Published : 05 May 2025, 04:33 PM
চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যাওয়ার চার মাস পরে দেশে ফিরছেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। কীভাবে তিনি আসবেন তা নিয়ে শুরুতে কিছুটা সংশয় থাকলেও অবশেষে দলটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, কাতারের আমিরের দেওয়া বিশেষ বিমানে (এয়ার অ্যাম্বুলেন্স) তিনি দেশে ফিরছেন। প্রসঙ্গত, কাতারের আমিরের দেয়া এয়ার অ্যাম্বুলেন্সেই তিনি লন্ডনে গিয়েছিলেন। খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার দুই পুত্রবধূ জোবাইদা রহমান এবং সৈয়দা শামিলা রহমান সিঁথিও আসছেন দেশে। গত ৮ জানুয়ারি উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যান বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া।
এই মুহূর্তের রাজনীতিতে খালেদা জিয়ার দেশে ফেরার পাশাপাশি তার ছেলে তারেক রহমান কবে দেশে ফিরব্নে বা আদৌ ফিরবেন কি না কিংবা ফিরতে পারবেন কি না— সেটি নিয়েও জনমনে প্রশ্ন আছে। কেননা, খালেদা জিয়ার যে শারীরিক অবস্থা, তাতে দল ও দেশের মানুষ চাইলেও তার পক্ষে রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান হিসেবে দেশ পরিচালনা করা কঠিন হবে। বয়সের চেয়েও বড় সমস্যা তার শারীরিক জটিলতা। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি অনেকগুলো বড় অসুখে ভুগছেন। সুতরাং আগামী জাতীয় নির্বাচন যেদিনই হোক, সেই নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়ে বিএনপি সরকার গঠনের সুযোগ পেলে খালেদা জিয়ার পক্ষে প্রধানমন্ত্রী তো বটেই, সংসদীয় পদ্ধতিতে তুলনামূলক কম দায়িত্বপূর্ণ রাষ্ট্রপতির পদে আসীন হওয়াটাও কঠিন হবে বলে মনে হয়। তার মানে দলের দ্ব্তিীয় প্রধান (ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান) হিসেবে তার ছেলে তারেক রহমানই যে সরকারপ্রধানের দায়িত্ব নেবেন— সেটি দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা যেমন বিশ্বাস করেন, তেমনি অন্য দল এমনকি যারা অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বে আছেন, সম্ভবত তারাও মনে করেন।
কেননা, বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভের পরে জিয়া পরিবারের বাইরে কেউ প্রধানমন্ত্রী বা সরকারপ্রধান হবেন— এটি এখন পর্যন্ত একটি ‘অসম্ভব’ ব্যাপার। তবে রাজনীতিতে এমন গুঞ্জনও আছে যে, কোনো কারণে তারেক রহমান কোনো কারণে দেশে ফিরতে না পারলে বা না ফিরলে খালেদা জিয়ার বিকল্প হবেন তারেক রহমানের স্ত্রী জোবাইদা রহমান।
সংবাদমাধ্যমের খবর বলছে, জোবাইদা রহমানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশের মহাপরিদর্শককে (আইজিপি) চিঠি দিয়েছে বিএনপি। চিঠিতে তার বাসভবনের পাশাপাশি বাইরে চলাফেরার ক্ষেত্রেও গাড়িসহ পুলিশি নিরাপত্তা চাওয়া হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়, জিয়া পরিবারের সদস্য ও তারেক রহমানের স্ত্রী হিসেবে তার জীবনের নিরাপত্তা ঝুঁকি রয়েছে। চিঠিতে চার ধরনের নিরাপত্তা চাওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- সশস্ত্র গানম্যান, গাড়িসহ পুলিশ প্রটেকশন, বাসায় পুলিশি পাহারা ও বাসায় আর্চওয়ে স্থাপন।
সরকারের কাছে এই ধরনের নিরাপত্তা চাওয়ার বিষয়টি শুধুমাত্র জিয়া পরিবারের সদস্য তথা তারেক রহমানের স্ত্রী হিসেবে তার জীবনের ঝুঁকির বাইরেও তাকে দলের ভবিষ্যৎ কাণ্ডারি হিসেবে গড়ে তোলারও প্রক্রিয়া কি না— তা নিয়েও জনমনে আগ্রহ রয়েছে।
যদিও দেশের প্রধান দুটি দল কেন দুটি পরিবারকেন্দ্রিক হয়ে থাকল— সেটি রাজনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ আলাপ এবং বাংলাদেশের জনমানসকাঠামো বোঝার ক্ষেত্রেও একটি বড় সূত্র। সেটি অন্য তর্ক। এ মুহূর্তে তারেক রহমানের দেশে ফেরা-না ফেরা নিয়ে জনমনে কিছু প্রশ্ন রয়েছে। যেমন:
১. অভ্যুত্থানের মুখে গত বছরের ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগের পতনের পরদিনই কেন তারেক রহমান দেশে ফিরলেন না? অনেকেই এটা মনে করেন ও বিশ্বাস করেন যে, তারেক রহমান ওইদিন দেশে ফিরলে বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানানোর জন্য কয়েক লাখ মানুষের সমাগম হতো। সেই সম্ভাবনাকে তারেক রহমান কেন গ্রহণ করলেন না?
২. তারেক রহমানের আইনজীবীরা একাধিকবার বলেছেন যে, তার বিরুদ্ধে মামলাগুলো নিষ্পত্তি হয়েছে, ফলে তার দেশে ফিরতে বাধা নেই। ধরা যাক, সব মামলায় তিনি এখনও খালাস পাননি বা কিছু মামলা বিচারাধীন, কিন্তু তারপরও বর্তমান নির্দলীয় অন্তর্বর্তী সরকার কি তারেক রহমান দেশে ফিরলে তাকে গ্রেপ্তার করবে বা সরকারের সেই সাহস হবে? যদি না হয় তাহলে তার দেশে ফিরতে বাধা কোথায়?
৩. কোনো বিদেশি শক্তি বা বিদেশি গোয়েন্দা বাহিনী তারেক রহমানকে হত্যার চেষ্টা করতে পারে— এমন একটি শঙ্কার কথা বাতাসে ভেসে বেড়ায়। যদি তাই হয়, তাহলে সেই শঙ্কা কি এখনও বিদ্যমান? অর্থাৎ ৫ অগাস্টের পরেও কি তারেক রহমানের জন্য সেই ঝুঁকিটা আছে?
৪. দেশের অভ্যন্তরে কোনো শক্তি কি এখনও তারেক রহমানের জন্য হুমকি, যাদের কারণে তিনি দেশে আসতে ভয় পাচ্ছেন? যদি এরকম কোনো শক্তি সত্যিই থাকে, তাহলে তাদের মোকাবিলা করার মতো রাজনৈতিক শক্তি কি বিএনপির নেই?
৫. যেহেতু জাতীয় নির্বাচন কবে হবে সেটি এখনও নিশ্চিত নয় এবং সরকার প্রধান আগামী ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে বলে বারবার প্রতিশ্রুতি দিলেও রাজনৈতিক দল এমনকি দেশের রাজনীতি সচেতন মানুষের বিরাট অংশই মনে করে যে, এই সময়ের মধ্যে আসলে নির্বাচন হবে না— কেননা সরকার এবং তাদের স্টেকহোল্ডাররা এখনও নির্বাচনের মুডে নেই, ফলে তারেক রহমানের দেশে ফেরার ক্ষেত্রে নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে এই জটিলতা ও ক্যামোফ্লাজ বা জটিলতাই কি প্রধান কারণ?
৬. ধরা যাক, নির্বাচনের তারিখ নিয়ে ধোঁয়াশা আছে। কিন্তু তার সঙ্গে তারেক রহমানের দেশে ফেরার কী সম্পর্ক? বরং তিনি দেশে ফিরলে নির্বাচন নিয়ে যে ধোঁয়াশা ও অনিশ্চয়তা তৈরি করে রাখা হয়েছে, সেটি কেটে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে।
৭. ধরা যাক তারেক রহমানের দেশে ফেরাটা এখনও ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু একজন প্রকৃত রাজনীতিবিদ বা সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী কি সেই ঝুঁকিটা নেবেন না? নির্বাচনের দিনক্ষণ ঠিক হবে, দল গোছানো হবে, দেশের পরিস্থিতি অনুকূলে আসবে, জীবনের ওপর ঝুঁকি শূন্যে নেমে আসবে এবং তারপরে তিনি দেশে ফিরবেন? যদি তাই হয় তাহলে এটি রাজনৈতিক নেতাসুলভ আচরণ নয়।
৮. তারেক রহমান কি দেশের পরিস্থিতি তথা গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করছেন যে দেশ আসলে কোনদিকে যাচ্ছে এবং সেই কারণে সময় নিচ্ছেন?
৯. বলা হয়, তারেক রহমান দেশে ফিরলে তিনি দেশের রাজনীতির মূল ফোকাসে চলে আসবেন। সুতরাং যারা চায় নির্বাচন বিলম্বিত হোক কিংবা যারা মনে করে বিএনপি ক্ষমতায় এলে দেশের রাজনীতি আগের মতো একই ধারায় চলতে শুরু করবে, তারেক রহমানের ফেরার পথ তৈরিতে সরকার কি তাদের গ্রিন সিগন্যালের অপেক্ষা করছে? যদি সত্যিই এরকম কোনো পক্ষ থাকে যাদের গ্রিন সিগন্যাল ছাড়া তারেক রহমানের দেশে ফেরা কঠিন— সেই পক্ষটি কি বিএনপির চেয়েও বেশি শক্তিশালী?
১০. ধরা যাক ওপরের কোনো সম্ভাবনা ও শঙ্কাই সত্য নয়, তাহলে সত্য কী— সেটিও দেশের মানুষকে জানানো দরকার।
বিএনপির রাজনীতি বহু বছর ধরেই কার্যত পরিচালিত হচ্ছে লন্ডন থেকে। গত বছরের ৫ অগাস্ট পর্যন্ত পরিস্থিতি একরকম ছিল। এখন সেটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই ভিন্ন পরিস্থিতির সঙ্গে বিএনপি নিজেকে কতটা খাপ খাওয়াতে পারছে বা পরিস্থিতিতে নিজেদের অনুকূলে নিয়ে দ্রুত একটি রাজনৈতিক তথা নির্বাচিত সরকারের হাতে দেশ পরিচালনার ভার তুলে দিতে এ মুহূর্তে দেশের প্রধান দল হিসেবে বিএনপি কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারছে, সেটি যেমন প্রশ্ন, তেমনি এরকম একটি দলের সর্বোচ্চ নেতা দেশের একটি ক্রান্তিকালেও কেন বিদেশে বসে দল পরিচালনা করবেন, সেই প্রশ্নটিও সাধারণ মানুষের মনে আছে।
তারেক রহমান দেশে ফিরলেই দেশের রাজনীতি বদলে যাবে বা দেশ এখন যে ধরনের সংকট ও বিশৃঙ্খলার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, সেগুলো রাতারাতি দূর হয়ে যাবে, এমনটি বিশ্বাস করা কঠিন। কিন্তু দেশকে সঠিক পথে রাখা এবং দ্রুত মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দিয়ে একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দিকে যাত্রা শুরু করতে সরকারের ওপর যে ধরনের রাজনৈতিক চাপ তৈরি করে রাখা দরকার, তারেক রহমান দেশে ফিরলে সেটি বিএনপির পক্ষে অনেক সহজ হবে— এটা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে।