বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু প্রথমবার বিএ পরীক্ষায় ফেল করেন। তার পরবর্তীকালের বিএসসি, এমএসসি, ডিএসসির কাজ ঈর্ষণীয়। বিশ শতকের উপমহাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ চিকিৎসক স্যার নীলরতন সরকার কোনোরকমে বিএ পাস করে চাতরা হাইস্কুলে শিক্ষকতা করছিলেন।
Published : 13 May 2024, 02:41 PM
এ বছরের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় গড় পাসের হার ৮৩ দশমিক শূন্য ৪। অর্থাৎ ১০০ জনের মধ্যে মোট ১৬.৯৬ জন শিক্ষার্থী পাস করতে পারেনি। এর মধ্যে ৫১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে একজন শিক্ষার্থীও পাস করতে পারেনি। গত বছর এমন প্রতিষ্ঠান ছিল ৪৮টি।
এবার এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ১২৯ শিক্ষার্থী। জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রী ৯৮ হাজার ৭৭৬ জন। ছাত্র ৮৩ হাজার ৩৫৩ জন। গত বছরের তুলনায় এবার পাসের হার বেড়েছে। ২০২৩ সালে ১১টি বোর্ডে পাসের গড় হার ছিল ৮০ দশমিক ৩৯। এবার পাসের হার বেড়েছে ২ দশমিক ৬৫ শতাংশ। তবে জিপিএ-৫ এর পরিমাণ গতবারের তুলনায় কমেছে। আগেরবার জিপিএ-৫ পায় ১ লাখ ৮৩ হাজার ৫৭৮ জন। কমেছে ১ হাজার ৪৪৯ জন।
যারা পাস করেছে তাদের অবশ্যই শুভকামনা ও অভিনন্দন জানাতে হবে। কারণ কৃতিত্বকে সম্মান জানানো যেকোনো দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ। তবে অকৃতকার্য হওয়া ১৬ দশমিক ৯৬ ভাগ শিক্ষার্থীর ব্যাপারে বিশেষ মনোযোগ দরকার। তাদের প্রতি সকলকেই সহানুভূতিশীল হতে হবে। কৃতকার্যদের নিয়ে অধিক সমারোহে আপাত ব্যর্থরা যেন দৃষ্টির আড়ালে চলে না যায়, তারা যেন হীনম্মন্যতায় না ভোগে সেটাই এ মুহূর্তে শিক্ষক-অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্ট সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হওয়া উচিত। এমনিতেই বর্তমান শিক্ষার্থীরা প্রতিনিয়ত শিক্ষা-কারিকুলাম পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এর আগে তাদের করোনাকালীন দুর্দশার মধ্যে পড়তে হয়েছে। করোনার কারণে গত ২০২০ সাল থেকে শিক্ষাপঞ্জি এলোমেলো হয়ে যায়। দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে এই শিক্ষার্থীদের চরম মূল্য গুণতে হয়েছে। সেই ক্ষত ও ক্ষতি সহজে পুষিয়ে নেবার নয়। সবচেয়ে বড় কথা, কোনো শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হলে কিংবা কম গ্রেড পেলে তা শিক্ষার্থীর দোষ নয়। এটি শিক্ষাব্যবস্থার সমস্যা। কিন্তু আমাদের দেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এজন্য শিক্ষার্থীদের ওপর দায় চাপানো হয়। পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলে তাকে সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করা হয়। এ ধরনের স্থূল মনোভাব থেকে আমাদের সবাইকেই বেরিয়ে আসতে হবে।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা তাদের শাসনব্যবস্থা পাকাপোক্ত করতে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। সেই পদ্ধতিটিই মোটামুটি চালু রয়েছে ভারত ও বাংলাদেশে। গত ৫৪ বছরে তার কিছু সংস্কার হয়েছে, তবে অধঃপতনই হয়েছে সবচেয়ে বেশি। ইংরেজ প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থায় বিদ্যাচর্চা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষায় পাস ও ফেল। শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে নির্দিষ্ট বিষয়ে পাঠদান করা হয়। নির্দিষ্ট সময়ের পর তারা কতটা বিদ্যা অর্জন করেছে, তার একটা পরীক্ষা নেওয়া হয়। সেই পরীক্ষায় কেউ উত্তীর্ণ হয়, কেউ বা অকৃতকার্য। যার প্রচলিত নাম পাস বা ফেল। ফেলের কোনো ডিভিশন বা গ্রেড নেই, কিন্তু পাসের ডিভিশন বা গ্রেড রয়েছে। এই উপমহাদেশে পরীক্ষায় অতি ভালো ফলাফল করে কেউ আনন্দ-উল্লাস করতে গিয়ে বুক ফেটে মারা যায়নি। কিন্তু পরীক্ষায় ফেল করে গত ৫৪ বছরে আত্মহত্যা করেছে অন্তত হাজারখানেক শিক্ষার্থী।
দুঃখে হার্টফেল করে মারা গেছেন বহু বাবা-মা। এসব অপমৃত্যুর জন্য দায়ী আমরাই— আমাদের সমাজ। আমরা পরীক্ষায় ভালো ফলাফলকে অতিমাত্রায় গুরুত্ব দিয়ে হইচই করি বলেই তারা লজ্জায় আত্মহননের পথ বেছে নেয়। বিদ্যার্জন সম্পর্কে আমাদের ধারণা বৈষয়িক বলেই পাস-ফেল নিয়ে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়। পরীক্ষায় ভালো ফল করা খুবই গৌরবের কথা। কিন্তু ফেল করলেই জীবন ব্যর্থ হয়ে গেল, এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। বাংলা ভাষার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ গদ্যলেখক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলায় ফেল করেছিলেন। ১৮৫৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বিএ পরীক্ষা প্রবর্তন করে। প্রথম বছর বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, আসাম ও বার্মা (মিয়ানমার) থেকে ১৩ জন পরীক্ষা দিয়েছিলেন। পাস করেছিলেন দুজন এবং ফেল করেছিলেন ১১ জন। টেনেটুনে দ্বিতীয় বিভাগে যে দুজন পাস করেছিলেন, তারা হলেন যদুনাথ বসু ও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু প্রথমবার বিএ পরীক্ষায় ফেল করেন। তার পরবর্তীকালের বিএসসি, এমএসসি, ডিএসসির কাজ ঈর্ষণীয়। বিশ শতকের উপমহাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ চিকিৎসক স্যার নীলরতন সরকার কোনোরকমে বিএ পাস করে চাতরা হাইস্কুলে শিক্ষকতা করছিলেন। তার মনে হলো, মানুষের সেবা করতে ডাক্তারি পড়া দরকার। স্কুলের চাকরি ছেড়ে দিয়ে ১৮৮৫ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। কথিত আছে যে, তাকে লন্ডনে গিয়ে এমডি পড়ার জন্য এক অজ্ঞাত হিন্দু বিধবা অর্থসাহায্য করেছিলেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছিলেন। প্রতিষ্ঠা করেছেন আর জি কর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, কুমুদশঙ্কর যক্ষ্মা হাসপাতাল, চিত্তরঞ্জন হাসপাতাল প্রভৃতি। তিনি ছিলেন সর্বভারতীয় মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি। মৃত্যুর পর তার নামে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজ’। প্রথম জীবনে এন্ট্রান্স, আইএ, বিএ পরীক্ষায় তেমন ভালো ফল করেননি। কোনো পরীক্ষায় পাস করে ‘ভি’ চিহ্ন দেখানোর সৌভাগ্য স্যার নীলরতনের হয়নি। কিন্তু তার মেধা ছিল, সংকল্প ছিল, আর ছিল মানুষ ও জাতির কল্যাণ করার অনমনীয় স্পৃহা।
১৮৪০ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত বাঙালির শিক্ষার মান ছিল বিশ্বমানের, নিশ্চয়ই ইউরোপের মতো নয়, কিন্তু অধিকাংশ কমনওয়েলথ দেশের চেয়ে নিচে নয়। উন্নত ছিল সেকালের কী স্কুল-কলেজের শিক্ষা, কী মাদ্রাসার শিক্ষা? উপমহাদেশের প্রথম শ্রেষ্ঠ মুসলমান পদার্থবিজ্ঞানী মুহাম্মদ কুদরাত-এ-খুদা ছিলেন মাদ্রাসার ছাত্র। প্রাবন্ধিক-কথাশিল্পী আবুল ফজল এবং ঔপন্যাসিক শওকত ওসমান মাদ্রাসায় পড়েছেন। কলকাতা ও ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষা ছিল আন্তর্জাতিক মানের। অবাক হওয়ার মতো তথ্য হচ্ছে, ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার একজন প্রিন্সিপাল ছিলেন হিন্দু। বহু মেধাবী শিক্ষার্থী বেরিয়েছেন আলিয়া মাদ্রাসা ও অন্যান্য মাদ্রাসা থেকে। এখনকার মাদ্রাসা শিক্ষার মান সম্পর্কে কোনো কিছু না বলাই উত্তম।
আমাদের দেশে এসএসসি বা সমমানের পাবলিক পরীক্ষাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হয়। এরপর কলেজ জীবনে প্রবেশের সুযোগ ঘটে। জীবনের নতুন দরজা খুলে যায়। এরপরই উচ্চতর শিক্ষাজীবনে তারা প্রবেশের সুযোগ অর্জন করে। প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষায় ফল প্রকাশিত হলে পাসের রেকর্ড দেখে আমরা উৎফুল্ল হই। ভাবি দেশে যত ছেলে পাস করছে ততই শিক্ষায় দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু একটি বিষয় আমরা আমলে নিই না যে, পাস মানেই শিক্ষার মানোন্নয়ন, মেধার বিকাশ নয়। এ প্রসঙ্গে বাংলা সাহিত্যে বিদগ্ধ লেখক প্রমথ চৌধুরী বলেছেন, পাস করা ও শিক্ষিত হওয়া এক বস্তু নয়। অথচ তা আমরা স্বীকার করতে চাই না বলে আজ শিক্ষার মান নিয়ে এত অভিযোগ। আসলে পাস করা ও শিক্ষিত হওয়ার মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান।
এখন যারা মাধ্যমিক পাস করলেন তারা দুই বছরের উচ্চ মাধ্যমিক কোর্স শেষ করে সাত-আট বছরের মধ্যে কর্মজীবনে প্রবেশ করবেন। কেউ হবেন চিকিৎসক, কেউ প্রকৌশলী-স্থপতি, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা প্রভৃতি। কুড়ি থেকে পঁচিশ বছরের মধ্যে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব বর্তাবে তাদের ওপর। কেউ হবেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক, কলেজের অধ্যক্ষ, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সেনাবাহিনীর জেনারেল, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রশাসক, পোশাকশিল্প ও কলকারখানার মালিক। যারা কোনো কিছুই হতে পারবেন না, তারা হয়তো পত্রিকায় কলাম লিখবেন। যারা খুব বুদ্ধিমান, তারা সরকারকে প্রবল প্রশংসা করে লিখবেন। সরকারের প্রতিটি কাজকে সমর্থন দেবেন। আহাম্মক গোছের যারা, তারা সরকারের সব ব্যাপারেই সমালোচনা করবেন।
আজকের তরুণ-তরুণীদের কেউ রাজনীতিতে যাবেন। প্রথমে সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনে। তার পর যুব সংগঠনে। ধাপে ধাপে তারা ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা বা পৌরসভা, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বা সিটি করপোরেশনের মেয়র হবেন। হবেন সংসদ সদস্য। শেষপর্যন্ত মন্ত্রী। কারও দুদকে ডাক পড়বে। সবার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করতে হয়। তবে মনে রাখা দরকার, যে শিক্ষা আপনাকে পর করে, শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন করে, সে শিক্ষা নিয়ে কী লাভ? যে চিকিৎসক ঢাকা মেডিকেল থেকে পাস করে একটি বছরও তার গ্রামের মানুষকে চিকিৎসা দেবেন না, তার ভালো ফলাফলে গ্রামের মানুষের অহংকার করার কী আছে? বাংলাদেশকে অধ্যবসায়, পরিশ্রম ও আত্মবিশ্বাসের দ্বারা একটি মর্যাদাসম্পন্ন রাষ্ট্রে পরিণত করার দায়িত্ব আজ যারা মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে, তাদের। তবে শুধু তাদের নিয়ে বসে থাকলেই চলবে না। যারা অকৃতকার্য হয়েছে, তাদের এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্বও গ্রহণ করতে হবে। যখন সবাই মিলে এগিয়ে যাওয়ার পথ রচনা করা সম্ভব হবে, তখন সারাদেশের মানুষ আনন্দ করবে। সে আনন্দ ক্যামেরানির্ভর নয়। নির্মল আনন্দ। রুটিনমাফিক আনন্দ-উল্লাস নয়। নির্মল আনন্দ আপনাআপনি উদ্ভাসিত হয় চোখে-মুখে স্বর্গীয় আভার মতো। সবার চোখে-মুখে সেই আনন্দের আভা উদ্ভাসিত হোক, এটাই প্রত্যাশা রইল।