জাপানের চিঠি: জঙ্গিবাদে ম্লান দেশের সুনাম

গ্রামে ছোটকালে প্রায় একটা কথা শুনতাম- ‘এক মণ দুধে এক ফোঁটা টক’। মানে পুরো দুধের গুণাগুণ নষ্ট করার জন্য এক ফোঁটা নষ্ট দুধই যথেষ্ট।

এস এম নাদিম মাহমুদ, জাপান প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 Dec 2017, 04:28 AM
Updated : 14 Dec 2017, 04:46 AM

কথাগুলো গ্রামে প্রচলিত থাকলেও এটা চিরসত্য যে তিলে তিলে গড়া ঘরের যদি ভিত্তি নড়বড়ে হয়, তাহলে সেই ঘর করার কোনো অর্থ হয় না। নিজেদের অর্জন ও প্রাপ্তির কথা যখন বিদেশিদের মুখ থেকে শুনি কিংবা আমাদের মেধার প্রশংসা যখন তাদের চোখে ধরা পড়ে, তখন আমাদের আনন্দের সীমা থাকে না।

কিন্তু এই অর্জনগুলো নিমেষেই ম্লান হয়ে যায় যখন আকায়েদ উল্লাহ কিংবা নাইমুর জাকারিয়া একটা করে বৃদ্ধাঙ্গুলি তাক করে ধরে। কথাগুলো ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হলেও এর জন্য যে আমাদের প্রবাসীদের সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়, তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। 

এই মাসের শুরুতে আমার ল্যাবে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যাপক ড্যানিয়েল মরিচি এসেছেন। পঁয়ত্রিশ উর্ধ্ব এই অধ্যাপক অত্যন্ত মিশুক ও ভালো মনের। আমার সামনের ডেস্কে বসেছেন।

তিনদিন আগে যখন নিউ ইয়র্কে এক বাঙালির আত্মঘাতি হামলার কথা সারা বিশ্বে চাউর হচ্ছিলো, ঠিক তার কিছু পরে হঠাৎ করে তিনি আমার ডেস্কে এলেন। আমাকে বললেন, “নাদিম, আমি জানি জাপান সরকার তোমার দেশের বিভিন্ন ধরনের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সহায়তা দিয়ে আসছে। অনেক জাপানি কোম্পানিও তোমার দেশে কাজ করছে। তুমি যখন পিএইচডি শেষ করবা, তখন কোনো জাপানি কোম্পানির প্রতিনিধি হয়ে বাংলাদেশে কাজ করা তোমার জন্য বেশ সুবিধা হবে, তাই না?”

আমি বললাম, “অবশ্যই সেটা ভালো কাজ হবে। আমি চাই, আমার শরীরের সবটুকু শক্তি আমার দেশের উন্নয়নে লাগুক। এই পৃথিবী গড়তে আমার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত কাজের মধ্যে ডুবে থাকুক। যে মানুষগুলোর করের অর্থে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা হয়েছে, সেই ঋণ পরিশোধ করার ক্ষমতা আমরা হয়তো নেই। তবে বাংলাদেশের জন্য কিছু করা মানেই হলো আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি।”

কথাগুলো শোনার পর ভদ্রলোক বললেন, “আমি কয়েক মাস আগে চীনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কনফারেন্সে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে দেখি, চীন সরকার বিদেশে ছড়িয়ে থাকা উচ্চশিক্ষায় জড়িত অধ্যাপক, পোস্টডকদের দেশে ফিরিয়ে আনতে বেশ কিছু প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে। বছরে একজন গবেষক প্রায় এক লাখ ডলার করে পাবেন বলেও চীনের ঘোষণা এসেছে।”

উনি বললনে, “আমি যে কয়েকজন বাংলাদেশিদের সাথে পরিচিত হয়েছি, তার মধ্যে আমার মনে হয়েছে তোমরা বেশ মেধাবী। আমার ল্যাবে ভারতীয়রাও আছে। তবে এর মধ্যে তোমরা হচ্ছো অনেক বেশি পরিশ্রমী, সাহসী এবং তুখোড় মেধাবী। তোমাদের মতো দেশের ছেলেরা বিশ্বের যে প্রান্তে আছে, সব জায়গায় দক্ষতার পরিচয় বহন করবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।”

অক্সফোর্ডের এই অধ্যাপকের কথা শোনার পর আমি সত্যিই অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েছিলাম। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বললাম, “আমরা দেশের ভেতর যা করতে পারি না, তা আমরা দেশের বাইরের পরিবেশের সাথে সহজে খাপ খাইয়ে নিয়ে চলতে পারি। দেশে আমরা যেখানে ৬-৭ ঘণ্টা পরিশ্রম করাকে অনেক বেশি কিছু মনে করি, সেখানে দেশের বাহিরে আমরা ১৩-১৫ ঘণ্টা কাজ করেও ক্লান্ত হই না। কারণ, আমরা জানি, আমাদের টিকে থাকতে হলে পরিশ্রমের বিকল্প কিছু নেই।”

এবার ভদ্রলোক বললেন, “তোমাদের দেশের সরকার ইচ্ছে করলেই তো এইসব মেধাবীদের দেশে ফিরিয়ে এনে তোমার দেশটাকে আরও বেশি শক্তিশালী করতে পারতো। তোমাদের স্পৃহাকে ধরে রাখতে সরকারকে এগিয়ে আসার কোনো বিকল্প নেই।”

ভদ্রলোক আরও বললেন, “তবে মজার কথা হলো, তোমরা শিক্ষিতরা যত বেশি মেধাবী আর পরিশ্রমী হও না কেনো, বিদেশে কিন্তু দিনে দিনে তোমাদের অর্জনকে ম্লান করে দেওয়ার জন্য আর একটি পক্ষ বেশ তৎপর। দে আর মোর আক্টিভ দ্যান ইউ।”

তার কথাগুলোর কোনো অর্থ বুঝতে পারলাম না। এরপর তিনি বললেন, “আমার জানা মতে, তোমাদের দেশ ধর্মীয় দিক থেকে বেশ সক্রিয়। তবে মাঝে মধ্যে তোমার দেশের খারাপ খবরগুলো বিবিসিতে দেখতে পাই, তখন একটু শঙ্কাও লাগে।”

উনি বললেন, “কয়েকদিন আগে লন্ডনে যে তোমাদের দেশিয় নাইমুর জাকারিয়া নামে একজনকে আমার দেশের প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার হুমকির জন্য গ্রেপ্তার করেছে, তা নিশ্চয় শুনেছো? এই যে আজ (১২ ডিসেম্বর) নিউ ইয়র্কে যে হামলার ঘটনা ঘটছে, তাতেও বাংলাদেশি। এভাবে যদি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশিদের ‘এক্মট্রিমিজমে’ জড়িয়ে থাকার খবর প্রকাশ হতে থাকে, তাহলে তোমাদের ভবিষ্যৎ কিছুটা হলেও ফগি হবে।”

কথাগুলো শোনার পর মনের ভেতরটা হু হু করে উঠলো। একজন ব্রিটিশ অধ্যাপকের বিশ্লেষণে আমাদের চিত্র এইভাবে ধরা পড়লেও অন্যদেশের অধ্যাপকের ক্ষেত্রে কী হচ্ছে, তা অনুমেয়।

২০১৬ সালের ১ জুলাই ঢাকার হলি আর্টিজানে যে জঙ্গি হামলায় সাত জাপানি নিহত হয়েছিলো, সেই সময় আমরা জাপানে যারা প্রবাসী আছি, তাদের সবাইকে বেশ ভুগতে হয়েছে। এরপর সাইফুল্লাহ ওজাকি নামে এক বাঙালির আইএসে জড়িয়ে পড়ার খবর জাপানিদের মুখে মুখে ছড়িয়ে যায়। যার জন্য আমাদের অনেককে জবাবদিহি করতে হয়েছে। তার ফল পড়েছিলো পরবর্তী বছর মেক্সট স্কলারশিপে। অনেক অধ্যাপকই বাঙালি বলে সরাসরি আবেদনপত্রই রিজেক্ট করে দিয়েছিল।

কিন্তু তারপরও নাইমুর কিংবা আকায়েদরা থেমে নেই। দেশের ভেতরে-বাইরে যেভাবে জঙ্গিবাদের চর্চা করতে বাঙালিরা ছড়িয়ে পড়ছে, তার খেসারত হয়তো তারা দিচ্ছে না, দিচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা লাখ লাখ প্রবাসী বাঙালিরা। বিদেশের মাটিতে প্রতিটি বাঙালি একেকটি বাংলাদেশ। বাংলাদেশের প্রতিনিধি। সুতরাং, বিশ্বের কোনো প্রান্তে কোনো বাঙালি কী অকাম-কুকাম করছে, তার ফল পড়বে সমগ্র প্রবাসীদের উপর।

অক্সফোর্ডের অধ্যাপক কেনো আমাকে জাপানি কোম্পানির প্রতিনিধি হয়ে দেশে ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে, তা বুঝতে সময় লাগেনি। তিলে তিলে গড়া আমাদের সুনামকে ম্লান করার জন্য আকায়েদের জঙ্গি চিন্তাই যথেষ্ট। 

বিদেশে যারা থাকে, তারা অনেক সময় হতাশায় থাকে। টাকা-পয়সার সমস্যা না হলেও একাকীত্বের সুযোগ বুঝে ধর্মীয় উগ্রবাদ চর্চা করতে দ্বিধা করে না তারা। দেশে থাকতে যারা রা-ও করতো না, তারা বিদেশে এসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিংবা প্রত্যক্ষভাবে জঙ্গিবাদের সমর্থন কুড়িয়ে যাচ্ছে। সহানুভূতির ডানা মেলে ধরার চেষ্টা চলছে।

অনেকে আবার দেশে জঙ্গিদের অর্থের যোগানদাতা হিসেবেও কাজ করছে। এতোকিছুর পর আমরা যারা গবেষণায় দিনরাত সময় পার করে দেশের এক বিন্দু সুনামের নেশায় লড়ছি, তাদের কাছে আকায়েদরা হয়ে উঠছে টক। যাদের গলিয়ে পড়া এক ফোঁটা বিষ আমাদের সব কিছুকে তছনছ করে দেয়।

সরকার হয়তো এইভাবে আকায়েদ উল্লাহ কিংবা নাইমুরদের চোখে চোখে রাখতে পারবে না, তবে জঙ্গিবাদের যে বিস্তার হচ্ছে, তা রুখতে সরকারকে উদ্যেগী হতে হবে। দেশের বাইরে কারা কোথায়, কী করছে তার ডাটাবেইজ থাকা জরুরি। প্রয়োজন অনুযায়ী বাঙালিরা যেসব প্রতিষ্ঠানে চাকরি কিংবা শিক্ষা গ্রহণ করছে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নিয়মিত রিপোর্টও সংগ্রহ করতে পারে বাংলাদেশের দূতাবাস।

প্রয়োজন হলে বিপদগামীদের চিহ্নিত করে দেশে ফিরিয়ে এনে শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারে। যদিও সেইগুলো সময়সাপেক্ষ কিংবা আইনে ঝামেলা রয়েছে, তবে প্রবাসীরা তৎপর থাকলে আকায়েদের রুখতে পারা সম্ভব। প্রবাসে আমাদের পরিচিত জনরা কে কী করছে, তা আমরা অনেকই জানি কিংবা বুঝতে পারি। সেটা যদি হয়, তাহলে অবশ্যই আমাদের উচিত হবে, জঙ্গি মতাদর্শদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।

এই ধরনের কেউ থাকলে, সরকার যেন দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারে, সেজন্য সরকারের উচিত প্রতিটি দূতাবাসে বিশেষ সেল গঠন করা উচিত। যারা বিপদগামীদের ফিরিয়ে আনতে কাজ করবে।

যদিও দেশের ভেতরই আমাদের অনেক সমস্যা, এরপরও বিদেশে বাঙালিদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল রাখতে সরকারকে এগিয়ে আসা ছাড়া বিকল্প কিছু দেখছি না। 

লেখক:

 এস এম নাদিম মাহমুদ, জাপান প্রতিনিধি

ইমেইল: nadim.ru@gmail.com

এই লেখকের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!