স্যালুট হে কৃষক পিতা

ডিসেম্বর মাসটি জাপানিদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ মাস। এই মাসে বছরের শুরুতে করা প্রতিজ্ঞার হিসেব মেলানো হয়। আর সব প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, ভুলেরও। ‘ইয়ার-এন্ড-পার্টি’ হয়ে উঠে বছর বিদায়ের অনুষ্ঠান।

এস এম নাদিম মাহমুদ, জাপান থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Dec 2016, 01:24 PM
Updated : 5 Dec 2016, 01:24 PM

গত বছর তেমনি একটি পার্টি ছিল ল্যাবরেটরিতে। ল্যাব থেকে এক ঘণ্টার ট্রেনে যেতে হলো একটি রেস্টুরেন্টে আর সেখানেই আয়োজন ছিল 'ইয়ার এন্ড পার্টি'র। যদিও আমার ল্যাবে প্রতি মাসে অন্তত দু-তিনটি অনুষ্ঠান থাকে এবং এসব অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার ফি দেওয়া বাধ্যতামূলক। এটাই জাপানিদের রীতি।

আমি যে ডেস্কে বসেছিলাম, তার অপর পাশে বসেছে আমার ল্যাবের এক সহযোগী অধ্যাপক। তার পাশে আরও দুই জাপানি ছাত্র। প্রবাস জীবনের ১৫ মাস পার হলেও আমার ওই অধ্যাপক আমার ব্যক্তিগত বিষয়ে কোন খোঁজ-খবর নেননি। আজ মনে হয় তিনি একটা সুযোগ পেয়েছেন।

খাবার খাওয়ার ফাঁকে অধ্যাপক মহাশয় একের পর এক প্রশ্ন ছুঁড়তে লাগলেন।

: আচ্ছা, তোমার বাসায় কয়টি বেড রুম আছে?

: তিনটি। সেই সাথে কিচেন আর ডাইনিং।

: তিনটি রুম!

: হ্যা, তিনটি। আমরা পাঁচ সদস্যের পরিবার। আমার ছোট ভাই আর একটা বোন আছে, সেই সাথে বাবা-মা।

জাপানিরা যৌথ পরিবার পছন্দ করে না। ছেলে-মেয়ে বড় হলে তারা বাবা-মার কাছ থেকে পৃথক হয়ে যায়।

: তোমার ছোট ভাই-বোন কি করে?

:  দুইজনই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে।

এবার তিনি চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ ভাবলেন। আমি ভাবলাম, ভুল কিছু বললাম নাকি? 

তিন-চার মিনিট পর অধ্যাপক সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি করলেন। প্রশ্নটি রীতিসিদ্ধও বটে। তিন ভাই-বোনের পড়াশোনার খরচের বিষয়টি ভেবেই আমাকে পরবর্তী প্রশ্নটি ছুঁড়ে দিলেন।

: তোমার বাবা-মা কি করেন?

: আমার বাবা একজন কৃষক আর মা গৃহিনী।

: তাই নাকি ! নিশ্চয় রিচ ফার্মার?

আমি উত্তরে বললাম, “আমার বাবা হচ্ছে আমার গ্রামের সবচেয়ে দরিদ্র কৃষক। আর আমি আমার ছোট ভাই-বোন দারিদ্রের মধ্যে বেড়ে উঠেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগ থেকে নিজে টিউশনি করে নিজের ও ছোট ভাই-বোনের পড়াশোনার খরচ চালিয়েছি।”

কথাগুলো আমি এভাবে বলবো তিনি প্রত্যাশা করেন নি। কারণ, জাপানে একটি সন্তানকে পড়াতে যে পরিমাণ টাকা খরচ হয় তাতে তার পিতার কিংবা মাতার বেতনের অর্ধেক চলে যায়।

আর সেই অনুযায়ী তিন সন্তানকে পড়ছে জেনে ভেবে নিয়েছিলেন আমার বাবা নিশ্চয় বড় কোন কৃষক হবেন।

আমি আরও বললাম, “আমি এসএসসি’র আগ পর্যন্ত বাবার কৃষিকাজে সাহায্য করেছি। বলতে গেলে আমিও একজন ছোট মানের কৃষক।”

কিছুক্ষণ হাসার পর তিনি বললেন, “পড়াশোনা করলে কীভাবে? কাজ করলে তুমি স্কুলে গেলা কীভাবে?”

জাপানের স্কুলগুলো সকালে শুরু হয়। আর রাত ৭টা-৮টায় ঘরে ফেরে এখানকার শিক্ষার্থীরা। স্কুলের পড়া স্কুলেই শেষ। ঘরে ফিরে শুধু খাওয়া আর ঘুম। তাই তার কাছে ব্যাপারটা বিস্ময়কর।

আমি জানালাম, স্কুলে যাওয়ার আগে আবার স্কুল থেকে ফেরার পর। আর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনির পাশাপাশি পার্টটাইম সাংবাদিকতা ছিল চলার শক্তি।

এরপর তিনি আর কিছু বললেন না, শুধু এইটুকু বললেন, “স্যালুট ইউর প্যারেন্টস।”

পার্টি শেষে ঘরে ফিরলাম রাত সাড়ে ১১টায়। আর ট্রেনের এই এক ঘণ্টার জার্নিতে শুধু ভাবলাম, ছোটকালে দারিদ্রের শৃঙ্খলে আবদ্ধ জীবনে কৃষক বাবার কথা।

২০১০ সালে ছোট ভাই-বোনকে যখন রাজশাহীতে নিয়ে এলাম, তখন তেরখাদিয়ায় এক বাসার মালিক কৃষক বাবার কথা শুনে বাসা ভাড়া দেয়নি।

মাঝে মধ্যে অভিমান হতো। মনে মনে ভাবতাম, আমার বাবা কেন স্কুলের শিক্ষক কিংবা চাকুরে হলেন না? কেন পরিচয় দিলে কৃষকদের সন্তান ভেবে অবজ্ঞা করে সবাই?

সেই ক্ষোভ অভিমান ঝেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় বাবার পেশার জায়গা বড় করে লিখলাম, ‘কৃষক’ আর মায়ের জায়গায় ‘গৃহিনী’। পাসপোর্টেও লিখেছি তা।

আর প্রবাসে এসে যখন কোন বন্ধু কিংবা শিক্ষক বাবা-মার কথা জিজ্ঞাসা করলে কৃষক হিসেবেই পরিচয় দেই। কারণ আমার ওই কৃষক বাবার আদর্শটুকু আমার কাছে অনেককিছু।

কৃষক বাবাদের যারা ঘৃণা করে কিংবা ছোট চোখে দেখে, আমি তাদের ঘৃণা করি। তাদের সাথে কখনও সম্পর্ক কিংবা বন্ধুত্বে জড়াই না।

ঈশ্বরকে এখন 'ধন্যবাদ' যে আমার জন্ম একটি কৃষকের পরিবারে, যেখান থেকে আমি সংগ্রাম শিখেছি। স্যালুট হে কৃষক পিতা!

লেখক: প্রবাসী সাংবাদিক

ইমেইল: nadim.ru@gmail.com