প্রায় তিন বছর আগে কমরজিৎ স্থানীয় (ভারত) এক ইমিগ্রেশন এজেন্টের শরণাপন্ন হলেন। উদ্দেশ্য, কানাডায় পড়াশোনা করে সেখানে স্থায়ী হওয়া। কানাডার এক কলেজ থেকে লেটার অব এক্সেপ্টেন্স বা অ্যাডমিশন অফার জোগাড় করে দিলেন ওই এজেন্ট। তা নিয়ে কমরজিৎ যথানিয়মে কানাডায় পাড়ি জমালেন।
কানাডায় পৌঁছার পরদিন এজেন্ট কমরজিৎ-কে টেলিফোনে জানালেন, যে অ্যাডমিশন অফার নিয়ে তিনি কানাডা গেছেন সেটি ওই কলেজ অজানা কারণে বাতিল করেছে। তাই, সেটি যেন তিনি ব্যবহার না করেন। একইসাথে, তাকে পরামর্শ দেওয়া হলো অন্য কোন কলেজ থেকে নতুন একটি অফার লেটার জোগাড় করে নিতে।
নতুন দেশে আসা কমরজিৎ আকস্মিক এ দুঃসংবাদে অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। তিনি উত্তর ভারতের পাঞ্জাবে একটি ছোট্ট গ্রামে বেড়ে উঠেছেন। মাঝারি ধরনের অর্থ-বিত্তের এক কৃষক পরিবারে তার জন্ম। ছোটবেলায় একবার বড় ধরনের অসুস্থতায় পড়েছিলেন তিনি। আর্থিক দুরাবস্থার কারণে ভালো চিকিৎসা তার ভাগ্যে জোটেনি। ফলে অসুস্থতা থেকে আরোগ্যলাভ করলেও কমরজিতের বাম পা দুর্বল থেকে যায়। কিছুটা খুঁড়িয়ে হেঁটে তিনি শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করেন।
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় এ ধরনের শারীরিক প্রতিবন্ধী নারীরা কেমন বঞ্চনার শিকার হোন তা আমাদের সবারই জানা। সামাজিকভাবে তো বটেই, সহপাঠী বা বন্ধুবান্ধবের কাছেও অনেক সময় এদের সমান গ্রহণযোগ্যতা থাকে না। আর দশজনের মতো ভবিষ্যতে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সংসারধর্ম পালনের সুযোগও কমরজিৎ এর হবে কিনা তা নিয়ে তার পরিবার দ্বিধাগ্রস্ত ছিল।
মূলত এসব অনিশ্চয়তা থেকেই বাবা-মা চাইছিলেন শারীরিক প্রতিবন্ধী এ মেয়েটিকে কানাডায় পড়াশোনায় করিয়ে উন্নতদেশে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার সুযোগ করে দিতে।
এজেন্টের ফোন পেয়েই কমরজিৎ তার এক পরিচিত ভারতীয় ছাত্রের সাথে সমস্যাটা নিয়ে আলাপ করলেন। তার পরামর্শমতো কয়েক জায়গায় আবেদন করে দ্বিতীয় একটি অ্যাডমিশন অফার জোগাড় করতে সক্ষম হলেন তিনি। পড়াশোনাও শুরু হয়ে গেল যথারীতি। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন তিনি।
কানাডায় যে জিনিসটা তার খুব পছন্দ হয়েছে তা হলো সেখানে শারীরিক প্রতিবন্ধী বা নারীদের প্রতি কোন বৈষম্যমূলক আচরণ দেখা যায় না। রাস্তাঘাটে চলাচলের সময় কেউ তার দিকে উদ্দেশ্যমূলক বা প্রশ্নবোধকভাবে তাকায়ও না। বন্ধুরাও এ কারণে তাকে ভিন্ন চোখে দেখেনা।
পরিবেশের প্রভাবে কানাডায় বসবাসরত ভারতীয়রাও তাকে একইরকম সম্মান-সমীহ করে। এতে ধীরে ধীরে কানাডার প্রতি এ মেয়েটির আকর্ষণ বেড়েই চললো। কমরজিৎ স্বপ্ন দেখে- দুই বছরের পড়াশোনা শেষ করে অন্যদের মতো সেও ‘ওপেন ওয়ার্ক পারমিট’ নিয়ে চাকরি করবে। তারপর একসময় স্থায়ী অভিবাসন বা পিআর এর আবেদন করে কানাডায় স্থায়ী হবেন।
কানাডায় সুন্দরভাবে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার বিষয়টি ভারতে বসবাসরত বাবা-মাকে জানালে তারাও কমরজিৎ এর দশ বছর বয়সী একমাত্র বোনটিকে নিয়ে একসময় কানাডায় পাড়ি জমানোর স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। এ কোন অসম্ভব কল্পনা নয়।
কমরজিৎ কানাডার পিআর স্ট্যাটাস পাওয়ার কিছুদিনের মধ্যে বাবা-মা ও ছোটবোনটিকে স্পন্সরশিপের মাধ্যমে কানাডায় নিয়ে আসবে সেটাই স্বাভাবিক। বর্তমানে পৃথিবীর আর কোন উন্নতদেশে এতো সহজে পরিবার নিয়ে আসার সুযোগ তেমন নেই। কৃষক বাবা-মা একসময় যে মেয়েটিকে পরিবারের বোঝা ভেবে আতংকিত থাকতেন আজ সেই প্রতিবন্ধী মেয়েটিই তাদের স্বপ্নের ভরসাস্থল হয়ে দাঁড়িয়েছে!
কানাডায় দুবছর পড়াশোনা সফলভাবে শেষ করে এক বছর চাকরিও সম্পন্ন করলেন কমরজিৎ। তারপর অন্য দশজনের মতো পিআর এর আবেদনও দাখিল করলেন।
কয়েকমাস পর কানাডার ইমিগ্রেশন অফিস হতে এক চিঠি এলো তার কাছে। চিঠিতে জানানো হলো, যে অ্যাডমিশন অফার নিয়ে তিনি কানাডায় প্রবেশ করেছিলেন তা ভুয়া; বাস্তবে ওই কলেজ তেমন কোন লেটার অব এক্সেপ্টেন্স তাঁকে ইস্যু করেনি বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে কমরজিৎ এর কোন ব্যাখ্যা থাকলে তা একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ইমিগ্রেশন অফিসকে অবহিত করার নির্দেশনাও দেওয়া হলো ওই চিঠিতে।
কমরজিৎ এর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। তিনি দ্রুত ওই কলেজে যোগাযোগ করে একই তথ্য পেলেন। দেশে (ভারত) এই এজেন্টের সাথে যোগাযোগের অনেক চেষ্টা করেও তার নাগাল পেলেন না। চোখে সর্ষে ফুল দেখছেন তিনি, এবং একইসাথে তার গরিব পরিবারটিও এ খবরে ভেঙে পড়েছেন। বুঝতে বাকি রইলো না, কমরজিৎ বড়ো ধরনের ইমিগ্রেশন ফ্রডে পড়েছেন, যা থেকে উদ্ধার পাওয়া অনেক কঠিন।
অবশেষে আদালতের শরণাপন্ন হলেন কমরজিৎ। আদালতে কমরজিৎকে মোকাবেলা করতে হলো ইমিগ্রেশন অফিসের নিয়োজিত সরকারি প্রতিনিধিকে। সরকারি প্রতিনিধি আদালতকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন, কমরজিৎ অসত্য তথ্যে কানাডায় প্রবেশ করে মিসরিপ্রেজেন্টেশন- এর অপরাধ করেছেন। এ অপরাধে তাকে কানাডা থেকে বহিষ্কার করে পাঁচ বছরের জন্য কানাডায় প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপেরও দাবি তুললেন তিনি।
প্রত্যুত্তরে কমরজিৎ আদালতকে জানালেন, তিনি স্বেচ্ছায় ভুল কিছু করেননি, তিনি প্রতারক ইমিগ্রেশন এজেন্টের পাল্লায় পড়ে এই অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন। এ অবস্থায় তাকে কানাডা থেকে বহিস্কার করা হলে বাধ্য হয়ে ভারতে ফিরে যেতে হবে, যেখানে একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী নারী হিসেবে তাঁকে নিয়মিত বৈষম্য ও নিগ্রহের শিকার হতে হবে।
আদালত দুই পক্ষের বক্তব্য শুনে অবশেষে কমরজিৎ এর বিপক্ষে রায় দিলেন। আদালতের যুক্তি হলো, এজেন্টের ভুল ভ্রান্তি বা প্রতারণার দায় কমরজিৎকেই নিতে হবে। কারণ, তিনিই কানাডায় প্রবেশের জন্য আবেদন করেছেন, এবং ওই আবেদনে বর্ণিত সকল তথ্য সঠিক বলে সজ্ঞানে ঘোষণা দিয়েছেন।
এ অবস্থায় ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত ভুল ত্রুটির জন্য কমরজিৎকেই দায় নিতে হবে। এ দায় কোনোভাবেই অন্যের উপর চাপানো যুক্তিযুক্ত নয়। তবে, কমরজিৎ যে প্রতারকের খপ্পরে পড়েছেন এ বিষয়টি আদালত মেনে নিয়েছেন, যদিও এর কোন সুবিধা কমরজিৎকে দেওয়া যৌক্তিক মনে করেননি।
বিচারক তার পর্যবেক্ষণে এও বলেন, কমরজিৎ এর উচিত ছিল এজেন্ট তাকে যে অফার লেটার এনে দিয়েছিলেন তা আসল কি নকল- তা ওই কলেজের সাথে যোগাযোগ করে নিশ্চিত করা। এক্ষেত্রে তিনি নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেননি। এছাড়া, মিসরিপ্রেজেন্টেশনের এ ঘটনায় শারীরিক প্রতিবন্ধীতার বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া এখতিয়ার বহির্ভুত বলেও বিচারক মন্তব্য করেন।
উপরের ঘটনা পাঠকের উদ্দেশ্যে তুলে ধরার লক্ষ্য মিসরিপ্রেজেশনের গুরুত্ব বোঝাতে। কানাডায় পড়াশোনা বা ইমিগ্রেশনের আবেদন দাখিলের সময় পরিবেশিত তথ্যের সত্যতা যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় রাখতে হবে। এই পয়েন্টে কানাডা ছাড় দিতে নারাজ।
কানাডার অনুমোদিত পরামর্শকের সহযোগিতা নেবার মতো আর্থিক সঙ্গতি না থাকলে, প্রয়োজনে নিজে নিজে আবেদন দাখিল করুন। তবু, দেশের অলি-গলিতে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠা তথাকথিত ইমিগ্রেশন কনসালটেন্টের শরণাপন্ন হবেন না। তারা অসত্য তথ্য দিয়ে যে কোনওভাবে আপনাকে কানাডা পাঠিয়ে মোটাদাগের অর্থ হাতিয়ে নিয়ে আপনাকে কোন মাপের বিপদে ফেলতে পারে তা উপরের কাহিনী পড়ে খানিক হলেও পরিষ্কার হয়েছে আশা করি।
কানাডায় পড়াশোনা, ইমিগ্রেশন বা অন্য যে কোন প্রকারের আবেদনকারীদের প্রতি কানাডার লাইসেন্সড ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট (আরসিআইসি) হিসেবে আমার পরামর্শ থাকবে, আপনারা আপনাদের আবেদনে কি ধরনের তথ্য পরিবেশন করা হচ্ছে তা ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখবেন, এবং দাখিলকৃত প্রতিটি কাগজের একটি কপি নিজেদের সংরক্ষণে রাখবেন।
কানাডার লাইসেন্সধারী কনসালটেন্টের পরামর্শ নিতে পারেন, তবে তাদের উপর পুরো বিষয়টা ছেড়ে দিয়ে নিজেকে সম্ভাব্য বিপদের মুখে ঠেলে দেবেন না কোন অবস্থাতেই। কারণ, ‘কনসালটেন্ট ভুল করেছেন’ বলে আপনার মাফ পাবার কোন সুযোগই নেয়।
যাক, এ লেখা আর দীর্ঘ না করি। বর্তমান লেখাটি নিয়ে কোন মন্তব্য থাকলে বা, কানাডায় পড়াশোনা, বা ইমিগ্রেশন বিষয়ে কোনও বিশেষ প্রশ্ন থাকলে আমাকে নিচের ইমেইলে জানাতে পারেন। পরের কোনও লেখায় আপনার আগ্রহের প্রতিফলন ঘটানোর প্রয়াস থাকবে।
তবে, বর্তমান পর্বসহ এ সিরিজের অন্য পর্বগুলোতে কানাডা ইমিগ্রেশন বিষয়ে যে সাধারণ আলোচনা করা হয়েছে তা যেন কোনভাবেই লিগ্যাল অ্যাডভাইজ হিসেবে বিবেচনা করা না হয়। কেননা, সুনির্দিষ্ট আইনি পরামর্শ দেওয়া হয় ব্যক্তিগত সাক্ষাতে, সাধারণ আলোচনায় নয়। মনে রাখা দরকার, প্রত্যেকের ইমিগ্রেশন কেইসই কোন না কোনভাবে আলাদা। তাই, একই ধরনের পরামর্শ সবক্ষেত্রে সুফল নাও বয়ে আনতে পারে।
এছাড়া, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এ নিয়মিত চোখ রাখুন কানাডা ইমিগ্রেশন নিয়ে আমার নতুন নতুন লেখা পড়তে। ভবিষ্যতে আপনাদের সাথে কানাডা অভিবাসন বিষয়ে আরো অনেক মূল্যবান তথ্য সহভাগের প্রত্যাশা নিয়ে আজ এখানেই শেষ করি।
লেখক: কানাডীয় ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট, আরসিআইসি।
ইমেইল: info@mlgimmigration.com; / ফেইসবুক: ML Gani
এ সিরিজের বাকি লেখা:
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |