Published : 29 Apr 2025, 08:58 PM
বরিশালে দায়ের হওয়া একটি মামলার এজাহার পড়ার সুযোগ হয়েছে সম্প্রতি। বস্তুত গত ৫ অগাস্টের পর থেকে সারা দেশে জুলাই অভ্যুত্থানে সরকারি বাহিনী এবং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হত্যাসহ নানা অপরাধে যে শত শত মামলা হয়েছে, তার ভাষা মোটামুটি একইরকম। উল্লিখিত মামলায় প্রায় দেড়শো নামোল্লিখিত আসামির মধ্যে একজন আমাদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন। একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ছাত্রলীগ করতেন। তবে রাজনীতির বাইরে তার প্রধান পরিচয় ছিল একজন সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে। লিটল ম্যাগাজিন, পহেলঅ বৈশাখসহ বিভিন্ন উৎসব, বই পড়া কর্মসূচি, পূর্ণিমায় নৌ ভ্রমণ– এসব নিয়েই তাকে ব্যস্ত থাকতে দেখেছি। উপরন্তু গত বছরের জুলাই মাসে যখন সরকারবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে, তখন তাকেও দেখতাম ছাত্রজীবনের রাজনৈতিক পরিচয় ভুলে তিনিও ছাত্রদের দাবির সঙ্গে একাত্ম। শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে তাকে কথা বলতে শুনেছি। এরকম মানুষকেও নাশকতার মামলায় আসামি করা হলো!
ব্যক্তিগত আগ্রহের জায়গা থেকে একটু খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করলাম যে, রাজনৈতিক নেতা বা সত্যিই যারা জুলাই আন্দোলনের সময় সরকারের পক্ষে রাস্তায় নেমে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালিয়েছেন, তাদের সঙ্গে ওই ব্যক্তিকে আসামি করার কী কারণ থাকতে পারে এবং সারা দেশে যে একই রকমের মামলায় হাজার হাজার লোককে আসামি করা হলো, সেসব মামলার বাদী আসলে কারা, তাদের উদ্দেশ্য কী, এর সঙ্গে সরকার এবং সরকার সংশ্লিষ্টদের যোগসূত্র কতটা? সবশেষ শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের করা একটি হত্যা মামলায় অভিনেতা ইরেশ যাকেরকেও আসামি করার ঘটনাটি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক তোলপাড় চলছে। স্বয়ং সংস্কৃতি উপদেষ্টা সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ইরেশের বিরুদ্ধে মামলা সরকার করেনি। তার ভাষায়: ইরেশের বিরুদ্ধে মামলা ডিপলি শকিং। একই দিন পুলিশ মহাপরিদর্শককে বলতে হয়েছে, এজাহারে নাম থাকলেই গ্রেপ্তার করা হবে না। বরং তদন্তে ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলেই গ্রেপ্তার করা হবে।
কয়েকটি প্রশ্নের সুরাহা করা দরকার।
১. ইরেশের ব্যাপারে সরকার সংশ্লিষ্টরা তাৎক্ষণিকভাবে এই প্রতিক্রিয়া দিতে বাধ্য হলেন কেন, সোশ্যাল মিডিয়ার চাপে? অনেক তারকা এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন এবং তার ফলে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে বলে?
২. ইরেশ যাকের নিজে একজন অভিনেতা তো বটেই, সেই সঙ্গে খ্যাতিমান অভিনেতা আলী যাকের ও সারা যাকেরের পুত্র। তার চেয়ে বড় পরিচয় তিনি দেশের অন্যতম প্রধান বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠান এশিয়াটিকের একজন শীর্ষ ব্যক্তি। এসব কারণে সরকার কি বিব্রতবোধ করছে? ধরা যাক ইরেশ নির্দোষ। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে ইরেশের মতো আরও অসংখ্য নির্দোষ মানুষকে কি আসামি করা হয়নি বা গ্রেপ্তার করা হয়নি? তাদের ব্যাপারে সরকারের অবস্থান কী? তাদের সবার ব্যাপারে কি সংস্কৃতি উপদেষ্টা ‘ডিপলি শকড’ হয়েছেন? তদন্তের আগেই যে অসংখ্য মানুষকে শুধুমাত্র রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে গ্রেপ্তার করা হলো, সে বিষয়ে আইজিপি মহোদয়ের বক্তব্য কী?
৩. গত ৫ অগাস্টের পর থেকে এরকম আরও অসংখ্য মামলায় আরও অনেক তারকাকে আসামি করা হয়েছে। ক্রিকেটার মাশরাফি, সাকিব, অভিনয়শিল্পী ফেরদৌস এবং শতাধিক সাংবাদিকের বিরুদ্ধেও হত্যা মামলা হয়েছে। প্রশ্ন হলো, তারা সবাই কি খুনি কিংবা তারা খুনের নির্দেশ দিয়েছেন? মামলায় যাদেরকে আসামি করা হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অনেক অভিযোগেই মামলা করা যেত। কিন্তু সেই পথে না গিয়ে গণহারে তাদেরকে যে হত্যা মামলার আসামি করা হলো, এর একটি মামলায়ও কি তাদের অপরাধ প্রমাণ করা যাবে? যদি না যায় তাহলে তাদের বিরুদ্ধে সত্যিই যেসব অভিযোগ আছে, সেসব অপরাধও আড়াল হয়ে যাবে কি না?
৪. গণহারে হত্যা মামলা এবং সেখানে হাজার হাজার আসামি করার আসলে উদ্দেশ্য কি এই যে, কোনো না কোনোভাবে আসামিদের গ্রেপ্তার করে জেলে ঢুকানো? একবার বাগে আনতে পারলে তারপর আরও অনেক মামলা দিয়ে অথবা না দিয়ে নানা কৌশলে তাদের কাছ থেকে টাকা কামানো?
৫. অনুসন্ধান বলছে, স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী দুয়েকটি দলের স্থানীয় পর্যায়ের নেতারা একাধিক কারণে এই ধরনের মামলা করেন। প্রথমত এই জাতীয় মামলার বাদী হওয়ার মধ্য দিয়ে তিনি আলোচনায় আসতে চান। তার নামটি সারা দেশের মানুষ জানতে পারে। দলে তার অবস্থান শক্ত হয়। দ্বিতীয়ত, মামলায় যাদেরকে আসামি করা হয় তারা গ্রেপ্তার এড়াতে এবং পুলিশ যাতে সঠিক তদন্ত করে বা তদন্তে যাতে ‘তার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি’ মর্মে রিপোর্ট দেয়, সেজন্য পুলিশের সঙ্গে একধরনের সমঝোতা করেন। যে সমঝোতা হয় মূলত টাকার বিনিময়ে। এই টাকার অঙ্ক নির্ভর করে ঘটনার ব্যাপকতা, মামলার ধারা এবং আসামির রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিচয় এবং আর্থিক সক্ষমতার ওপর। আসামির সঙ্গে সমঝোতা করতে গিয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে টাকা নেয়ার যে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে, সে টাকার ভাগ বাদীরাও পান বলে শোনা যাচ্ছে। আবার মামলা থেকে নাম বাদ দেয়ার জন্য বাদী আবেদন করবেন— এই মর্মে অনেক আসামির কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়েছেন, এরকম অভিযোগও পাওয়া গেছে। তৃতীয়ত, ব্যক্তিগত বিরোধও সাম্প্রতিক মামলাগুলোর পেছনে একটা বড় ভূমিকা রাখছে। অর্থাৎ কোনো না কোনো ইস্যু নিয়ে আরেকজনের সঙ্গে বিরোধ থাকলে তাকেও কোনো একটি হত্যা বা নাশকতার মামলায় আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে।শুধু তা-ই নয়, কখনও কখনও বিদ্বেষ এতটাই তীব্র একের পর এক মামলা দেওয়া হচ্ছে একই ব্যক্তির বিরুদ্ধে।ঢাকাসহ সারাদেশে সাংবাদিকদের নির্বিচারে হত্যা মামলার আসামি করা হচ্ছে।শুধু তাই নয়, জামিনে যেন ছাড়া না পান তা-ও নিশ্চিত করা হচ্ছে কোথাও কোথাও। খাগড়াছড়ির সাংবাদিক প্রদীপ চৌধুরী উচ্চ আদালত থেকে পাঁচ-পাঁচটি মামলায় জামিন পান। জামিন আদেশ জেলখানায় পৌঁছার পরও তাকে মুক্তি না দিয়ে জেলে আটকে রেখে নতুন একটি মামলায় আসামি করা হয়।জেলখানায় জামিন আদেশ পৌঁছালে নাকি ওখানকার এক রাজনৈতিক নেতাকে এ বিষয়ে অবহিত করতে হয়। তাকে না জানিয়ে জেল কর্তৃপক্ষ কাউকে ছাড়তেও পারেন না। প্রশ্ন হলো, দেশের যে কোনো নাগরিক যে কোনো সময় যে কারো বিরুদ্ধে চাইলেই মামলা করে দিতে পারবেন? কিন্তু যাকে আসামি করা হলো তিনি যদি নিরপরাধ হন, সেটা প্রমাণ করে মামলার কালো থাবা থেকে হয়ে আসতে চলে যায় বছরের পর বছর। এই সময়কালের মধ্যে আসামির ওপর দিয়ে যে ঝড় বয়ে যায় এবং অবশেষে যদি দেখা যায় যে তিনি নিরপরাধ— রাষ্ট্র কি সেক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ দেয়? সুতরাং, মামলায় কাকে আসামি করা হলো, তোর চেয়ে বড় প্রশ্ন একজন মানুষ চাইলেই মামলা করতে পারবেন কেন? চতুর্থত, সাম্প্রতিক মামলাগুলোর একটা সাধারণ প্রবণতা হলো প্রাতিষ্ঠানিক ইগো, রেষারেষি ও দলাদলির শিকার হয়েও অনেক নিরপরাধ মানুষ আসামি হয়েছেন। বরিশালের যে ঘটনাটি শুরুতে উল্লেখ করলাম সেটি মূলত ওই প্রাতিষ্ঠানিক রেষারেষির ফল। বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদেরকে যেসব মামলায় আসামি করা হয়েছে, তার পেছনে প্রধানত দায়ী শিক্ষক ও কর্মচারীদের দলীয় লেজুড়বৃত্তি ও পেশাজীবী সংগঠনের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব।
চাইলেই কেন মামলা করা যায়?
প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্র কেন এই ধরনের মামলা করার সুযোগ দিচ্ছে? শুরুর দিকে সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছিলেন যে, ‘গায়েবি মামলা’ তারা অ্যালাউ করবেন না। কিন্তু সেটি বন্ধ হয়নি। ‘সরকার আর মব অ্যালাউ করবে না’ বলেও তিনি হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। যদিও তার এই হুঁশিয়ারির দিনেও মব ভায়োলেন্সের ঘটনা ঘটেছে। তার মানে যারা এইসব ঘটনা ঘটাচ্ছে তারা আদৌ সরকারকে পাত্তা দিচ্ছে কি না সেটিই বিরাট প্রশ্ন।
গণহারে মামলা এবং যাকে তাকে আসামি করার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘অজ্ঞাত আসামি’। এটি সব আমলেই পুলিশের বাণিজ্যের একটি বড় উৎস। অজ্ঞাত আসামি মানেই হলো যে কোনো সময় যে কানো নাগরিককে আটক করে কোনো একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর সুযোগ। বছরের পর বছর ধরে পুলিশ যে এই অজ্ঞাত আসামির নামে ঘুষ বাণিজ্য করে যাচ্ছে, এখানে কোনো পরিবর্তনের লক্ষণ নেই।
সরকার কথায় কথায় সংস্কারের কথা বলছে, অথচ পুলিশ বাহিনীতে কী সংস্কার হলো বা হবে— সেটি এখনও স্পষ্ট নয়। বরং আশ্চর্যের বিষয় হলো, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যেসব সংস্কার প্রতিবেদন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করছে, সেখানে পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনই অনুপস্থিত। অর্থাৎ সব কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে আলাপ হয়েছে বা হবে, কিন্তু পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে কোনো আলাপ হবে না। অথচ পুলিশ বাহিনীর ব্যাপারেই সাধারণ মানুষের অভিযোগ সবচেয়ে বেশি। অন্যদিকে পুলিশ বাহিনীর সংস্কারের জন্য একটি কমিশন অন্তত হলেও সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে কোনো আলাপ নেই। এখানে কোনো সংস্কার প্রয়োজন নেই? রাজনৈতিক দলের সংস্কারের আলাপও খুব একটা শোনা যায় না। এসব ক্ষেত্রেও সংস্কার জরুরি। না হলে বিচারব্যবস্থা যে তিমিরে ছিল সেখানেই থাকবে।
সাম্প্রতিক কিছু গায়েবি মামলা এবং গণহারে আসামি করার বিষয়টি নিয়ে ফেইসবুকে একজন লিখেছেন: ‘তারা খেলছেন, আসামিদের জীবন শেষ।’ অর্থাৎ কারো নাম আসামির তালিকায় থাকা মানেই তাকে গ্রেপ্তার এড়াতে পালিয়ে বেড়াতে হয়। পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করতে চায়। কারণ থানা পর্যন্ত নিয়ে এলেই দেন-দরবার শুরু করা যায়। অনেক সময় গ্রেপ্তার না করার জন্যও পুলিশ মোটা অঙ্কের টাকা নেয়— এটা ওপেন সিক্রেট।
বিগত ১৫ বছর বিএনপি, জামায়াতের অসংখ্য নেতাকর্মী যেরকম পালিয়ে বেড়িয়েছেন, বছরের পর বছর বাড়িতেও যেতে পারেননি, সেই একই অবস্থা হয়েছে এখন আওয়ামী লীগের। শীর্ষ নেতাদের যারা দেশে ছেড়ে পালাতে পারেননি, তাদের প্রায় সবাই এখন জেলে। তস্য নেতা-কর্মী এবং তাদের সহযোগী বলে কথিতদেরও পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। অর্থাৎ দেশ যেভাবে চলছিল, সেভাবেই চলছে।