সুনামগঞ্জ জেলায় চলতি বছর ২ লক্ষ ২৩ হাজার ৫৩০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। উৎপাদিত হবে প্রায় ১৪ লক্ষ টন ধান।
Published : 27 Apr 2025, 09:08 AM
সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার কৃষ্ণপুর গ্রামের কিষাণী শিবানি বর্মণের বাড়ির পাশেই করচার হাওর। সেখানে যেদিকে চোখ যায়, কেবলই হলুদ ধানের ঝিলিক। উৎসবের আমেজে সেই ধান কাটছেন কৃষকরা।
হাওরের কান্দায় দাঁড়িয়ে তা দেখতে দেখতে হাসিমুখে শিবানি বললেন, “ইবার সব বাদি বালা বৈশাখ পাইছি। লস অইতো না।” অর্থাৎ এবার সবদিক থেকে ভালো বৈশাখ পেয়েছেন। লোকসান হবে না।
শিবানির মত হাওরের অন্যান্য কৃষক পরিবারের সদস্যদের মুখেও এখন খুশির ঝিলিক। কারণ আবহাওয়া অনুকূলে এবার বোরো মৌসুমে ভালো ফলন পেয়েছেন তারা।
একইসঙ্গে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই হাওরের অর্ধেকের বেশি ধান কাটা হয়ে গেছে।
সরকারি হিসেবেও শুক্রবার পর্যন্ত হাওরে ৬২ ভাগ ধান কাটা শেষ। আর হাওর ও নন হাওর মিলিয়ে জেলার ৫২ ভাগ ধান কাটা সম্পন্ন হয়েছে বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ।
করচার হাওরটি সুনামগঞ্জ সদর ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা নিয়ে বিস্তৃত। সরেজমিনে সেখানে দেখা গেছে, হাওরের গভীরে কাস্তে হাতে কৃষকরা এবং উঁচু অংশে ধান কাটা হচ্ছে যন্ত্রের মাধ্যমে।
উৎসবের আমেজে হাওরের কান্দায় তৈরি খোলায় চলছে কাটা ধানের মাড়াই। সেখানে ত্রিপালে ধান শুকানো হচ্ছে। সেই ধানের স্তূপে বাহু ডুবিয়ে কৃষক-কিষাণী ঠুকরি ভরে নাড়ছেন, বস্তায় ভরছেন। তাদের সঙ্গ দিচ্ছে পরিবারের স্কুল পড়ুয়া শিশু-কিশোররা।
পাশে কাটা ধানের খড়ও শুকানো হচ্ছে; যা বর্ষায় গবাদি পশুর খাদ্য হিসেবে সংরক্ষণ করেন কৃষক।
করচার হাওরের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার কৃষক ও মুক্তিখলা গ্রামের বাসিন্দা মাহমুদুল ইসলাম বলেন, “আমি ৭ কিয়ার জমিতে ধান করছিলাম। ছয় কিয়ার কাটিলিছি। আরো এক কিয়ার (৩০ শতাংশ) বাকি রইছে। আর ৪-৫ দিন সময় পাইলে আমরা এই আউর ঠামাইলিমু। ইবার আর ধান তোলা লইয়া আর কুনু টেনশন নাই।”
করচার হাওরে ১০ হাজার হেক্টরের বেশি জমি আছে। তবে চলতি বছর আবাদ হয়েছে প্রায় ৪ হাজার ২২০ হেক্টর। এর মধ্যে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলায় ১ হাজার ৫২০ হেক্টর এবং বিশ্বম্ভরপুর উপজেলায় ২ হাজার ৭০০ হেক্টর।
বৃহস্পতিবার পর্যন্ত হাওরটির গভীর অংশের সব ধান কাটা শেষ। এখন ওপরের অংশের ধান কাটছেন কৃষকরা।
কৃষকরা জানালেন হাওরটিতে এবার বিআর ৯২, ৮৮, ২৯ ধান ভালো হয়েছে। তারা হাইব্রিড ধানকে ‘বড় ধান’ ডাকেন। এই ধানের মধ্যে ঝলক, সুরভি ভালো হয়েছে। কেয়ার প্রতি ২০ মণ হয়েছে। কোনও ক্ষেতে ২২-২৫ মণও হয়েছে। এবার উৎপাদন খরচের আরো দুই গুণ লাভবান হবেন বলে জানালেন তারা।
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে মাঠে হাওরে ৯৫৫টি কম্বাইন হার্ভেস্টর, ১১৬টি রিপার ও ১ লক্ষ ৯৩ হাজার ৩১০ জন শ্রমিক ধান কাটছেন। ধান কাটা শ্রমিক ও যন্ত্রের সংকট না থাকায় এবং আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় দ্রুত ধান কাটা সম্পন্ন হয়েছে।
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান বলেন, একটি কম্বাইন হার্ভেস্টর মেশিনে দৈনিক ৩০ বিঘা ও একটি রিপার মেশিন প্রতিদিন ৫ বিঘা জমির ধান কাটতে পারে। এছাড়াও একজন শ্রমিক গড়ে প্রায় ১৫ শতাংশ জমির ধান কাটতে পারে।
করচার হাওরের হাওরের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার কৃষ্ণপুর গ্রামের কৃষক শিপুল বর্মণ বলেন, “ইবার ধান কাট্টুয়া ও মেশিনের সমস্যা অইছে না। আবহাওয়াও বালা। ধান কাটাত সমস্যা অইছে না আমরার। আমরার করচার আউরোর ধান কাটা শেষ অইগিছে।”
একই হাওরের রাধানগর গ্রামের কৃষক রুহুল আমিন বলেন,“আমরার করচার আউরো বালা ফসিল অইছে। ৪-৫ দিন পর আস্তা আউরের ধান শেষ অইযিবো।”
তিনি বলেন, “আমি ২০ কিয়ার খেত করছিলাম। ১৮ কিয়ার কাটিলিছি। কোনও বান-তুফান পাইছে না। ধানও শুকাইলিছি। সামান্য বৃষ্টিপাত ক্ষতি করতে পারছে না।”
একই গ্রামের কৃষক আয়ূব খান বলেন, “আমি ১০ কিয়ার জমিনো ৮৮ ধান লাগাইছিলাম। ৮ কিয়ার কাটিলিছি। ২০ মণ দর ধান অইছে। ই ধান পাইয়া আমি খুশি। ইবারের মতো গিরস্তি পাইলে আমরার অভাব থাকতো না।”
এবার ধানের টাকায় বিয়ে শাদি, শিক্ষা, চিকিৎসা ও জীবনের অন্যান্য খরচ সহজেই পূরণ করতে পারবেন বলে জানান তিনি।
অন্যদিকে জেলার অন্যতম বড় হাওর দেখার হাওর। সুনামগঞ্জ সদর, শান্তিগঞ্জ ও দোয়ারাবাজার উপজেলা নিয়ে বিস্তৃত সে হাওরে শুক্রবার পর্যন্ত অর্ধেক ধান কাটা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষকরা।
এই হাওরের কৃষকরা ধানের দাম ও যন্ত্রে ধান কাটা নিয়ে তাদের অভিজ্ঞতার কথাও জানালেন। তবে ভালো ফলন নিয়ে তারাও এবার খুশি।
দেখার হাওরের বাহাদুরপুর গ্রামের কৃষক আব্দুল জলিল বলেন, ‘১০ কিয়ার খেত করছিলাম। ৬ কিয়ার আউরো রইছে। চাইর কিয়ার কাটছি। প্রতি কিয়ারে ২০ মণ দর ধান অইছে। আরো ৮-১০ দিন সময় পাইলে আমরার আউরোর হকল ধান শেষ অইযিবো।’
একই হাওরের একই গ্রামের কৃষক আজিম উদ্দিন বলেন, “দেখার আউরো অর্ধেক ধান কাটা শেষ। ই সপ্তায় শেষ অইযিবো আশা করি। আমার ১৮ কিয়ারের মাঝে ৬ কিয়ার কাটিলিছি। বালা ধান অইছে।
তবে ধানের দাম নিয়ে ক্ষুব্ধ এই কৃষক বলেন, “অনে বাজারে ধানের দাম কম। পাইকাররা ৯০০ টাকায় কিনে। সরকারি খাদ্য গুদামে আমরা ধান লইয়া গেলে কয় ধান শুকানো অইছে না। ভিজা। নানানত কয়। ইতার লাগি আসল কৃষক ধান দিতো যায় না।”
এদিকে হার্ভেস্টর যন্ত্রে ধান কাটা নিয়ে কিছু ভোগান্তির অভিজ্ঞতার কথা জানান একই গ্রামের কৃষক আবুল বশর।
তার বর্ণনা দিয়ে বলেন, “যাদের মেশিন আছে তারা টাকা বেশি নেয়। ক্ষেতে মেশিন নামালে নষ্ট হয়ে যায়। তখন মালিক বলে যন্ত্রাংশ নেই। এভাবে দুর্ভোগের মুখে আছেন কৃষকরা “
তার কথার সত্যতা জানা গেল জানিগাঁও গ্রামের হার্ভেস্টর যন্ত্রের মালিক জিয়া উদ্দিনের কথায়।
দুটি যন্ত্রের মালিক এই কৃষক জানান, তার দুটি যন্ত্রই তাকে ভোগাচ্ছে। অথচ কোম্পানির ওয়ারেন্টি এখনো রয়ে গেছে। কোম্পানি সময় মতো সার্ভিস দেয় না এবং পার্টসও পাওয়া যায় না।
কৃষি বিভাগের মতে, সুনামগঞ্জ জেলায় চলতি বছর ২ লক্ষ ২৩ হাজার ৫৩০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। উৎপাদিত হবে প্রায় ১৪ লক্ষ টন ধান।
যা থেকে ৯ লক্ষ ২১ হাজার ৪১৩ টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে। যার বাজার মূল্য প্রায় ৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা।
চাষকৃত বোরো ধানের মধ্যে এবার হাইব্রিড ৬৫ হাজার ২০০ হেক্টর, উফসী ১ লক্ষ ৫৭ হাজার ২১০ হেক্টর, মাত্র ১ হাজার হেক্টরে স্থানীয় আদি জাত আবাদ হয়েছে।
এর মধ্যে বিআর ৮৮, ৮১, ৮৯, ৯২, হাইব্রিড সিনজেনটা, হীরা-১,২, সুরভি, ইস্পাহানী, ঝলক রাজ, ময়নাসহ বিভিন্ন প্রজাতির ধান ভালো ফলন হয়েছে।
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোস্তফা আজাদ বলেন, “এবার বাম্পার ফলন পেয়েছেন সব কৃষক। বিঘা প্রতি ২৫-৩০ মণ ধান পেয়েছেন সবাই। অনুকূল আবহাওয়া, পর্যাপ্ত যন্ত্র এবং শ্রমিকের কারণে দ্রুত ধান কাটা হয়েছে। আশা করছি লাভবান হবেন কৃষক।”