কানাডা অভিবাসনের টুকিটাকি-০২: চিকিৎসা বিদ্যার কদর এবং ভর্তির যোগ্যতা

বাংলাদেশ থেকে আমার এক নিকটাত্মীয় ফোন দিল কয়েকদিন আগে। বললো, 'আংকেল, আমাদের কানাডা ইমিগ্রেশন হয়ে গেছে; যত দ্রুত পারি চলে যাবো।' অভিনন্দন জানালাম তাকে।

এম এল গনি, কানাডা থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 June 2020, 09:02 PM
Updated : 29 June 2020, 09:02 PM

তারপরই মেয়েটা জানালো, সে কানাডায় এসে চিকিৎসাবিদ্যা মানে, ডক্টর অব মেডিসিন (এমডি) প্রোগ্রামে ভর্তি হতে চায়। কানাডার কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলে ভালো হবে, ভর্তির যোগ্যতা কী লাগে- এসব নিয়ে ঘণ্টাখানেক কথা হলো মেয়েটির সাথে।

মেয়েটি বাংলাদেশে এইচএসসি পাশ করেছে। বর্তমানে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে পড়ছে। কানাডায় এসেই তার চিকিৎসাশাস্ত্রে পড়ার ইচ্ছা। তাকে যখন আমি বুঝিয়ে বললাম, উচ্চমাধ্যমিক পাস করেই কানাডায় চিকিৎসাশাস্ত্রে ভর্তি হওয়া যায় না, তা শুনে সে বেশ অবাকই হলো।

বিষয়টা এরকম, বাংলাদেশের উচ্চমাধ্যমিক, যা কানাডায় হাইস্কুল নামে পরিচিত, শেষ করে তাকে ব্যাচেলর ডিগ্রি প্রোগ্রামে ভর্তি হয়ে কমপক্ষে ৯০ ক্রেডিট অর্জন করতে হবে। এই ৯০ ক্রেডিট অর্জন করতে গিয়ে সচরাচর চার বছরের আন্ডারগ্রেড বা ব্যাচেলর ডিগ্রি/প্রোগ্রাম শেষ হয়ে যায়। তারপর দিতে হয় মেডিকেল কলেজ ভর্তিপরীক্ষা বা এমক্যাট (MCAT) পরীক্ষা।  'এমক্যাট' একটি কম্পিউটার বেইজড পরীক্ষা যা আমেরিকা, কানাডাসহ পৃথিবীর কয়েকটি দেশে মেডিকেলে পড়তে ইচ্ছুকদের দিতে হয়।

আন্ডারগ্রেড প্রোগ্রামের ফলাফল এবং 'এমক্যাট' পরীক্ষার রেজাল্ট ছাড়াও আরেকটি বিষয় কানাডায় মেডিকেলে ভর্তির যোগ্যতা নির্ধারণে দেখা হয়। তা হলো, স্বেচ্ছাসেবামূলক ও  গবেষণা কাজ ইত্যাদিতে প্রার্থী নিজেকে কতোটা জড়িত রেখেছেন। একজন মানবিক মানুষ হিসেবে কে কতটা যোগ্য কানাডায় চিকিৎসক হতে সেটি গুরুত্বে সঙ্গে বিবেচনা করা হয়।

এসব গুণাবলীর পরোক্ষ ইঙ্গিত বা প্রমাণ পাওয়া যায় তারা স্বেচ্ছাসেবামূলক সামাজিক  কাজে কতটা সময় দিয়েছেন, বা দেননি তা থেকে। কেবল পড়াশোনায় নিমগ্ন থেকে অনেকেই চাইলে পরীক্ষায় খুব ভালো রেজাল্ট করে ফেলতে পারেন, কিন্তু এর অর্থ এ নয় যে তিনি একজন নির্ভরযোগ্য ও সংবেদনশীল মানবিক গুণাবলীর চিকিৎসক হবেন। এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিজ, বা পড়াশোনার বাইরের কাজ তাই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে দেখা হয় কানাডায় মেডিকেলে ভর্তির ক্ষেত্রে।

উপরের বিষয়গুলো বিবেচনা করে আবেদনকারীদের মধ্য থেকে মেডিকেলে ভর্তিচ্ছুদের একটি প্রাথমিক তালিকা প্রণয়ন করা হয়। এ পর্যায়ে প্রার্থীদের তাদের ইন-পার্সন ইন্টারভিউ বা সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। সাক্ষাৎকারটিও হয় কয়েকধাপে।

ব্যাপারটা সংক্ষেপে এরকম- একজন প্রার্থীকে সাত/আটটা আলাদা স্টেশনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় পুরো সাক্ষাৎকার শেষ করতে। একেক স্টেশনে প্রার্থীর একেকটি দিক পর্যবেক্ষণ করা হয়। এই সিরিজ সাক্ষাৎকার যারা সফলভাবে মোকাবেলা করতে পারেন, তারাই কানাডায় মেডিকেলে পড়ার চূড়ান্ত মনোনয়ন পান। সংক্ষেপে, কানাডায় মেডিকেলে ভর্তির প্রক্রিয়া এমনই।

পুরো কাহিনী শুনে আমার আত্মীয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে মনে হলো। কারণ, প্রক্রিয়াটা আসলেই দীর্ঘ এবং সেই সাথে অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক। একজন প্রার্থী ব্যাচেলর ডিগ্রিতে যত ভালো ফলই করুক, বা 'এমক্যাট'-এ যত উঁচু স্কোরই তুলুক, তিনি যে সফলভাবে ইন্টারভিউ উৎরাতে পারবেন এ নিশ্চয়তা কোনভাবেই দেওয়া যায় না।

এ সমস্যা এড়াতে অনেকে 'একবার না পারিলে দেখো শতবার' নীতি অনুসরণ করেন। কেননা, একজন শিক্ষার্থী কতবার মেডিকেলে ভর্তির প্রচেষ্টা চালাতে পারে তার কোন সীমা নেই। এ সুযোগ নিয়ে অনেকেই মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে হতে অন্য কোনও বিষয়ে মাস্টার্স, বা কোন কোন সময় পিএইচডি ডিগ্রি পর্যন্ত শেষ করে ফেলেন। ফলে, স্বাভাবিক নিয়মে মেডিকেলে ভর্তির সময়ের বয়স একুশ বা বাইশ বছর হলেও, বাস্তবতা হলো অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই মেডিকেল কলেজে ভর্তির গড় বয়স পঁচিশ বা চব্বিশ।

আবার কানাডায় মেডিকেল কলেজে অধ্যয়ন একজন নন-ইমিগ্রেন্ট বা বিদেশি নাগরিকের জন্য অত্যন্ত ব্যয়বহুল। কানাডার পিআর (পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট) বা সিটিজেনদের (নাগরিক) জন্য এটা তেমন ব্যয়বহুল নয়। কেননা, একজন পিআর বা সিটিজেন চাইলে সরকার বা ব্যাংক অথবা দুটো উৎস থেকেই স্বল্পসুদে ঋণ নিয়ে পড়াশোনা করতে পারেন। তাই এ কথা জোর দিয়ে বলা যায়, যাদের অন্য যোগ্যতা আছে তাদের জন্য কানাডায় মেডিকেলে পড়া আর্থিক কারণে বাধাগ্রস্ত হওয়ার কথা নয়।

প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ বা কানাডার বাইরে থেকে কোনও শিক্ষার্থী সরাসরি কানাডায় এসে কিভাবে ডাক্তারি পড়তে পারেন? এই বিষয়টিই জানতে চেয়েছে আমার নিকটাত্মীয়া। কানাডার রেজিস্টার্ড ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট (আরসিআইসি) হিসেবে এ প্রশ্নের যৌক্তিক জবাব দিয়েই আজকের আলোচনা শেষ করবো।

প্রথমত, ইমিগ্রেন্ট হয়ে কানাডা প্রবেশের পর এ ধরনের প্রোগ্রামে পড়াশোনা করা বড় ধরনের অর্থ-সাশ্রয় ঘটাবে, যা উপরে পরিষ্কার বর্ণনা করা হয়েছে। আর, যাদের পক্ষে শুরুতেই ইমিগ্রেন্ট হিসেবে কানাডায় আসার সুযোগ নেই, তারা ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট হিসেবে কানাডা প্রবেশের চেষ্টা চালাতে পারেন।

তবে, ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট হিসেবে বিদেশ থেকে সরাসরি কানাডার মেডিকেল প্রোগ্রামে ঢোকা যেহেতু কষ্টসাধ্য, তাই মেডিক্যাল ফিল্ডের অন্য কোনও প্রোগ্রামে (যেমন, নার্সিং, ফার্মেসি ইত্যাদি) ভর্তি হয়ে শিক্ষার্থী হিসেবে প্রথমে কানাডা আসতে পারেন। পড়াশোনা শেষের পর ইমিগ্রেন্ট বা পিআর স্ট্যাটাস পেয়ে গেলে মেডিকেলে ভর্তির চেষ্টা চালাতে পারেন। সেক্ষেত্রে, পড়াশোনা চালিয়ে যেতে কানাডিয়ানদের প্রাপ্য সব সুযোগ-সুবিধাই আপনি ভোগ করতে পারবেন।

কানাডায় প্রথমে নার্সিং, বা ফার্মেসি পড়ে তারপর ডাক্তারিতে ভর্তি হয়েছেন এমন নজির অসংখ্য। আমার পরিবারের একজন কানাডায় ডাক্তারি পড়েছে বলে এ বিষয়গুলো অন্য অনেকের চেয়ে আমি ভালো জানি। যতটা জানি, নার্সিং বা ফার্মেসি পড়ে আসা শিক্ষার্থীরা নাকি চিকিৎসাবিদ্যায়ও বেশ সফলতার পরিচয় দেন।

আমার আত্মীয়াকে আমি ইচ্ছে করেই নার্সিংয়ে ভর্তির পরামর্শটা দেইনি। কারণ, তাতে সে মনোক্ষুণ্ণ হতে পারে বা আমি তাকে ডাক্তারি পড়তে নিরুৎসাহিত করছি ভাবতে পারে। যে যাই বলুন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নার্সিং-এ পড়াশোনাকে এখনো ডাক্তারি-ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সমকক্ষ বিবেচনা করা হয় না। অদূর ভবিষ্যতে তেমন বিবেচিত হবে বলেও মনে হয় না। কানাডা-আমেরিকায় বিষয়টা সেভাবে দেখা হয় না।

কানাডায় পড়াশোনা, বা ইমিগ্রেশন বিষয়ে কোনও বিশেষ প্রশ্ন থাকলে আমাকে নিচের ইমেইল ঠিকানায় জানাতে পারেন। পরবর্তী কোন লেখায় আপনার আগ্রহের প্রতিফলন ঘটানোর প্রয়াস থাকবে। এছাড়া, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এ নিয়মিত চোখ রাখুন কানাডা ইমিগ্রেশন নিয়ে আমার লেখা পড়তে। আপনাদের সাথে আরো অনেক মূল্যবান তথ্য সহভাগের আগ্রহ নিয়ে আজ এখানেই শেষ করি।

লেখক: কানাডীয় ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট, আরসিআইসি। 

মেইল: info@mlgimmigration.com

এই সিরিজের প্রথম লেখা”

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!