বছরখানেক ধরে যেমনটা দেখছি, সিডনিতে আমি এর আগের ২০ বছরে কখনো এতো অভাবী মানুষ দেখিনি। দারিদ্র্যের ঢেউ আমেরিকা-ইউরোপজুড়ে বিস্তৃত হচ্ছে বলে জানতে পাচ্ছি।
Published : 19 May 2024, 12:19 AM
যারা মনে করেন আমরা বিদেশে স্বর্গে বসবাস করি তাদের ধারণা ভুল। একটা সময় আমিও তা মনে করতাম। কিছুদিন আগেও ভাবতাম এখানে জিনিসপত্র কত সস্তা। সবাই যা খুশি তা কিনতে পারে । এখন আর পরিস্থিতি তেমন নেই। বদলে যাওয়া বিশ্বে সব দেশ সব জাতিই আসলে ধুঁকছে। ছবি দেখে বা ভিডিও দেখে মনে হতে পারে, আরে এরা তো দিব্যি স্যুট-টাই, কোট-প্যান্ট পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সমস্যা কোথায়?
সমস্যা আছে। আপনি যদি ভেতরে প্রবেশ না করেন বুঝতে পারবেন না। এখানকার চার্চ বা গির্জাগুলো সপ্তাহান্তে এমনকি সপ্তাহের কোন কোন দিন দাতব্য কাজে খোলা থাকে। সকাল থেকে গরম সসেজ রুটি টোস্ট ডিম ভাজি চা কফি বানিয়ে রাখে তারা। তারা জানে মানুষ আসবেই। মানুষের প্রয়োজন আছে আসার। এমন চ্যারিটি বহু জায়গায় এখন সংকুলান করতে পারছে না। না খাবার, না ভিড়ের। ভিড় যে খুব চোখে পড়ার তা নয়, কিন্তু আছে। একটা সময় এই কবছর আগেও আমি কাউকে হাত পেতে কিছু নিতে দেখিনি। নিলেও তা হাতে গোণা। এখন রাস্তায় পয়সা নিয়ে গান করা বা কাগজে নিজেকে দুঃস্থ লিখে বসে থাকা মানুষ বাড়ছে । বছরখানেক ধরে যেমনটা দেখছি, সিডনিতে আমি এর আগের ২০ বছরে কখনো এতো অভাবী মানুষ দেখিনি। দারিদ্র্যের ঢেউ আমেরিকা-ইউরোপজুড়ে বিস্তৃত হচ্ছে বলে জানতে পাচ্ছি।
আমার নিজের একটা ঘটনার কথা বলি। ভোর সকালে মানুষ ঘুম থেকে ওঠার আগেই কাজে যেতাম । এত সকাল বেলা আর যাই হোক সাজগোজ চলে না। মাথার চুল থাকে উস্কোখুস্কো। গলার কলার কোটের ভাঁজও হয়তো অবিন্যস্ত। সে দিন সকালে শপিং মলের চেইন শপে দেখি চল্লিশোর্ধ এক মহিলা খাবার কিনে যতবার টাকা দেয়ার চেষ্টা করছিল তার কার্ড কাজ করছিল না। ম্যাসেজ ছিল একাউন্টে টাকা নেই। আমি আর কখনো কাউকে এতটা বেপরোয়া দেখিনি । মুখ কালো করে বেরিয়ে যাবার সময় বারবার বলছিল আমার খুব খিদে পেয়েছে। আমি কিছু খেতে চাই। আমি জানি তার খাবার জুটে যাবে। কিছুটা এগিয়ে বিখ্যাত চেইনশপ খাবারের দোকানগুলোতে জুটে যাবে কিছু না কিছু। অনেকেই জানেন আজকাল ইউরোপেরও নানান দেশে একটা সিস্টেম চালু হয়েছে। দারুণ এটি।
যেমন ধরুন আমি যদি একটা মিল কিনি তাতে বার্গার চিপসসহ যে কোন ড্রিংকস থাকে। এখন আমি যেহেতু চা-খোর ফানটা কোকের বদলে চা চেয়ে নিই। এর সঙ্গে আমি আর একটা জিনিস ফ্রি পাব। ষাট পেরুলে যে কোন সিনিয়র সিটিজেনের জন্য বাকি ড্রিংকসটা ফ্রি। এখন আমি দুটো পানীয় দিয়ে কি করব? আমি বলে দিতে পারি ওই এক কাপ কফি বা চা তোমার কাছে জমা থাক। কোন দুঃস্থ বা তেমন কেউ এসে চাইলে তুমি সেটা তাকেই দিও। শুধু ফ্রি কেন আপনি চাইলে নিজের খাবার কেনার সময় এমন কিছু ডোনেট করতেই পারেন। যারা বিক্রেতা বা দোকানে কাজ করে সেসব তরুণ-তরুণীরা হিসাব রাখে এবং ঠিকই কাউকে না কাউকে তা দিয়ে দেয় ।
বলছিলাম সে দিনের ভোর বেলার কথা। আমি একটুকরো বেনানা কেক কিনে দাম চুকাতে গিয়ে শুনি আমার ও টাকা কম আছে। হতেই পারে। সব টাকা তো আর এক একাউন্টে থাকে না। আমি সরে দাঁড়িয়ে একটু দূরে গিয়ে মোবাইলে আমার পাসওয়ার্ড ঠিক করছিলাম। যাতে কিছু ডলার সে একাউন্টে পাঠাতে পারি। এ বিষয়ে সাবধানতা ও গোপনীয়তার জন্যই দূরে সরে যাওয়া। ফিরে আসতেই কাউন্টারের মেয়েটি আমার হাতে কেকটা ধরিয়ে দিয়ে বলল, বাই। আমি তাকে বললাম, আমি তো টাকা দিইনি। দাঁড়াও টাকা দিই আগে। সে আমাকে অবাক করে দিয়ে জানিয়েছিল আর একজন মানুষ টাকাটা দিয়ে চলে গেছেন। আমি সে মানুষটিকে খুঁজেই পেলাম না। আমার দরকার না থাকলেও এই মানবিক সাহায্য আমাকে মুগ্ধ করেছিল ।
যে কথা বলছিলাম এখন এমনই সময়। যুদ্ধ বিগ্রহ অশান্তি দুনিয়াকে পাগল করে তুলেছে। আমার সবসময় মনে হয় যে নেতা যে নেতৃত্ব আর প্রজ্ঞা বিশ্বকে এগিয়ে দিয়েছিল তা আর নেই। রুজভেল্টের দেশে রেগানের দেশে বাইডন বেমানান। বেমানান ইউকের প্রধানমন্ত্রী। লেনিনের দেশের রাষ্ট্রপ্রধান মহামারীর পরও যুদ্ধ চালিয়ে যান। চীনের প্রধানমন্ত্রীর চেহারা দেখলেই বুঝবেন তার কৌশল আছে বুদ্ধি আছে কিন্তু মন নেই। থাকলেও তা বোঝা যায় না। সে দৃষ্টিকোণে উপমহাদেশও ভুগছে। পাশের দেশ মিয়ানমারে শাসক কি করে কেন করে সবাই জানে। কিন্তু কেউ থামায় না তাদের ।
বরং আমাদের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকেই আমার কোমল বলে মনে হয়। যে কোন ভাষণে তিনি দেশের গরিব মানুষদের সামাজিক আর্থিক উন্নয়নের কথা বলেন। তাদের যে তিনি ভালোবাসেন এটা নিশ্চিত। কিন্তু সব কিছু কি একজন করতে পারে? না তা সম্ভব? চারপাশের মানুষগুলো ঠিক না হলে যা হয় তাই ঘটছে দেশে। বাংলাদেশ একা লড়াই করছে না আজ সারা পৃথিবী ভুগছে। এর থেকে একা বের হওয়া অসম্ভব । সে কারণে সম্মিলিত উদ্যোগ আর পরিকল্পনার কথা বলছেন অনেকে। কিন্তু ঘণ্টা বাঁধবে কে? ওই যে বলছিলাম দুনিয়াজুড়ে মান্য করার মতো নেতা কোথায়?
আমার মনে হয় পশ্চিমে এখন সূর্য অস্তাচলে। তাদের অবস্থা পুরাতন জমিদারের মতো। ঠাঁটবাট আছে কিন্তু পাওয়ার নেই। আমেরিকা বিষয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যা বলেন তার তুলনা হয় না। এই দেশটি সারাদেশে এক ধরণের মাতব্বরি করে বেড়ায়। মাতব্বর থাকা খারাপ না। কিন্তু মাতব্বরের পাওয়ার যদি ভালো কাজে ব্যবহার না হয় তার মূল্য কি? জনগণের দুঃখ-দুর্দশা আর হতাশার সাথে রাজনীতি চলতে না পারলে যা হয় তার নমুনা দেখছে বিশ্ব।
বাংলাদেশ-ভারত-চীন-ব্রাজিল এই দেশগুলোর নেতাদের ঐক্য আর সংহতি আগামী দুনিয়ার জন্য মঙ্গলজনক হতে বাধ্য। দেশে দেশে যুদ্ধ বিগ্রহ আর দাঙ্গা কমিয়ে নিজেদের দেশের মঙ্গল কামনা করা নেতা চায় পৃথিবী। সবার আগে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি স্থাপন করা জরুরি। ফিলিস্তিনিদের একটা দেশ চাই এ কথা আমরা ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছি। আজ আমাদের জীবন প্রায় শেষের পথে। এখনো সে সমস্যার সমাধান হয়নি। অচিরে হবে এমনটাও মনে হয় না।
বিশ্ব বাস্তবতায় আমাদের কামনা যুদ্ধবিগ্রহ বন্ধ হোক। মানুষের কষ্ট আর বেদনা বাড়ছে। খাবারের অভাবে, চিকিৎসার অভাবে, বাসস্থানের অভাবে মানুষ সব দেশে অশান্তি অনিশ্চয়তায় জীবনযাপন করছেন । কত আগে রবীন্দ্রনাথ সভ্যতার সংকটে এসব বিষয়ে বাণী দিয়ে গেছেন । তিনি বারবার বলেছেন সভ্যতার এই সংকট কাটাতে হলে মানুষের প্রতি বিশ্বাস রাখতে হবে। সে বিশ্বাস রাখা ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে। তবু আশাবাদ থাকে। মানুষই পারে ঘুরে দাঁড়াতে। যেমনটা করোনা পরবর্তীকালে সভ্যতা আবারো ঘুরে দাঁড়াতে পারছে। বাকিটা সময়ের হাতে ।