কানাডা অভিবাসনের টুকিটাকি ২৭: ‘কনসালটেন্ট’ ভেবে এজেন্টের পাল্লায় পড়েননি তো?

সেদিন বাংলাদেশ থেকে একজন ছাত্র যোগাযোগ করলেন তার প্রত্যাখ্যাত স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে আলাপ করতে। সঙ্গত কারণেই তার নাম পরিচয় গোপন রেখে ঘটনাটা উল্লেখ করছি। ধরে নেই তার নাম সজিব।

এম এল গনি, কানাডা থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 May 2022, 12:04 PM
Updated : 20 May 2022, 08:06 PM

তিনি জানতে চাইলেন, পুনরায় আবেদন দাখিলে আমি তাকে পরামর্শ সেবা দিতে পারবো কিনা। আমি বললাম, “কাগজপত্র না দেখে ঢালাও কিছু বলা সম্ভব নয়। প্রত্যাখ্যানের কারণ দেখে বলা যাবে আমরা আপনাকে কতটুকু সেবা দিতে পারবো বা আদৌ পারবো কিনা। চাইলে, প্রত্যাখানের চিঠি ও অন্যান্য ডকুমেন্ট ইমেইল করতে পারেন।”

এখানে একটু বলে রাখি, ‘মিসরিপ্রেজেন্টেশন’ এর কারণে যে আবেদনগুলো প্রত্যাখ্যাত হয় তাতে পুনরায় আবেদন দাখিল করেও সচরাচর কাজ হয়না। ‘মিসরিপ্রেজেন্টেশন’ অর্থ- সত্য গোপন করা বা উদ্দেশ্যমূলকভাবে মিথ্যা তথ্য দেওয়া।

এ বিষয়ে আমি আগের একটি পর্বে বিস্তারিত লিখেছি বলে পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চাইনা। পাঠক চাইলে সংশ্লিষ্ট পর্বটি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম থেকে নিতে পারেন।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সজিব ইমেইলে কাগজপত্র পাঠিয়ে ফোনালাপে জানালেন, তিনি কানাডার একজন লাইসেন্সড কনসালটেন্ট (আরসিআইসি) এর সহায়তায় আবেদন দাখিল করেছিলেন। কিন্তু কাগজপত্রের উপস্থাপনা ও সাবমিশনের কোয়ালিটি দেখে তাতে আমার সন্দেহ হলো। তাই তার কাছে সেই কনসালটেন্টের নাম পরিচয় জানতে চাইলাম। তিনি আমাকে কানাডার এক কনসালটেন্টের নাম বললেও ওই কনসালটেন্টের সাথে তার সম্পাদিত কোনও লিখিত চুক্তি (রিটেইনার এগ্রিমেন্ট) দেখাতে পারলেন না।

কানাডার ইমিগ্রেশন কনসালটেন্সি পেশার নিয়মানুযায়ী কোন কনসালটেন্ট লিখিত চুক্তি স্বাক্ষর করার আগে কাউকে কানাডা ইমিগ্রেশনের সেবা দিতে পারেন না। দিলে এবং তা উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে রিপোর্ট হলে তিনি 'কোড অব এথিক্স' ভঙ্গ করার দোষে দুষ্ট হতে পারেন।

কানাডীয় রেগুলেটরি সংস্থা, দ্য কানাডিয়ান ইমিগ্রেশন অ্যান্ড সিটিজেনশিপ কনসালটেন্টস (সিআইসিসি) কানাডার অনুমোদিত সকল ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট বা ‘আরসিআইসি’র কর্মকাণ্ডের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান।

পরামর্শসেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে কোন কনসালটেন্ট অনিয়মের আশ্রয় নিয়েছেন বলে তদন্তে প্রমাণিত হলে সিআইসিসি সেই কনসালটেন্টের লাইসেন্স স্থগিত বা বাতিল ঘোষণা করতে পারে। ক্ষেত্রবিশেষে সেই কনসালটেন্ট অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হতে পারেন।

কেবল ইমিগ্রেশন কন্সাল্টেন্টদের ক্ষেত্রে নয়, অন্য অনেক পেশা যেমন- চিকিৎসা, প্রকৌশল, শিক্ষকতা ইত্যাদি ক্ষেত্রেও কানাডায় রেগুলেটরি বডি বা নিয়ন্ত্রক সংস্থা থাকে। এই সংস্থাগুলোর যথাযথ নিয়ম ও গাইডলাইন মেনেই সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদের কাজ করতে হয়। বাংলাদেশের মতো জেন্টেলম্যান এগ্রিমেন্ট বা 'যেমন খুশি তেমন' পন্থায় পেশাজীবী দায়িত্ব কানাডা বা কোনও উন্নতদেশে পালন করা যায় না। এ কারণেই উন্নতদেশগুলোতে পেশাজীবীদের সেবা দেওয়ার মানও অনেক উন্নত।

কনসালটেন্টের সাথে সজিবের সরাসরি কথা হয়েছে কিনা- জিজ্ঞাসা করলে তিনি জানালেন, বাংলাদেশের এক এজেন্টের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে কনসালটেন্টের সাথে যোগাযোগ হয়েছে। সরাসরি কথা হয়নি একবারও। সত্যিকার অর্থে কনসালটেন্টের নামের বেশি আর কিছুই তিনি জানেন না। কন্সাল্টেন্টকে কখনও দেখেনওনি তিনি।

কোন কানাডিয়ান লাইসেন্সড কনসালটেন্ট কিন্তু উপরের নিয়মে এজেন্টকে ব্যবহার করে বা নিজেকে আড়ালে রেখে ইমিগ্রেশন পরামর্শ দিতে পারেন না; এটা সম্পূর্ণ বেআইনি। কেননা, পরামর্শ দেওয়ার গুরুদায়িত্ব অন্যকে ডেলিগেট বা হস্তান্তর করা যায় না।

কোন কনসালটেন্ট এজেন্ট নিয়োগ করতে পারেন কেবল নথি সংগ্রহ, কোম্পানির প্রচারণা বা অনুরূপ কাজে, ইমিগ্রেশনের পরামর্শ দিতে নয়।

সিআইসিসি ওয়েবসাইট (https://college-ic.ca/) ব্যবহার করে নিমেষেই আপনি চাইলে কোন কনসালটেন্ট (আরসিআইসি) বা এজেন্ট এর পরিচয় নিশ্চিত হতে পারেন।

পৃথিবীর যেকোনও প্রান্ত হতে এ কাজটি সম্ভব। নির্ধারিত সার্চ বক্সে আপনি কেবল কনসালটেন্ট বা এজেন্টের নাম টাইপ করে এন্টার বাটনে চাপ দিলেই মুহূর্তে স্ক্রিনে ভেসে উঠবে আপনার কাঙ্ক্ষিত কনসালটেন্ট বা এজেন্টের পরিচয়। এ ব্যবস্থা রাখা হয়েছে বিশ্বজুড়ে ইমিগ্রেশন সেবা প্রার্থীরা যাতে প্রতারিত না হন সে কারণেই।

এ সুবিধাটি নিজের কাজে লাগাতে না পারা আপনার নিজেরই ব্যর্থতা। এই অনলাইন রেজিস্ট্রিতে পরিচয় খুঁজে পাওয়া না গেলে তেমন কনসালটেন্ট বা এজেন্ট পরিচয়দাতার কাছ থেকে দূরে থাকাই বুদ্ধির পরিচয়।

উপরের ওয়েবসাইটে সার্চ দিয়ে সজীব এর বলা সেই কনসালটেন্টের ফোন নম্বর জোগাড় করে তাকে ফোন দিলাম। কনসালটেন্ট সাহেব ঢাকায় ইমিগ্রেশন অফিস করেছেন এবং কানাডা থেকে বছরে একাধিকবার ঢাকায় যাতায়াত করেন। আমার উদ্বেগের কথা শুনে তিনি বললেন, “সজিব সাহেবকে বলুন আমার সাথে ইমিগ্রেশন সেবার কোন লিখিত চুক্তি সম্পাদিত হয়ে থাকলে তা দেখাতে। আর, চুক্তি না হয়ে থাকলে এ বিষয়ে আমার কোন বক্তব্য নেই।…”

কনসালটেন্ট এর বক্তব্য থেকে বোঝা গেলো, সজিবকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে কোন লিখিত চুক্তি সম্পাদন না করেই। ফলে, এই পরামর্শে সজীবের কোনও প্রকার ক্ষতি হলে তার দায় অফিসিয়ালি কেউ নেবেন না; সজীবকেই বহন করতে হবে।

অথচ লিখিত চুক্তি সম্পাদন করে পরামর্শ গ্রহণ করলে এবং সেই পরামর্শ কোন কারণে ভুল প্রমাণিত হলে সজীব উপরের ওয়েবসাইট ব্যবহার করে সিআইসিসি-তে রিপোর্ট করে সেই কন্সাল্টেন্টকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে পারতেন। আশা করি, বোঝাতে পেরেছি এ ধরনের লিখিত চুক্তি সম্পাদন পরামর্শ গ্রহিতার স্বার্থেই বেশি প্রয়োজন।

পাঠকের উদ্দেশ্যে বলি, দেখুন আদালতে কোন মামলা দিতে উকিল নিয়োগ দেওয়া বাধ্যতামূলক নয়। তেমনি ইমিগ্রেশনের আবেদনেও কনসালটেন্ট নিয়োগ দেওয়া জরুরী নয়। তারপরও যথাযথভাবে আবেদন দাখিল করে ইমিগ্রেশন আবেদনে সফল হওয়ার সম্ভাবনা বাড়াতে কনসালটেন্টের সহায়তা নেবেন স্থির করলে- তা যথাযথভাবে নিন, ত্রুটিপূর্ণ উপায়ে নয়।

সেক্ষেত্রে, কাজের শুরুতেই একটি লিখিত চুক্তি স্বাক্ষর করুন এবং কনসালটেন্টের সাথে সরাসরি কথা বলুন। আমি যখন কোন ক্লাইয়েন্টের সাথে কাজ করি, তখন শুরুতেই ভিডিও মিটিং করে তার সাথে পরিচিত হই, যাতে উনি আমাকে ভালোভাবে চিনতে বা জানতে পারেন। নিজেকে আড়ালে রেখে এজেন্ট দিয়ে ঘুরিয়ে-পেচিয়ে কিছু আমরা কখনোই করি না; তা করাও উচিত নয়।

যাক, এ লেখা আর দীর্ঘ না করি। বর্তমান লেখাটি নিয়ে কোনও মন্তব্য থাকলে বা কানাডায় পড়াশোনা, বা ইমিগ্রেশন বিষয়ে কোনও বিশেষ প্রশ্ন থাকলে আমাকে নিচের ইমেইলে জানাতে পারেন। পরের কোনও লেখায় আপনার আগ্রহের প্রতিফলন ঘটানোর প্রয়াস থাকবে।

বর্তমান পর্বসহ এ সিরিজের অন্য পর্বগুলোতে কানাডা ইমিগ্রেশন বিষয়ে যে সাধারণ আলোচনা করা হয়েছে তা যেন কোনভাবেই আইনি পরামর্শ হিসেবে বিবেচনা করা না হয়। কেননা, সুনির্দিষ্ট আইনি পরামর্শ দেওয়া হয় ব্যক্তিগত সাক্ষাতে, সাধারণ আলোচনায় নয়। মনে রাখা দরকার, প্রত্যেকের ইমিগ্রেশন কেইসই কোন না কোনভাবে আলাদা। তাই একই ধরনের পরামর্শ সবক্ষেত্রে সুফল নাও বয়ে আনতে পারে।

এছাড়া, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম- এ নিয়মিত চোখ রাখুন কানাডা ইমিগ্রেশন নিয়ে আমার নতুন নতুন লেখা পড়তে। ভবিষ্যতে আপনাদের সাথে কানাডা অভিবাসন বিষয়ে আরো অনেক মূল্যবান তথ্য সহভাগের প্রত্যাশা নিয়ে আজ এখানেই শেষ করি।

লেখক: কানাডীয় ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট, আরসিআইসি।

ইমেইল: info@mlgimmigration.com; / ফেইসবুক: ML Gani

এ সিরিজের বাকি লেখা:

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!