছর বয়সী যে ভদ্রলোক এ বয়সে কানাডায় পড়াশোনা করতে এসেছেন তার পরিকল্পনাও ইমিগ্রেশনের পয়েন্ট বাড়ানো।

কানাডায় সরকার নির্ধারিত কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কিছু অনুমোদিত বিষয় বা প্রোগ্রামে পড়াশোনা করতে পারলে পড়াশোনা শেষে কিছুকালের জন্য পূর্ণকালীন কাজ করার সুযোগ দেওয়া হয়। এ সুযোগের মেয়াদ আট মাস হতে তিন বছর পর্যন্ত হতে পারে। এছাড়া, স্টাডি পারমিট নিয়ে লেখাপড়া করার সময় পার্ট টাইম, বা ক্ষেত্রবিশেষে ফুলটাইম, কাজ করারও সুযোগ দেওয়া হয়। এর অর্থ দাঁড়ায়, কানাডায় স্টাডি পারমিট নিয়ে পড়তে আসলে আপনি পড়ালেখা চলাকালীন এবং পড়ালেখা শেষ করার পরও কিছু সময়ের জন্য কানাডায় কাজ করার সুযোগ পাবেন।

এই সময়টায় আপনি চাইলে আপনার স্বামী, বা স্ত্রী এবং নির্ভরশীল সন্তানদেরও কানাডায় অস্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য নিয়ে আসতে পারেন। এমনকি, আপনার স্বামী বা স্ত্রী চাইলে কানাডায় কাজও করতে পারেন, এবং সন্তান বিনা টিউশন ফি-তে কানাডায় পড়াশোনা করতে পারে।

আগেই বলেছি, কানাডার লেখাপড়া থাকলে কিছু অতিরিক্ত পয়েন্ট পাওয়া যায় বলে কানাডায় স্থায়ী অভিবাসন বা পিআর পেতে সুবিধা হয়। একইভাবে, কানাডায় চাকরির অভিজ্ঞতা থাকলেও অতিরিক্ত পয়েন্ট পাওয়া যায় যা কানাডা ইমিগ্রেশনের সহায়ক। অধিকন্তু, পড়াশোনা ও চাকরির সুবাদে কয়েক বছর কানাডা বসবাস করলে এমনিতেই আপনার ইংরেজি ভাষার দক্ষতা বাড়ে যা আপনাকে আইইএলটিএস পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করতে সাহায্য করে।

এসব বিবেচনায় আমি মনে করি যাদের বয়স কিছুটা বেড়ে গেছে তাঁরা কানাডায় একটা উপযুক্ত স্টাডি প্রোগ্রামে ভর্তি হয়ে কানাডা আসার চেষ্টা চালাতে পারেন। একটা স্টাডি পারমিট আপনার ভাগ্যে জুট গেলে তার উপর ভর করে একে একে আরো অনেকগুলো দরজা আপনার সামনে খুলে যেতে পারে। সবাই যে কানাডায় শুরু থেকেই স্থায়ী অভিবাসন নিয়ে আসছেন তা কিন্তু নয়। বরং, শিক্ষার্থী হিসেবে কানাডায় ঢুকে পরবর্তীতে ধাপে ধাপে পিআর হয়েছেন এমন মানুষের সংখ্যাই সম্ভবত বেশি। বলার অপেক্ষা রাখে না, কানাডার পড়াশোনা বা চাকরির অভিজ্ঞতা থাকলে আপনি বেশ কিছু প্রভিন্সিয়াল নমিনেশন প্রোগ্রামে (পিএনপি) আবেদনেরও যোগ্যতা অর্জন করবেন।

কানাডায় স্টাডি পারমিট কিভাবে পাওয়া যেতে পারে? উত্তর সহজ, প্রথমে আপনাকে নির্বাচন করতে হবে একটি উপযুক্ত কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় এবং একই সাথে, ইমিগ্রেশনের উপযোগী কোন স্টাডি প্রোগ্রাম। প্রোগ্রামটি মাস্টার্স, পিএইচডি হতে হবে এমন কথা নেই। ভর্তির জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও ফি দিয়ে উক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির আবেদন দাখিল করতে হবে আপনাকে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যাচাই-বাছাই করে উপযুক্ত মনে করলে আপনাকে 'লেটার অব এক্সেপ্টেন্স' বা এডমিশন অফার পাঠাবে। এর পরের অংশ কানাডার ইমিগ্রেশন বিভাগের কাজ। তাদের কাছে স্টাডি পারমিটের জন্য নিয়মানুযায়ী আবেদন দাখিল করতে হবে।

তারা আপনার আর্থিক সক্ষমতা, পড়ার  প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবেচনায় এনে আপনার স্টাডি পারমিট অনুমোদন বা প্রত্যাখ্যান করে থাকেন। তার মানে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এডমিশন অফার পাঠালেই যে আপনি কানাডায় পড়াশোনা করতে যেতে পারবেন তার শতভাগ নিশ্চয়তা নেই; স্টাডি পারমিটও আপনাকে পেতে হবে। এ কারণে অনেকে কানাডায় স্টাডি সংক্রান্ত পুরো প্রক্রিয়ায় কানাডার অনুমোদিত ইমিগ্রেশন কনসাল্টেন্টের সহায়তা নিয়ে থাকেন।

একটা কথা এখানে না বললেই নয়। স্টাডি পারমিট কোন ভিসা নয়, এটা কানাডায় পড়াশোনা করার অনুমতিমাত্র। কানাডায় প্রবেশ করতে লাগে ভিসা। তবে, যারা স্টাডি পারমিট অর্জন করেন তারা একটি ভিসাও সাথে পেয়ে যান; তার জন্য আলাদা করে আবেদন করতে হয় না। আরেকটি প্রশ্ন অনেকেরই মনে আসছে হয়তোবা। তা হলো, পড়াশোনায় দীর্ঘদিনের বিরতি বা গ্যাপ দিয়ে কানাডায় কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন করলে তাতে সফল হবার সম্ভাবনা কতটুকু, বা, এডমিশন অফার পেলেও শেষতক স্টাডি পারমিট পাওয়া যাবে কিনা? এর উত্তর হলো, সবই নির্ভর করছে আপনার শিক্ষা পরিকল্পনা বা স্টাডি প্ল্যানের উপর। মোটকথা, আপনাকে শিক্ষায় বিরতির কারণটা যৌক্তিকভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে। কানাডীয়রা যুক্তিতে বিশ্বাস করে। অন্যথায়, এ লেখার শুরুতে যে ৫৬ বছর বয়সী ভদ্রলোকের কথা বলেছি তিনি এ বয়সে কানাডায় পড়াশোনার সুযোগ পেলেন কী করে?

যাক, এ লেখা আর দীর্ঘায়িত না করি। কানাডায় পড়াশোনা, বা ইমিগ্রেশন বিষয়ে কোনও বিশেষ প্রশ্ন থাকলে আমাকে নিচের ইমেইল ঠিকানায় জানাতে পারেন। পরের কোনও লেখায় আপনার আগ্রহের প্রতিফলন ঘটানোর প্রয়াস থাকবে।এছাড়া, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এ নিয়মিত চোখ রাখুন কানাডা ইমিগ্রেশন নিয়ে আমার লেখা পড়তে। আপনাদের সাথে আরো অনেক মূল্যবান তথ্য সহভাগের আগ্রহ নিয়ে আজ এখানেই শেষ করি।

লেখক: কানাডীয় ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট, আরসিআইসি।

ইমেইল: info@mlgimmigration.com

এ সিরিজের বাকি লেখার লিংক:

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!